জাতীয় নির্বাচন: বিদ্রোহে নাকাল সরকার ও বিরোধী জোট

কামরান রেজা চৌধুরী
2018.11.30
ঢাকা
181130_Politics-1000.jpg ঢাকায় মনোনয়নপত্র জমা দিচ্ছেন আওয়ামী লীগের একজন প্রার্থী। ২৮ নভেম্বর ২০১৮।
[বেনারনিউজ]

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মনোনয়ন ঘিরে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন জোটে এবং বিএনপি ও তার মিত্রদের মধ্যে শুরু হয়েছে টানাপোড়েন।

জোটগতভাবে নির্বাচন করতে রাজি আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টি। তবে আওয়ামী লীগ জাতীয় পার্টির প্রত্যাশিত অনেক আসনেও প্রার্থী দিয়েছে।

আবার জাতীয় পার্টির প্রার্থী দেওয়ায় মনোনয়ন বঞ্চিত হয়েছেন আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতারা। এ নিয়ে এলাকায় চলছে বিক্ষোভ-সমাবেশ।

ড. কামালের নেতৃত্বাধীন জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট ও ২০-দলীয় জোটের প্রধান শরিক বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) সাথেও মতবিরোধ ছোট দলগুলোর। বিশেষ করে জামায়াতে ইসলামীকে নিয়ে বেকায়দায় পড়েছে বিএনপি।

দলীয় অথবা জোটগত সিদ্ধান্ত মানতে না পেরে অনেকেই স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে নির্বাচন করার ঘোষণা দিয়েছেন। নির্বাচন কমিশনের তথ্য অনুসারে, এবার মোট ৩ হাজার ৬৫ জন প্রার্থী মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন, যার মধ্যে ৪৯৮ জন স্বতন্ত্র প্রার্থী।

স্বতন্ত্রদের বেশিরভাগই আওয়ামী লীগ বা বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোট থেকে মনোনয়ন পাননি।

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ৩০০ সংসদীয় আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগ ২৬৪ আসনে ২৮১ প্রার্থী দিয়েছে; বাকি ৩৬ আসনে কোনো প্রার্থী নেই দলটির।

অপরদিকে ২৯৫ আসনে ৬৯৬ প্রার্থী দিয়েছে বিএনপি।

রাজনৈতিক বিশ্লেষক ড. নিজাম উদ্দিন আহমেদ বেনারকে বলেন, “দেখা যায়, দলগুলো স্থানীয় নেতা–কর্মীর মতামত উপেক্ষা করে প্রার্থী দিলে বিদ্রোহের ঘটনা ঘটে। যদিও বিদ্রোহী প্রার্থী নির্বাচিত হয়ে আসলে তাঁকে সেই দলে ফিরিয়ে নেওয়ার রেওয়াজ আছে।”

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মাহবুবুর রহমান বেনারকে বলেন, “কথা সত্য, আমাদের দলে মনোনয়ন নিয়ে স্থানীয় বিরোধ রয়েছে। বিশেষ করে কিছু কিছু আসনে জামায়াতের সাথে আমাদের বিরোধ রয়েছে।”

“তবে শেষ পর্যন্ত জামায়াত আমাদের সাথেই থাকবে; তাদের ভোট আমাদের দরকার আছে”, তিনি বলেন।

মাহবুবুর রহমান বলেন, “তবে আমি মনে করি, আমাদের চেয়ে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব বেশি।”

সাবেক চিফ হুইপ উপাধক্ষ আব্দুস শহীদ বেনারকে বলেন, “আওয়ামী লীগ একটি বড় দল এবং গত দুই মেয়াদে ক্ষমতাসীন। শেখ হাসিনার দৃঢ নেতৃত্বের কারণে দেশবাসী মনে করে আগামীতে আমরা আবার ক্ষমতায় আসব। সে কারণেই অনেকেই আওয়ামী লীগ এবং তার মিত্রদের মনোনয়ন পেতে সাধ্যমতো চেষ্টা করছে।”

