বাংলাদেশি শ্রমিকের মৃত্যুকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষে চীনা নাগরিক নিহত
2019.06.19
ঢাকা
পটুয়াখালীর কলাপাড়ায় নির্মাণাধীন পায়রা তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্রে বাংলাদেশি ও চীনা শ্রমিকদের মধ্যে সংঘর্ষে এক চীনা নাগরিকের মৃত্যু হয়েছে। এ ঘটনায় তিনটি পৃথক তদন্ত কমিটি গঠন করেছে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন কর্তৃপক্ষ।
দুর্ঘটনায় বাংলাদেশি এক শ্রমিক নিহত হওয়ার ঘটনায় ভুলবোঝাবুঝির জের ধরে মঙ্গলবার রাতে শুরু হওয়া ওই সংঘর্ষে আহত হয়েছেন অন্তত সাতজন। আহতদের দুজন বাংলাদেশি ও পাঁচজন চীনের নাগরিক।
শ্রমিক নেতারা বলছেন, বাংলাদেশে বিদেশি কোনো শ্রমিক হত্যার ঘটনা এই প্রথম।
বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক বাকির হোসেন বেনারকে জানান, মঙ্গলবার রাতের ওই সংঘর্ষে চীনা নাগরিক জাং ইয়াং সাং (২৬) আহত হন। পরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় বুধবার ভোরে তাঁর মৃত্যু হয়।
তিনি বলেন, “নিহত জাং ইয়াং-কে মঙ্গলবার রাত দুটোর দিকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। তাঁর মাথায় আঘাত গুরুতর ছিল। প্রচুর রক্তক্ষরণও হয়েছিল।”
কলাপাড়া থানার ওসি মনিরুল ইসলাম বেনারকে জানান, মঙ্গলবার সকালে তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্রের বয়লারের ওপর থেকে পড়ে গিয়ে সাবিন্দ্র দাস (৩২) নামে এক বাংলাদেশি শ্রমিকের মৃত্যু হয়। তাঁর লাশ লুকিয়ে ফেলার চেষ্টা হয়েছে—বাংলাদেশি শ্রমিকদের এমন অভিযোগের জের ধরে চীনা ও বাংলাদেশি শ্রমিকেরা সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। পরে পুলিশ গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে।
পায়রা তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. রেজওয়ান ইকবাল খান বেনারকে বলেন, “আসলে একজন শ্রমিকের মৃত্যু নিয়ে ভুল বোঝাবুঝির কারণে বাংলাদেশি শ্রমিকদের ও চীনাদের মধ্যে উত্তেজনা সৃষ্টি হয়। পুলিশ এসে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করে। এখন পরিস্থিতি স্বাভাবিক রয়েছে।”
বিদ্যুৎকেন্দ্রে বাড়তি পুলিশ মোতায়েন রয়েছে বলে জানান ওসি মনিরুল।
বিদ্যুৎকেন্দ্রের কর্মীরা জানান, বয়লারের ওপর থেকে পড়ে যাওয়ার পরপরই সাবিন্দ্র দাসের মৃত্যু হয়। তাঁর বাড়ি হবিগঞ্জ জেলায়।
জানা যায়, পায়রা তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্রে ২ হাজার সাতশ’ চীনা কর্মী এবং আট হাজার বাংলাদেশি কর্মী নিয়োজিত রয়েছেন।
২০১৬ সালের ১৪ অক্টোবর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও চীনের রাষ্ট্রপতি শি জিন পিং পটুয়াখালীর কলাপাড়ায় পায়রা তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্রের নির্মাণকাজের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। যৌথভাবে বাংলাদেশ-চীন পাওয়ার কোম্পানি প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে।
চীনা শ্রমিকদের নিরাপত্তায় পুলিশ
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল বেনারকে বলেন, “বিদ্যুৎকেন্দ্রের চীনা শ্রমিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য পুলিশকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। আর যাতে কোনো সংঘর্ষ না বাঁধে সে জন্য প্রয়োজনীয় সকল পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে।”
তিনি জানান, চীনা নাগরিকের মৃত্যুর ঘটনায় মামলা দায়ের করবে পুলিশ। এ ঘটনার তদন্ত হবে।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, “আমরা চীনের দূতাবাসের সাথে পুলিশকে যোগাযোগ করতে বলেছি। তারা ময়নাতদন্ত পরিচালনা করতে চায় কিনা তা নিশ্চিত করতে বলেছি। দূতাবাস যদি সম্মত হয়, ময়নাতদন্ত করা হবে। অন্যথায় নয়।”
এদিকে এ বিষয়ে চীনের দূতাবাসে যোগাযোগ করা হলে তারা কোনো মন্তব্য করেনি।
তিনটি তদন্ত কমিটি
পায়রা তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্রে দুই শ্রমিক নিহত হওয়ার ঘটনায় পৃথক তিনটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। সাত দিনের মধ্যে এসব কমিটিকে প্রতিবেদন দেয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
সংঘর্ষ ও শ্রমিকদের নিহত হওয়ার খবর শুনে ঢাকা থেকে পটুয়াখালীতে ঘটনাস্থলে ছুটে যান বিদ্যুৎ ও জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু।
বুধবার দুপুরে তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের সভাকক্ষে মন্ত্রণালয় ও বিসিপিসিএল কর্মকর্তাদের সাথে জরুরি সভা অনুষ্ঠিত হয়।
সভার শেষে জানানো হয়, সংঘর্ষের প্রকৃত কারণ জানতে জেলা প্রশাসনের একটি, পুলিশের একটি ও বিসিপিসিএল এর একটি তদন্ত কমিটি কাজ করছে। আগামী ৭ দিনের মধ্যে কমিটিগুলোকে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে।
পটুয়াখালী পুলিশ সুপার মো. মইনুল হাসান বেনারকে জানান, “প্রকল্পের ভেতরে পর্যাপ্ত পুলিশ ও আর্মড পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে।”
জেলা প্রশাসক মতিউল ইসলাম চৌধুরী বেনারকে জানান, “তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র প্রকল্প এলাকা এখন প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। এখানে বাংলাদেশি ও চীনা নাগরিকদের আলাদা রাখার ব্যবস্থা করা হয়েছে।”
উল্লেখ্য, ২০১০ সাল থেকে চীন বাংলাদেশে বিনিয়োগ বাড়িয়েছে। চীনের সংস্থাগুলি পদ্মা সেতু, বন্দর, বিদ্যুৎ কেন্দ্র, সড়ক, সেতু এবং অন্যান্য উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে।
বিদ্যুৎ বিভাগ ও সংশ্লিষ্ট প্রকল্প বাস্তবায়নকারী প্রতিষ্ঠান সূত্র অনুযায়ী, ২০১৯ সালের আগস্টে এক হাজার ৩২০ মেগাওয়াটের বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি উৎপাদনে যাওয়ার কথা রয়েছে। বিদ্যুৎকেন্দ্রটি পরিচালিত হবে ইন্দোনেশিয়া ও অস্ট্রেলিয়া থেকে আমদানি করা কয়লার মাধ্যমে।
বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের চেয়ারম্যান খালিদ মাহমুদ বেনারকে জানান, প্রকল্পের মোট খরচ প্রায় দুই বিলিয়ন মার্কিন ডলার। এর মধ্যে প্রায় ৮৫ শতাংশ অর্থ ঋণ হিসেবে দিয়েছে চীন। এ বছরের ডিসেম্বরে প্রকল্পের প্রথম ইউনিট থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু হবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন।