পায়রা তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্রে সংঘর্ষ: কাজে যোগ দেয়নি বাংলাদেশিরা
2019.06.24
ঢাকা
পটুয়াখালীর পায়রা তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্রে মঙ্গলবার সংঘর্ষের পর এক সপ্তাহ পার হলেও কাজে যোগ দেয়নি বাংলাদেশি শ্রমিকেরা। তবে গত শনিবার থেকে চীনা শ্রমিকেরা কাজে ফিরেছে।
এই বিদ্যুৎ কেন্দ্রে সাত হাজার বাংলাদেশি শ্রমিক এবং দুই হাজার ৭’শ চীনা শ্রমিক কাজ করছে। চীনা নাগরিকেরা মূলত কারিগরি কাজে নিয়োজিত। আর নির্মাণকাজ করছে বাংলাদেশি শ্রমিকেরা।
পটুয়াখালীর পুলিশ সুপার মইনুল হাসান বেনারকে বলেন, “শনিবার প্রকল্পের চীনা কর্মকর্তারা বাংলাদেশি শ্রমিকদের সাথে মিটিং করেছেন। এরপরই চীনা শ্রমিকেরা কাজে যোগ দেয় এবং বাংলাদেশি শ্রমিকেরা ছুটিতে যায়।”
তিনি বলেন, “সকল চীনা নাগরিকের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হয়েছে।”
বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের চেয়ারম্যান খালেদ মাহমুদ বেনারকে বলেন, “বাংলাদেশি ও চীনা শ্রমিকদের মধ্যে সংঘর্ষের পর যেহেতু দু’পক্ষের মধ্যে সমস্যা হয়েছে সেহেতু বাংলাদেশি শ্রমিকদের ১৫ দিনের ছুটি দেয়া হয়েছে। তাঁদের বকেয়া বেতন-ভাতা পরিশোধ করা হচ্ছে।”
তিনি বলেন, “চীনা শ্রমিকেরা কাজে যোগ দিয়েছে। আমরা আশা করি পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসছে।”
খালেদ মাহমুদ বলেন, “সেখানে ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছে। বেশ কিছু ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। আমরা অচিরেই পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে পারব বলে আশা রাখি।”
তিনি বলেন, “ঘটনা তদন্তে একটি উচ্চ পর্যায়ের কমিটি গঠিত হয়েছে। কমিটির রিপোর্ট হাতে পেলে আমরা বলতে পারব প্রকৃতই কী কারণে এই সহিংসতা।”
এদিকে সহিংস ঘটনার সাথে জড়িত থাকার অভিযোগে এ পর্যন্ত ১৪জন বাংলাদেশি শ্রমিককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। আশপাশের গ্রামগুলোতে তল্লাশি চালাচ্ছে পুলিশ।
গ্রেপ্তার আতঙ্কে বিদ্যুৎ কেন্দ্রের আশপাশের কয়েকটি গ্রাম প্রায় পুরুষশূন্য হয়ে পড়েছে বলে জানিয়েছেন এলাকাবাসী। পুলিশ বলছে, গ্রেপ্তার অভিযান চলবে।
গ্রেপ্তার আতঙ্ক
বিদ্যুৎকেন্দ্রের পাশের গ্রাম চর নিশানবাড়িয়া গ্রামের অধিবাসী আবুল কাশেম টেলিফোনে বেনারকে বলেন, “মঙ্গলবারের ঘটনার সাথে জড়িতদের খুঁজতে ব্যাপক অভিযান চালিয়েছে পুলিশ।”
“পুলিশের ভয়ে গ্রামের প্রায় সকল পুরুষ পালিয়ে বেড়াচ্ছে। আমরা ভয়ে ভয়ে আছি,” বলেন তিনি।
পটুয়াখালী জেলার পুলিশ সুপার মইনুল হাসান বেনারকে বলেন, “চীনা নাগরিক নিহত হবার ঘটনায় একটি ভাঙচুর এবং একটি হত্যা মামলা হয়েছে। এ পর্যন্ত ওই ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকার কারণে মোট ১৪ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।”