তিনি বলেন, “তবে আমরা বিশ্বাস করি, যারা বিদ্রোহী প্রার্থী হয়েছেন তাঁরা তাঁদের মনোনয়ন প্রত্যাহার করে নেবেন এবং দলীয় ও জোটের প্রার্থীদের হয়ে কাজ করবেন।”

আওয়ামী জোটে বিদ্রোহ

মনোনয়কে কেন্দ্র করে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোটের প্রধান মিত্র জাতীয় পার্টির সাথে চলছে টানাপোড়েন।

দলের অন্যতম কো-চেয়ারম্যান ও এইচ এম এরশাদের ছোট ভাই জিএম কাদের বেনারকে বলেন, আসন বণ্টনের ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে মহাজোট কার্যকর নেই। কারণ যেখানে জাতীয় পার্টির এমপি আছে সেই আসনে আওয়ামী লীগ প্রার্থী দিয়েছে।

তিনি বলেন, আবার অনেক আসনে আওয়ামী লীগ মনোনয়ন না দিলেও আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থীরা মনোনয়নপত্র দাখিল করেছেন।

জিএম কাদের বলেন, “আমাদের ঠিক কতগুলো আসন দেয়া হচ্ছে সেব্যাপারে আমি এখন পর্যন্ত নিশ্চিত নই।”

সংঘাতপূর্ণ মনোনয়ন

আওয়ামী লীগের মনোনয়ন ফরম কেনা প্রার্থীদের উদ্দেশ্যে বক্তব্য রাখতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, দল ও জোটের প্রার্থীদের বিরুদ্ধে কেউ কাজ করলে দল থেকে আজীবনের জন্য বহিষ্কার করা হবে।

তবে মনোনয়ন না পেয়ে সেই হুঁশিয়ারি উপেক্ষা করে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন অনেকে।

যেমন বহিস্কারাদেশ উপেক্ষা করে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসাবে মনোনয়নপত্র দাখিল করেছেন রাজশাহীর দুই আওয়ামী লীগ নেতা তাজুল ইসলাম মোহাম্মদ ফারুক ও মেরাজ উদ্দিন মোল্লাহ।

ফারুক রাজশাহীর পুঠিয়া-দুর্গাপুর আসনে মনোনয়ন চেয়েছিলেন। তিনি ১৯৯১ সালে ওই এলাকা থেকে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হয়ে জয় লাভ করেন। ২০১৪ সালে তাঁকে মনোনয়ন না দিয়ে দেয়া হয় আব্দুল ওয়াদুদকে।

এবার ওয়াদুদ ও ফারুক দুজনের কাউকেই মনোনয়ন দেয়নি আওয়ামী লীগ। দলীয় মনোনয়ন পেয়েছেন, জেলা আওয়ামী লীগের স্বাস্থ্য বিষয়ক সম্পাদক ডা. মনসুর রহমান।

তাই তাজুল ইসলাম মোহাম্মদ ফারুক স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন।

রাজশাহীর পবা-মোহনপুর আসনে মেরাজ ‍উদ্দিন মোল্লা দলীয় মনোনয়ন না পেয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে নির্বাচন করার জন্য মনোনয়ন ফরম জমা দিয়েছেন।

নবম সংসদে নির্বাচিত হলেও দশম সংসদ নির্বাচনে মনোনয়ন পাননি মেরাজ মোল্লা। মনোনয়ন পান আয়েন উদ্দিন। এবার পুনরায় আয়েন উদ্দিনকে মনোনয়ন দিয়েছে আওয়ামী লীগ।

মনোনয়ন না পেয়ে তিনি স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে নির্বাচন করতে মনোনয়ন ফরম জমা দিয়েছেন।

পটুয়াখালী-১ আসনে জাতীয় পার্টির মহাসচিব রুহুল আমিন হাওলাদারকে মহাজোট থেকে মনোনয়ন দেয়া হয়েছে। কিন্তু সাবেক ধর্ম প্রতিমন্ত্রী শাহজাহান মিয়াকে প্রার্থী করার দাবিতে বিক্ষোভ–সমাবেশ করে চলেছে স্থানীয় আওয়ামী লীগে।

