সংসদ নির্বাচন: শুরু হলো আনুষ্ঠানিক প্রচার

কামরান রেজা চৌধুরী
2018.12.10
ঢাকা
181210_Election_1000.jpg ঢাকা–৮ আসনে সমাজকল্যাণমন্ত্রী এবং ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেননের পক্ষে নির্বাচনী প্রচারণা। ১০ ডিসেম্বর ২০১৮।
[জেসমিন পাপড়ি/বেনারনিউজ]

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আনুষ্ঠানিক প্রচার-প্রচারণা শুরু হয়ে গেছে সোমবার। মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের শেষ সময় পার হওয়ার পরদিনই ৩০ ডিসেম্বরের সাধারণ নির্বাচনকে সামনে রেখে মাঠে নেমে পড়েছেন প্রার্থীরা। পোস্টারে ছেয়ে যাচ্ছে দেশ। স্লোগানে মুখর হয়ে উঠছে প্রতিটি জনপদ।

সংসদ নির্বাচনে দায়িত্বপ্রাপ্ত জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটদের উদ্দেশ্য করে খোদ প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কেএম নুরুল হুদা বলেছেন, “আজ (সোমবার) থেকে নির্বাচনী ‘ডামাডোল’ শুরু হয়েছে।”

বিশ্লেষকদের দাবি, এর মাধ্যমে সকল দলের অংশগ্রহণে একটি জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পথ সুগম হলো। ৪৫ বছর পর একটি নির্বাচনে রাজনৈতিক সরকারের অধীনে সবগুলো প্রধান দল সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে যাচ্ছে।

১৯৭৩ সালের প্রথম সংসদ নির্বাচনের পর দেশে এমনটি আর ঘটেনি।

রাজনৈতিক বিশ্লেষক ড. নিজাম উদ্দিন আহমেদ বেনারকে বলেন, “এই নির্বাচন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষভাবে করা গেলে রাজনৈতিক সরকারের অধীনে একটি সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্ভব সেটি প্রমাণিত হবে। এ জন্য নির্বাচন কমিশন, সরকার, সকল রাজনৈতিক দলের দায়িত্ব রয়েছে।”

এ ব্যাপারে ম্যাজিস্ট্রেটদের সিইসি বলেন, “আপনারা সাংবিধান ও আইনের ভিত্তিতে দায়িত্ব পালন করবেন। আপনি স্বাধীন, আপনি নিরপেক্ষ, আপনি বিচারক, বিচারকের মাইন্ড আপনাকে অ্যাপ্লাই করতে হবে।”

বিশ্লেষকদের ধারণা, প্রধান বিরোধী দল বিএনপি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার কারণে দেশের মানুষের মধ্যে নির্বাচনী আমেজ বিরাজ করছে। তবে সাধারণ মানুষের মধ্যে এখনও এই প্রশ্ন রয়ে গেছে, শেখ হাসিনার দলীয় সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে কিনা।

“মাগুরা উপনির্বাচনে ‘কারচুপির’ অভিযোগে তত্বাবধায়ক ব্যবস্থার দাবি করে আওয়ামী লীগ এবং তাদের আন্দোলনের কারণেই সংবিধানে তত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা চালু হয়। আবার আওয়ামী লীগের সময়ই তত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল হয়,” বলেন ড. নিজাম।

তবে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক খালিদ মাহমুদ চৌধুরী বেনারকে বলেন, “শেখ হাসিনার অধীনেই সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব—সেটি আমরা প্রমাণ করব। সরকার নির্বাচনী ব্যবস্থায় কোনো হস্তক্ষেপ করবে না।”

রাত দশটায় শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত ৩০০টি সংসদীয় আসনের এই নির্বাচনে ৩৯টি দলের প্রায় ১৮০০ জন প্রার্থী অংশগ্রহণ করছেন।

এবারের নির্বাচনে মোট ভোটার সংখ্যা ১০ কোটি ৪১ লাখ, ৯০ হাজার ৫৭৩ জন। এর মধ্যে পুরুষ ভোটার ৫ কোটি, ২৫ লাখ ৪৭ হাজার ২৯৪ জন এবং নারী ভোটার রয়েছেন ৫ কোটি ১৬ লাখ, ৪৩ হাজার ২৭৯ জন।

আশাবাদী বিএনপি, প্রত্যয়ী আওয়ামী লীগও

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মাহবুবুর রহমান বেনারকে বলেন, “দেশের মানুষ বিএনপিকে ভোট দেয়ার জন্য উন্মুখ হয়ে আছে। আমরা ৩০০ আসনের মধ্যে ২৪০ আসনে প্রার্থী দিয়েছি। বাকি ৬০ আসন আমাদের শরিকদের জন্য ছেড়ে দিয়েছি।”

“কারচুপি না হলে বিরোধীদলীয় জোটের (ঐক্যফ্রন্ট) জয় সুনিশ্চিত,” উল্লেখ করে তিনি জানান, নির্বাচনী প্রচার শুরু করে দিয়েছে তাদের নেতাকর্মীরা। তবে বেশ কিছু প্রার্থী তাঁদের প্রার্থিতা নিশ্চিত করতে এখনো আদালত চত্বরে ঘোরাঘুরি করছেন।