“তাঁদের আদালতে হাজির করা হয়। আদালত তাঁদের কারাগারে প্রেরণ করেছে,” বলেন তিনি।
মইনুল হাসান বলেন, “মঙ্গলবারের ভাঙচুরের ঘটনায় অনেক মালামাল লুটের অভিযোগ পাওয়া গেছে। আমরা আশপাশের গ্রামে বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে চুরি যাওয়া মালামাল উদ্ধার করেছি। আমরা চুরি যাওয়া মালামাল উদ্ধারে এবং আসামিদের ধরতে অভিযান চালিয়ে যাব।”
পটুয়াখালী জেলা পুলিশ সূত্র জানায়, পায়রা বিদ্যুৎ কেন্দ্রে ভাঙচুর এবং চীনা নাগরিক হত্যার দায়ে দায়ের করা দুটি মামলায় মোট ১২’শ শ্রমিককে আসামি করা হয়েছে।
পুলিশ সুপার বলেন, “ইতিমধ্যে আমরা আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য মোতায়েন করেছি। বর্তমানে পরিস্থিতি শান্ত রয়েছে।”
গত ১৮ জুন মঙ্গলবার রাতে এক বাংলাদেশি শ্রমিকের মৃত্যুকে কেন্দ্র করে পায়রা তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্রে বাংলাদেশি ও চীনা শ্রমিকেরা সহিংসতায় জড়িয়ে পড়ে। ওই ঘটনায় এক চীনা নাগরিক নিহত হন।
বাংলাদেশি শ্রমিকদের অভিযোগ চীনারা বাংলাদেশি ওই শ্রমিককে ওপর থেকে ধাক্কা দিয়ে হত্যা করেছে।
বিব্রত বাংলাদেশ
আসছে ১ জুলাই প্রধানমন্ত্রীর চীন সফরের আগে এ ধরনের ঘটনায় বিব্রত বাংলাদেশ। তবে এ বিষয়টি দুই দেশের কূটনৈতিক সম্পর্কে কোনো প্রভাব ফেলবে না বলে মনে করছেন বিশ্লেষকেরা।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বেনারকে বলেন, “প্রধানমন্ত্রীর আসন্ন চীন সফরের আগে বাংলাদেশি শ্রমিকদের সাথে সহিংসতায় চীনা শ্রমিকের মৃত্যু একটি বিব্রতকর ঘটনা।”
এ কারণে সরকারের তরফ থেকে চীনা নাগরিকদের নিরাপত্তা বিধান করতে স্থানীয় পুলিশ প্রশাসনকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে বলে জানান তিনি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের শিক্ষক মুহম্মদ রুহুল আমিন বেনারকে বলেন, “চীনা নাগরিকের মৃত্যু দু’দেশের মধ্যকার বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কে মারাত্মক প্রভাব ফেলবে না। তবে নিজ দেশের নাগরিকের মৃত্যুর কারণ জানতে চাইবে চীন। বিচারের দাবিও জানাবে।”
“বাংলাদেশের বিচারিক প্রক্রিয়ায় ন্যায় বিচার হলে চীনের আপত্তি থাকার কথা নয়,” বলেন তিনি।
আগামী ডিসেম্বর থেকে বিদ্যুৎ কেন্দ্রটির প্রথম ইউনিট উৎপাদনে যাবে বলে জানান বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের চেয়ারম্যান খালিদ মাহমুদ।
ঘটনার পর থেকে সাত হাজার বাংলাদেশি শ্রমিক কর্মবিরতিতে যায়। বন্ধ হয়ে যায় ১,৩২০ মেগাওয়াট ক্ষমতার বিদ্যুৎ কেন্দ্রটির কাজ।
পটুয়াখালী জেলার কলাপাড়া উপজেলায় পায়রা বন্দরের অপরদিকে নির্মিত হচ্ছে পায়রা তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি। প্রায় দুই বিলিয়ন ডলার ব্যয়ে নির্মানাধীণ বিদ্যুৎ কেন্দ্রটির ৮৫ ভাগ অর্থ আসছে চীনের কাছ থেকে। আর বাকি অর্থের সংস্থান করছে বাংলাদেশ সরকার। এই বিদ্যুৎ কেন্দ্রটির কয়লা সরবরাহ করছে ইন্দোনেশীয় একটি কোম্পানি।