জাতিসংঘে ইউনূস: অবাধ নির্বাচনের জন্য সংস্কার চলমান
2024.09.27
জাতিসংঘ
বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান হিসেবে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে প্রথম বক্তব্যে অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস জানিয়েছেন, কীভাবে দেশের সংক্ষিপ্ত গণ আন্দোলনের প্রেক্ষিতে ঘটা ‘যুগান্তকারী পরিবর্তন’ তাঁকে একটি নিরপেক্ষ নির্বাচন নিশ্চিত করার জন্য রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে সংস্কারের দায়িত্ব দিয়েছে।
তুমুল করতালির ভেতর শুক্রবার নিউ ইয়র্কে জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে বক্তব্য শুরু করে ড. ইউনূস বিশ্ববাসীকে স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের আকাঙ্ক্ষায় উজ্জীবিত ‘নতুন বাংলাদেশ’ এর সাথে সম্পৃক্ত হওয়ার আহ্বান জানান।
গত জুলাই-আগস্টে ঘটা ছাত্র ও জনতার আন্দোলনকে “মুনসুন অভ্যুত্থান” হিসেবে আখ্যায়িত করে বাংলায় দেয়া বক্তব্যে তিনি বলেন, “গণতন্ত্র, আইনের শাসন, সমতা ও সমৃদ্ধি অর্জনের মাধ্যমে একটি ন্যায়ভিত্তিক ও অন্তর্ভুক্তিমূলক গণতান্ত্রিক সমাজ হিসেবে আত্মপ্রকাশের অভিপ্রায় বাস্তবায়নে আমি বাংলাদেশের প্রতি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সমর্থন ও সহযোগিতা ব্যাপকতর ও গভীরতর করার আহ্বান জানাই।”
ছাত্র ও জনতার কয়েক সপ্তাহের গণ আন্দোলনের মুখে গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী পদ থেকে পদত্যাগ করে দেশ ছেড়ে যাবার কয়েকদিন পরে ১৯৮৬ সালে নোবেল বিজয়ী ৮৪ বছর বয়সী মুহাম্মদ ইউনূস বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন।
শেখ হাসিনা সরকারের স্বৈরতান্ত্রিক শাসনের বিরুদ্ধে সাম্প্রতিক আন্দোলনে ৮০০’র বেশি মানুষ নিহত হয়েছেন বলে জানান তিনি।
“এই জুলাই-আগস্টে বাংলাদেশে যে যুগান্তকারী পরিবর্তন সংঘটিত হয়েছে, তার প্রেক্ষিতেই আজ আমি আপনাদের এ মহান সংসদে উপস্থিত হতে পেরেছি,” জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৭৯তম অধিবেশনে বলেন ইউনূস।
বিশ্লেষকদের মতে, শেখ হাসিনার ১৫ বছরের কর্তৃত্ববাদী শাসনে অকার্যকর হয়ে পড়া রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে কার্যকর করাই ইউনূস সরকারের সামনে সব চেয়ে বড়ো চ্যালেঞ্জ। এর পাশাপাশি রয়েছে, রাজনীতি মুখাপেক্ষী বেসামরিক প্রশাসন সংস্কার, ভঙুর অর্থনীতি পুনরুদ্ধার এবং আন্দোলনে নিহতদের জন্য ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা।
সর্বোপরি গণতান্ত্রিক উপায়ে ক্ষমতা হস্তান্তরের জন্য একটি অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন আয়োজন অন্তর্বর্তী সরকারের অন্যতম প্রধান দায়িত্ব।
দায়িত্ব নেবার সাত সপ্তাহ পরে, ইউনূস জাতিসংঘকে জানান, তাঁর সরকার দেশের প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে কাঠামোগত সংস্কারের উদ্যোগ নিয়েছে।
তিনি আসন্ন নির্বাচনের কোনো সময়সীমা উল্লেখ না করে বলেন, আগের সরকার রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে সম্পূর্ণ রাজনীতিকরণ ও অকার্যকর করে ফেলায় সেগুলোর সংস্কারও বেশ জটিল। সেগুলোর সঠিক সংস্কার ছাড়া একটি নিরপেক্ষ নির্বাচন আয়োজন করা সম্ভব নয়।