নির্বাচন কমিশনের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে গিয়ে সোমবার প্রার্থিতা ফিরে পেয়েছেন সাবেক প্রতিমন্ত্রী ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু ও সাবেক উপমন্ত্রী রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলু। বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার প্রার্থীতার বৈধতা আদায়েরও চেষ্টা করা হচ্ছে।

অন্যদিকে “শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দেশে উন্নয়নের যে ধারা পরিচালিত হচ্ছে, জনগণ তার সাথে আছে,” দাবি করে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক খালিদ মাহমুদ চৌধুরী বেনারকে বলেন, “দেশের জনগণ আমাদের জয়ী করবে।”

তিনি জানান, আওয়ামী লীগ ২৫৮ আসনে প্রার্থী দিয়েছে। বাকি ৪২ আসন জাতীয় পার্টিসহ ‍মহাজোটের দলগুলোকে দেওয়া হয়েছে।

সোমবার ধানমন্ডি কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে দলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর কবির নানক বলেন, আগামী ১২ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা টুঙ্গিপাড়ায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মাজার জিয়ারত করবেন। সেখানে তিনি একটি জনসভায়ও বক্তৃতা করবেন।

“এরপর দুপুরে কোটালীপাড়ায় এক বিশাল জনসভায় বক্তৃতা দেওয়ার মধ্যে দিয়েই নির্বাচনী প্রচার শুরু করবেন,” বলেন এই আওয়ামী লীগ নেতা।

ফিরে দেখা : সংসদ নির্বাচনের ইতিহাস

১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালে বাংলাদেশের জন্য একটি নতুন সংবিধান প্রণীত হয়। সেই সংবিধান অনুসারে ১৯৭৩ সালের মার্চে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সরকারের অধীনে প্রথম সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।

সেই নির্বাচনে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর সে বছর ৩ নভেম্বর সামরিক শাসন জারি হয় এবং বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেন। পরে তিনি নিজেকে রাষ্ট্রপতি হিসাবে ঘোষণা করেন।

১৯৭৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে জেনারেল জিয়াউর রহমানের অধীনে দ্বিতীয় সাধারণ নির্বাচনে তখনকার বিরোধীদল আওয়ামী লীগসহ সকল বড় রাজনৈতিক দল অংশগ্রহণ করে। ওই নির্বাচনে নব গঠিত বিএনপি নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে।

১৯৮২ সালের মার্চে রক্তপাতহীন অভ্যুত্থানের মাধ্যমে জেনারেল এইচ এম এরশাদ ক্ষমতা গ্রহণ করার প্রায় চার বছর পর ১৯৮৬ সালে দ্বিতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি অংশগ্রহণ করেনি। সেই নির্বাচনে এরশাদের নব গঠিত জাতীয় পার্টি একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে।

তবে নির্বাচনের দুই বছরের কম সময়ে আওয়ামী লীগ পদত্যাগ করলে সংসদ ভেঙ্গে যায়। পরবর্তীতে ১৯৮৮ সালে এরশাদ সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত চতুর্থ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি ও আওয়ামী লীগ অংশগ্রহণ করেনি।

১৯৯০ সালের ডিসেম্বর মাসে গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে এরশাদের পতনের পর ১৯৯১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে সব দলের অংশগ্রহণে পঞ্চম সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় বিচারপতি শাহাবুদ্দিন আহমেদের তত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে।

ওই নির্বাচনে বিএনপি সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে সরকার গঠন করে।

১৯৯৪ সালে মাগুরা সদর আসনের উপনির্বাচনে বিএনপি দলীয় প্রার্থীকে কারচুপির মাধ্যমে জেতানো হয় বলে আওয়ামী লীগ অভিযোগ করে।

‘বিএনপি সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়’-এই অভিযোগে সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তনের দাবি তোলে আওয়ামী লীগ। ক্ষমতাসীন বিএনপি ওই দাবি নাকচ করে দেয়।

সাংবিধানিক ধারা রক্ষা করতে ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি আয়োজিত সংসদ নির্বাচন আওয়ামী লীগ ও জামায়াতে ইসলামী বয়কট করে।

এরপর বিএনপির বিরুদ্ধে কঠোর আন্দোলন গড়ে তুললে বিএনপি সরকার পদত্যাগ করার আগে সংবিধানে সকল সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তন করে।

১৯৯৬ সালের ১২ জুন বিচারপতি হাবিবুর রহমানের নেতৃত্বে গঠিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জয়লাভ করে। ২০০১ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে সকল দলের অংশগ্রহণে অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে বিএনপি জয়লাভ করে।

তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে সকল দল অংশগ্রহণ করে। আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করে।

২০১১ সালে সংবিধান থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল হয়ে গেলে সংসদ নির্বাচন রাজনৈতিক সরকারের অধীনে করার বিধান পুনঃপ্রবর্তিত হয়। বিএনপি তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনঃপ্রবর্তনের দাবিতে আন্দোলন গড়ে তোলে।

তারা ২০১৪ সালে শেখ হাসিনার অধীনে সংসদ নির্বাচন বয়কট করে।

তবে এবার তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়াই জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের ব্যানারে বিএনপিসহ সম্মিলিত বিরোধী দল আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোটের বিপক্ষে লড়ছে।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।