মনোনয়ন বাতিলের আশঙ্কা নিয়েও তিন আসনে প্রার্থী খালেদা জিয়া
2018.11.28
ঢাকা
ঘোষিত তফসিল অনুযায়ী একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রার্থীদের মনোনয়ন জমা দেওয়ার সময় শেষ হয়েছে বুধবার। একই দিনে দুই বছরের বেশি দণ্ডপ্রাপ্তদের নির্বাচনে অংশগ্রহণ ঠেকিয়ে দেওয়া উচ্চ-আদালতের আদেশ বহাল রেখেছে আপিল বিভাগ।
এর ফলে মনোয়ন বাতিলের সম্ভবনা থাকলেও শেষ দিনে তিনটি আসনে কারাবন্দী বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার মনোনয়নপত্র জমা দেওয়া হয়েছে।
সাবেক নির্বাচন কমিশনার সাখাওয়াত হোসেন বেনারকে বলেন, “নির্বাচন কমিশন (ইসি) যে কোনও ব্যক্তির মনোনয়নপত্র গ্রহণ করতে বাধ্য। যাচাইয়ের সময় তারা প্রত্যেক প্রার্থীর যোগ্যতা পরীক্ষা করবে।”
“আদালতের আদেশ কমিশন পৌঁছালে, দুই বছরেরও বেশি সময় ধরে দোষী সাব্যস্ত প্রার্থীদের মনোনয়নপত্র বাতিল করা হবে,” যোগ করেন তিনি।
ইসির যুগ্ম-সচিব (জনসংযোগ) এসএম আসাদুজ্জামান আরজু বেনারকে জানান, ইসি এখনও আদালতের আদেশের কপি পায়নি।
“তবে এটুকু বলতে পারি যে ইসি আদালতের আদেশ অনুযায়ী কাজ করবে,” বলেন এই কর্মকর্তা।
বিএনপির চেয়ারপারসনের মিডিয়া উইংয়ের কর্মকর্তা শায়রুল কবির খান বেনারকে বলেন, “তিনটি আসনেই ম্যাডামের (খালেদা) ‘বিকল্প প্রার্থী’ হিসেবে তিনজন বিএনপি নেতা মনোনয়নপত্র দাখিল করেছেন।”
ফেনী-১ (পরশুরাম, ফুলগাজী, ছাগলনাইয়া) আসনে দলের স্থায়ী কমিটির নজরুল ইসলাম খান, বগুড়া-৬ (সদর) আসনে মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এবং বগুড়া-৭ (শাজাহানপুর-গাবতলী) আসনে স্থানীয় বিএনপি নেতা মোরশেদ মিল্টনকে খালেদা জিয়ার বিকল্প প্রার্থী হিসেবে রাখা হয়েছে বলে জানান তিনি।
নিম্ন আদালতে কোনো ব্যক্তি দুই বছরের বেশি দণ্ডপ্রাপ্ত হলে তিনি নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন না বলে মঙ্গলবার উচ্চ-আদালতের দেওয়া আদেশ বহাল রেখেছে প্রধান বিচারপতি নেতৃত্বাধীন সাত বিচারকের আপিল বেঞ্চ।
তাঁরা এ সংক্রান্ত আবেদনের শুনানি শেষে ‘নো অর্ডার’ দিয়েছেন বলে সাংবাদিকদের জানান রাষ্ট্রের প্রধান কৌসূলী মাহবুবে আলম। তিনি বলেন, “আপিল বিভাগ কোনো আদেশ না দেওয়ার কারণে হাইকোর্ট বিভাগের আদেশটি বহাল আছে।”
এর ফলে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াসহ দুই বছরের বেশি সাজায় দণ্ডিত কারও আসন্ন নির্বাচনে অংশ নেওয়ার সুযোগ থাকছে না বলে জানান দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) আইনজীবী খুরশীদ আলম খান।
সাংবাদিকদের তিনি বলেন, “ইসি আদালতের এ আদেশ মানতে বাধ্য।”
তবে আপিলকারী বিএনপি নেতা জাহিদ হোসেনের আইনজীবী খায়রুল আলম চৌধুরীর দাবি, “দণ্ডিতরা নির্বাচন করতে পারবে কি না- সেটা এখন নির্ভর করছে রিটার্নিং কর্মকর্তার ওপর।”
যদিও মাহবুবে আলম বেনারকে বলেন, “মুক্তি লাভের পরও নির্বাচনের অংশ নেওয়ার জন্য তাঁকে পাঁচ বছর অপেক্ষা করতে হবে।”
সংবিধানের ৬৬ (২) (ঘ) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, “নৈতিক স্খলনজনিত কোনো ফৌজদারি অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হয়ে কেউ অন্যূন দুই বছরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত হলে মুক্তির পর পাঁচ বছর পর্যন্ত তিনি সাংসদ নির্বাচিত হওয়ার যোগ্য বিবেচিত হবেন না।”
এই অনুচ্ছেদের বরাত দিয়ে মঙ্গলবার উচ্চ-আদালতের পর্যবেক্ষণে বলা হয়, দুই বছরের বেশি সাজা বা দণ্ড হলে সেই দণ্ড বা সাজার বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে আপিল বিচারাধীন থাকা অবস্থায় কেউ নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন না, যতক্ষণ না আপিলে ওই দণ্ড বাতিল বা স্থগিত হয়।