তিনি বলেন, ইতিমধ্যেই নির্বাচন ব্যবস্থা, সংবিধান, বিচারব্যবস্থা, বেসামরিক প্রশাসন এবং আইনশৃঙ্খলা ক্ষেত্র সংস্কারের জন্য কমিশন গঠন করা হয়েছে। এছাড়া গণমাধ্যমসহ আরো কিছু ক্ষেত্রে সংস্কারের উদ্যোগ নেয়া হবে বলেও জানান তিনি।
তাঁর অনুরোধে জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশনের একটি দল ইতিমধ্যে হাসিনা সরকারের আমলে গত ১৫ বছরের গুমের ঘটনা তদন্ত করছে বলেও জানান তিনি।
ব্যাংক ও আর্থিক ক্ষেত্রে বিস্তারিত সংস্কার প্রক্রিয়া চলমান উল্লেখ করে তিনি আশ্বস্ত করেন যে এ ক্ষেত্রে বিদেশি কোনো বাণিজ্য স্বার্থ ক্ষতিগ্রস্ত হবে না।
“আমরা মানুষের মৌলিক অধিকার সমুন্নত ও সুরক্ষিত রাখতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। আমাদের দেশের মানুষ মুক্তভাবে কথা বলবে, ভয়ভীতি ছাড়া সমাবেশ করবে, তাঁদের পছন্দের ব্যক্তিকে ভোট দিয়ে নির্বাচিত করবে- এটাই আমাদের লক্ষ্য,” বলেন ইউনূস।
বাংলাদেশের ছাত্রজনতা অদম্য সংকল্প ও প্রত্যয়ের মাধ্যমে একটি “স্বৈরাচারী ও অগণতান্ত্রিক” শাসনব্যবস্থা থেকে যে মুক্তি এনে দিয়েছে, সেই সংকল্পের মধ্যেই বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নিহিত উল্লেখ করে তিনি বলেন, বাংলাদেশের নতুন প্রজন্ম একটি “অন্তর্ভুক্তিমূলক গণতন্ত্রের জন্য” জীবন উৎসর্গ করেছে।
“বন্দুকের গুলি উপেক্ষা করেও বুক পেতে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল আমাদের তরুণরা। অবৈধ রাষ্ট্রক্ষমতার বিরুদ্ধে প্রবলভাবে সোচ্চার হয়েছিল আমাদের তরুণীরা। স্কুল পড়ুয়া কিশোর-কিশোরীরা নিশঙ্কচিত্তে উৎসর্গ করেছিল তাদের জীবন। শত শত মানুষ চিরতরে হারিয়েছে তাদের দৃষ্টিশক্তি। আমাদের মায়েরা, দিনমজুরেরা ও শহরের অগণিত মানুষ তাঁদের সন্তানদের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে নেমেছিল রাজপথে,” বলেন ইউনূস।
আওয়ামী লীগের বিক্ষোভ
এদিকে অধ্যাপক ইউনূস জাতিসংঘে ভাষণ দেবার আগের দিন বৃহস্পতিবার নিউ ইয়র্কের ম্যানহাটনে তাঁর হোটেলের বাইরে সদ্য ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের সদস্যরা বিক্ষোভ সমাবেশ করেন।
অধ্যাপক ইউনূসকে “অবৈধ” ও “খুনি” হিসেবে আখ্যায়িত করে বিক্ষোভে অংশগ্রহণকারী যুক্তরাষ্ট্র আওয়ামী লীগের সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান বেনারকে বলেন, “বাংলাদেশের ১৭ কোটি মানুষকে প্রতিনিধিত্ব করার অধিকার” তাঁর নেই। কারণ তিনি নির্বাচিত নন, বরং ছাত্রদের দ্বারা মনোনীত।
এর আগে এক বক্তব্যে অধ্যাপক ইউনূস ছাত্র আন্দোলনে “সুনিপুণভাবে পরিকল্পিত” বলে উল্লেখ করেছিলেন। তাঁর সেই বক্তব্যের জের ধরে সিদ্দিকুর রহমান অভিযোগ করেন যে, আন্দোলনের সময় হতাহতের ঘটনায় ইউনূস দায়ী।
“এরা সুনিপুণভাবে পরিকল্পনা করেছে, সে জন্যই হাজারো মানুষ মারা গেছে। তিনিই সব হত্যাকাণ্ডের জন্য দায়ী,” বলেন সিদ্দিক।
ইউনূসের হোটেলের বাইরে ৫০ জনের মতো আওয়ামী লীগ সমর্থক জড়ো হয়ে এই বিক্ষোভ করেন। এই বিক্ষোভকারীরা যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন রাজ্য থেকে এসেছেন, এছাড়া কয়েকজন কানাডা থেকেও এসেছেন বলে বেনারকে জানান সিদ্দিকুর।
বিক্ষোভকারীরা ‘ইউনূস কিলার’ বা ‘ইউনূস হত্যাকারী’ বলে শ্লোগান দিতে থাকেন।