আরোও সংকীর্ণ হলো খালেদা জিয়ার নির্বাচনে অংশগ্রহণের সুযোগ
2018.11.27
ঢাকা
মঙ্গলবার দেওয়া হাই কোর্টের এক রায়ের কারণে আটকে যেতে পারে কারারুদ্ধ বিএনপি দলীয় প্রধান খালেদা জিয়ার আসন্ন সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণের সুযোগ।
দুর্নীতির দুই মামলায় নিম্ন আদালতে ১৭ বছর কারাদণ্ডে দণ্ডিত খালেদা জিয়াকে বগুড়া-৬, ৭ এবং ফেনী-১ মোট তিন আসনে সোমবার মনোনয়ন দেয় বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)। বুধবার মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার শেষ দিন।
কিন্তু মঙ্গলবার হাইকোর্ট এক রায়ের পর্যবেক্ষণে বলেছে, কেউ দুর্নীতির দায়ে দুবছরের বেশি সাজাপ্রাপ্ত হলে তিনি নির্বাচনে অযোগ্য হবেন।
তবে এই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করা হবে বলে বেনারকে জানিয়েছেন বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ও বিএনপি নেতা জয়নুল আবেদীন।
এই রায়ের পর অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেছেন, সংবিধানের ৬৬ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী খালেদা জিয়া ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিতব্য সংসদ নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন না। এমনকি নিম্ন আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল চলমান থাকলেও তিনি নির্বাচনে অংশগ্রহণের অযোগ্য বলে বিবেচিত হবেন।
এই রায়ের পর বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সাংবাদিকদের বলেছেন, হাইকোর্টের এই রায়ে ‘সরকারের ইচ্ছার প্রতিফলন’ ঘটেছে।
বিএনপির স্থায়ী কামিটির সদস্য মাহবুবুর রহমান মঙ্গলবার বেনারকে বলেন, “আজকে হাইকোর্টে যে রায় দিয়েছে সেটা অনুযায়ী খালেদা জিয়া আগামী নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারবেন না।”
তিনি বলেন, আগামীকাল মনোনয়ন দাখিলের শেষ দিন। এখন মনে হচ্ছে খালেদা জিয়া ছাড়াই নির্বাচনে যেতে হবে বিএনপিকে।
মাহবুবুর রহমান বলেন, “খালেদা জিয়া ছাড়া বিএনপি নির্বাচনে অংশ নেবে না এমন কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি। খালেদা জিয়ার কনভিকশন একটি বাস্তবতা। এটাকে মেনেই বিএনপিকে নির্বাচনে অংশ নিতে হবে।”
তিনি বলেন, খালেদা জিয়ার সাজা মওকুফ আইনি লড়াইয়ের মাধ্যমেই হতে হবে। নির্বাচন বর্জন একটি ভুল সিদ্ধান্ত হবে।
কীভাবে এল আদালতের পর্যবেক্ষণ?
নিম্ন আদালতে দুর্নীতির দায়ে সাজাপ্রাপ্ত বিএনপির পাঁচ নেতা আমান উল্লাহ আমান, ডা. এজেডএম জাহিদ হোসেন, ওয়াদুদ ভূঁইয়া, মো. মশিউর রহমান ও মো. আব্দুল ওহাব তাঁদের দণ্ড ও সাজা বাতিলের জন্য হাইকোর্টে আবেদন করেন। তাঁরা সবাই জামিনে আছেন।
এই পাঁচ নেতা বিএনপির মনোনয়ন পেয়েছেন। কিন্তু নিম্ন আদালতে দণ্ডিত হওয়ায় তাঁরা নির্বাচন করতে পারছেন না। সেকারণেই তাঁরা দণ্ড স্থগিত চেয়ে হাইকোর্টে আবেদন করেন।
মঙ্গলবার বিচারপতি মো. নজরুল ইসলাম তালুকদার ও বিচারপতি কে এম হাফিজুল আলমের হাই কোর্ট বেঞ্চ ওই পাঁচ নেতার আবেদন খারিজ করে দেয়।
এর ফলে তাঁরা একাদশ সংসদ নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন না বলে সাংবাদিকদের জানান আদালতে দুর্নীতি দমন কমিশনের আইনজীবী খুরশীদ আলম খান।
অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলমও আদালতে উপস্থিত ছিলেন।
তিনি বেনারকে বলেন, সংবিধান অনুযায়ী কোনো ব্যক্তি ফৌজদারি অপরাধে দুই বছর কারাদণ্ডে দণ্ডিত হলে আর নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারবেন না।
তিনি বলেন, “সুতরাং, খালেদা জিয়া আগামী নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন না।”