ষড়যন্ত্র হিসেবে দেখছে বিএনপি
আপিল বিভাগ এই আদেশ বহাল রাখার কারণে দুই দুর্নীতি মামলায় ১৭ বছরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার নির্বাচনে অংশ নেওয়ার পথ আটকে গেছে।
এ ব্যাপারে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল বলেন, “আমি গতকালই (মঙ্গলবার) বলেছি, বাংলাদেশের জনগণ এ রায়, এ আদেশ মানবে না, মানে না, গ্রহণ করে না।”
সৈয়দপুর বিমানবন্দরে সাংবাদিকদের তিনি আরো বলেন, “বিএনপিকে, খালেদা জিয়াকে রাজনীতি থেকে দূরে রাখার ষড়যন্ত্র শুরু হয়েছে। তারই অংশ হিসেবে এ আদেশ, এ রায় হয়েছে।”
অন্যদিকে রাজধানীর নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলন ডেকে দলের সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবীর রিজভী আহমেদ বলেন, “আপিল বিভাগের রায় আছে, নির্বাচনী তফসিল ঘোষণার পর কে যোগ্য বা অযোগ্য সেটা ঠিক করবে ইসি।”
“অ্যাটর্নি জেনারেল (প্রধান কৌসূলী) যা বলেছেন, তা ঘোড়ার আগে গাড়ি জুড়ে দেয়ার শামিল,” বলেন তিনি।
রিজভী মনে করেন, “আপিল বিভাগের রায় অনুযায়ী যেকোনো রিটার্নিং অফিসার বেগম খালেদা জিয়ার তিনটি মনোনয়নপত্রই বৈধ বলে ঘোষণা দিতে পারেন। আইনে তাতে কোনো বাধা নেই।”
ইসির অতিরিক্ত সচিব মোখলেছুর রহমান বেনারকে বলেন, “রিটার্নিং অফিসার কারো প্রার্থীতা বাতিল করলে তিনি ইসিতে আপিল করতে পারবেন। ডিসেম্বরের ৩, ৪ ও ৫ তারিখ আপিল করা যাবে।”
এর আগে মনোয়নপত্র বাছাই শেষে ২ ডিসেম্বরই অযোগ্য প্রার্থীদের মনোনয়ন বাতিল ঘোষণা করা হবে। এছাড়া ৯ ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রার্থীতা প্রত্যাহার করা যাবে।
“ইসি আপিল খারিজ করে দিলেও প্রার্থীদের উচ্চ-আদালতের দারস্থ হওয়ার সুযোগ থাকবে,” উল্লেখ করেন মোখলেছুর।
তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল মনে করেন, বর্তমান সরকারের শাসনামলে বিচার বিভাগের সক্ষমতা নিয়ে জনমনে অজস্র প্রশ্ন তৈরি রয়েছে।
“যদি কেউ মনে করে এই সরকার বিচার বিভাগকে স্বাধীনভাবে কাজ করতে দিচ্ছে না, তাঁর ধারণাটি সহজে বাতিল করে দেওয়া যাবে না” বেনারকে বলেন তিনি।
প্রার্থী হচ্ছেন না কামাল হোসেন
এদিকে শেষ দিনে ঢাকা বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয়ে মনোনয়নপত্র দাখিল করতে এসে গণফোরামের নির্বাহী সভাপতি ও ঐক্যফ্রন্টের নেতা সুব্রত চৌধুরী সাংবাদিকদের জানান, ড. কামাল হোসেন একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী হচ্ছে না।
এইদিন সাবেক রাষ্ট্রপতি ও জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের পক্ষে ঢাকা-১৭ ও রংপুর-৩ আসনে মনোনয়নপত্র দাখিল করা হয়। এর আগের দিন গোপালগঞ্জ-৩ ও রংপুর-৬ আসনে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পক্ষে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন দলীয় নেতারা।
শেষ দিনে দেশের সবগুলো রিটার্নিং বা সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তাদের কার্যালয়েই ভিড় ছিল প্রার্থীদের। বিকেল পাঁচটা অবধি মনোনয়নপত্র সংগ্রহ ও তা পূরণ করে জমা দেওয়া গেছে।
এদিকে নির্বাচন কমিশনের সচিব হেলালুদ্দীন আহমদ ঢাকায় সাংবাদিকদের জানান, রাত সাড়ে আটটা পর্যন্ত সারাদেশে ৩ হাজার ৫৬টি মনোনয়নপত্র জমা পড়েছে।
তবে এই সংখ্যা আরও কিছু বাড়তে পারে বলে জানান তিনি।
এবারই প্রথমবারের মতো অনলাইনে মনোনয়ন জমা দেওয়ার সুযোগ ছিল। মনোনয়নপত্র জমা দিলেও নির্বাচনি আচরণবিধি অনুযায়ী ১০ ডিসেম্বর প্রতীক বরাদ্দের আগে প্রার্থীরা প্রচারণা চালাতে পারবেন না।