আওয়ামী লীগের মনোনয়ন না পেয়ে মৌলভীবাজার জেলার কুলাউড়া আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে নির্বাচন করবেন বলে ঘোষণা দিয়েছেন বর্তমান সাংসদ আব্দুল মতিন। জাতীয় পার্টির প্রধান এইচ এম এরশাদের রংপুর-৩ আসনে মনোনয়নপত্র দাখিল করেছেন আওয়ামী লীগের নেতা মমতাজউদ্দীন আহমেদ।

কুড়িগ্রাম-১ আসনে বর্তমান এমপি মোস্তাফিজুর রহমানের আসনে মনোনয়ন পেয়েছেন আওয়ামী লীগের আছলাম হোসেন সওদাগর। কুড়িগ্রাম-৩ আসনে জাতীয় পার্টির আক্কাস আলীর আসনে মনোনয়ন পেয়েছেন আওয়ামী লীগের এম এ মতিন। কুড়িগ্রাম-৪ আসনের এমপি রুহুল আমিন। সেখানে আওয়ামী লীগ মনোনয়ন দিয়েছে জাকির হোসেনকে।

ঢাকার দোহার আসনে জাতীয় পার্টির সালমা ইসলামের আসনে মনোনয়ন পেয়েছেন আওয়ামী লীগের সালমান এফ রহমান।

জাতীয় পার্টির সাংসদ সালাউদ্দীন আহমেদ মুক্তির ময়মনসিংহ-৫ আসনে আওয়ামী লীগ মনোনয়ন দিয়েছে কেএম খালিদ বাবুকে। জাতীয় পার্টির এম এ হান্নানের ময়মনসিংহ-৭ আসনে মনোনয়ন দেয়া হয়েছে আওয়ামী লীগের রুহুল আমিন মাদানীকে।

জাতীয় পার্টির সেলিম উদ্দিনের সিলেট-৫ আসনে হাফিজ আহমেদ মজুমদারকে মনোনয়ন দিয়েছে আওয়ামী লীগ। পঞ্চগড়ের তেতুলিয়া আসনের বর্তমান সাংসদ জাসদের নাজমুল হক প্রধান এবার মনোনয়ন পাননি। তাঁর পরিবর্তে মনোনয়ন দেয়া হয়েছে মজাহারুল হক প্রধানকে।

দলীয় এই সিদ্ধান্তকে মানতে না পেরে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে ভোট করার জন্য মনোনয়নপত্র তুলেছেন নাজমুল হক প্রধান।

তিনি বেনারকে বলেন, “আমি এলাকায় ব্যাপক উন্নয়ন করেছি। জনগণের সাথে কাজ করেছি। আমি স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে ভোট করব।”

বিএনপি জোটে বিদ্রোহ

রাজনৈতিক মিত্র জামায়াতে ইসলামীর সাথে আসন বণ্টন নিয়ে টানাপোড়েন চলছে বিএনপির। বিএনপি জামায়াতকে ২৫টি আসনে মনোনয়ন দিয়েছে। তবে তারা কমপক্ষে ৪০টি আসন চায়।

জামায়াত পিরোজপুরে দেলোয়ার হোসেন সাঈদীর আসন এবং চাপাই নবাবগঞ্জ-৩ আসনটি চায়। এই দুটি আসনসহ অনেক জামায়াত নেতা অনেক আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে ফরম তুলেছেন।

এই ইস্যুতে বিএনপি এবং জামায়াতের মধ্যে মনকষাকষি চললেও দল দুটির নেতারা মুখ খুলতে চান না। চলছে সমঝোতার চেষ্টা।

তবে বিএনপির এক কেন্দ্রীয় নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বেনারকে বলেন, “জামায়াতের আসন সংখ্যা ২৫ থেকে আরও কমতে পারে। কারণ, জামায়াত বিএনপি জোট ছেড়ে যেতে পারবে না। ইতিমধ্যে দলটির নিবন্ধন বাতিল করেছে নির্বাচন কমিশন।”

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।