এই রায়ের প্রতিক্রিয়ায় বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সাংবাদিকদের বলেন, “নির্বাচনের আগে দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া নির্বাচন করতে পারবেন না- বলে দেয়া এই রায় দেশের মানুষ মেনে নেবে না। আমরা এই রায়ের তীব্র প্রতিবাদ করি।”
তিনি বলেন, “এই রায়ের মাধ্যমে সরকারের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটেছে।”
মির্জা ফখরুল বলেন, “শুধুমাত্র বিএনপিকে, ঐক্যফ্রন্টকে প্রতিহত করতে এই রায় ঘোষণা করা হয়েছে। এই রায় দেশের মানুষ মেনে নেবে না।”
উচ্চ আদালতে আপিল করবে বিএনপি
দুর্নীতি দমন কমিশনের আইনজীবী খুরশীদ আলম খান সাংবাদিকদের বলেন, “আদালত তাঁর পর্যবেক্ষণে বলেছেন, সংবিধানের ৬৬ (২) (ঘ) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী কারও দুই বছরের বেশি সাজা বা দণ্ড হলে সেই দণ্ড বা সাজার বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে আপিল বিচারাধীন থাকা অবস্থায় তিনি নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন না, যতক্ষণ না আপিল বিভাগ ওই রায় বাতিল বা স্থগিত করে তাঁকে জামিন দেয়।”
সংবিধানের ৬৬ (২) (ঘ) অনুচ্ছেদে বলছে, “নৈতিক স্খলনজনিত কোনো ফৌজদারি অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হয়ে কেউ অন্যূন দুই বছরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত হলে মুক্তির পর পাঁচ বছর পর্যন্ত তিনি সাংসদ নির্বাচিত হওয়ার যোগ্য বিবেচিত হবেন না।”
এক প্রশ্নের জবাবে খুরশীদ আলম বলেন, “এখন পর্যন্ত হাই কোর্ট বিভাগ যে ব্যাখ্যা দিয়েছে, সংবিধানের ১১১ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী এটা নির্বাচন কমিশনের জন্য বাইন্ডিং। আজকে যে পর্যবেক্ষণ দিয়েছে তার বাইরে যাওয়ার এখতিয়ার নির্বাচন কমিশনের আইনে নেই।”
মঙ্গলবারের এই রায়ের পর বিএনপি প্রধান খালেদা জিয়া নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন কি না এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “একদম থাকছে না। উনি সম্পূর্ণ খালাস পেলে অথবা দণ্ড বাতিল হয়ে গেলে, তখন উনি পারবেন। আজকের আদেশে এটা আরও স্পষ্ট হলো।”
বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ও বিএনপি নেতা জয়নুল আবেদীন বেনারকে বলেন, দেখুন নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা প্রসঙ্গে সাবেক প্রধান বিচারপতি মোস্তফা কামাল তাঁর পর্যবেক্ষণে বলেছেন নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা একজন মানুষের সাংবিধানিক অধিকার।
আর আপিল বিভাগের রায় না হওয়া পর্যন্ত কোনো সাজা চূড়ান্ত নয়।
তিনি বলেন, আবার গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশে বলা আছে যে দণ্ডিত হলে নির্বাচনে অংশ নিতে পারবে না।
সুতরাং, “আমি মনে করি আপিল বিভাগের রায় না হওয়া পর্যন্ত একজন মানুষকে দণ্ডিত বলা যাবে না। তিনি নির্বাচন করতে পারবেন।”
তিনি বলেন, “আমরা আপিল বিভাগে এই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করব।”
রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক ড. নিজাম উদ্দিন আহমেদ বেনারকে বলেন, আসলে দুই জোটের প্রার্থিতা ঘোষণা দেখে মনে হচ্ছে একটি প্রতিযোগিতামূলক নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।
তিনি বলেন, “বিএনপির মনোনয়ন ঘোষণার মাধ্যমে বোঝা যাচ্ছে যে তারা নির্বাচনের ব্যাপারে সিরিয়াস। খালেদা জিয়া ছাড়াই তাদের নির্বাচনে যেতে হবে। আসলে সত্য বলতে কি, বিএনপির নির্বাচনে অংশগ্রহণ ছাড়া কোনো ভালো পথ খোলা নেই।”