নির্বাচনের আগে একের পর এক ফোনালাপ ফাঁস
2018.12.27
ঢাকা

একাদশ জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে বাংলাদেশের গণমাধ্যমগুলোয় একের পর এক সূত্রবিহীন ফোনালাপ ফাঁস হচ্ছে। যার অধিকাংশই প্রধান বিরোধী দল বিএনপির প্রার্থী এবং সমমনা দলগুলোর নেতাদের কথোপকথন।
এ প্রসঙ্গে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের যোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক আলী আর রাজি বেনারকে বলেন, “সূত্রহীন সংবাদ প্রকাশ যদি করতেই হয়, তবে আগে দেখতে হবে সেটি কতটা জনস্বার্থের জন্য করা হচ্ছে।”
তবে “জাতীয়তাবাদী রাজনীতি যারা করেন তাদের খানিকটা হেনস্থা এবং জাতির সামনে বিব্রত করতে এমনটা করা হচ্ছে” মন্তব্য করে বিএনপি চেয়ারপারসনের প্রেস উইং সদস্য শামসুদ্দিন দিদার বৃহস্পতিবার বেনারের কাছে দাবি করেন, “সরকারের পক্ষ থেকে সুপরিকল্পিতভাবে বিভ্রান্তি ছড়ানো হচ্ছে।”
এদিকে “সরকারের কাছে যে কারো ফোনালাপ থাকে; এটা আইনসিদ্ধ বিষয়,” বলে বেনারের কাছে মন্তব্য করেন সদ্য সাবেক ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তিমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার।
তাঁর দাবি, “আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ফোনালাপ তদারক করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়। টেলিযোগাযোগ আইন ও ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে তাদের এই ক্ষমতা দেওয়া আছে।”
তবে এভাবে গোপনীয়তা ফাঁস নাগরিকের মৌলিক অধিকার হরণ বলে মনে করছেন বিশ্লেষকেরা।
“প্রতিটি ব্যক্তির একান্ততা রক্ষার নিশ্চয়তা রাষ্ট্র দিয়েছে। এটি মৌলিক অধিকার। রাষ্ট্র সেই অধিকার রক্ষা করতে পারছে না। একের পর এক ফোনালাপ ফাঁসের মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রের ব্যর্থতা দৃষ্টিকটুভাবে প্রকট হয়ে উঠছে,” বেনারকে বলেন আলী আর রাজি।
“এই ব্যর্থতা খোদ রাষ্ট্রকেই ভয়ঙ্কর পরিণিতির দিকে ঠেলে দিতে পারে,” বলেন তিনি।
বিষয়টি নিয়ে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) সিনিয়র সহকারী পরিচালক (গণসংযোগ) জাকির হোসেন খান এবং সংস্থার ‘সিস্টেম অ্যান্ড সার্ভিসেস’ বিভাগের উপপরিচালক মো. নাহিদুল হাসানের সাথে যোগাযোগ করা হলেও তাঁরা বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে চাননি।
বাংলাদেশ সংবিধানের ৪৩ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, ব্যক্তিগত তথ্যের সুরক্ষা ও গোপনীয়তা মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃত। তথ্য অধিকার আইনে এর উল্লেখ থাকলেও সেখানে বলা হয়েছে, রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা ও গোয়েন্দা কাজে নিয়োজিত সংস্থার ক্ষেত্রে এই আইন প্রযোজ্য হবে না।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিটিআরসি’র এক কর্মকর্তা বেনারকে জানান, ফোনে আড়িপাতা এবং ইন্টারনেটে নজরদারির জন্য ২০১৩ সালে প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা মহাপরিদপ্তরের (ডিজিএফআই) ভবনে ৪৪ জন জনবল নিয়ে ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেন্টার (এনটিএমসি) যাত্রা শুরু করে।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক সেলিম রেজা নিউটন বেনারকে জানান, গত কয়েক বছরে এই এনটিএমসি প্রকাশ্যেই অনেক আড়িপাতার সরঞ্জাম কিনেছে।
“দুনিয়া জুড়ে গণবিরোধী সরকারগুলোই বেশি বেশি গোয়েন্দা তদারকির যন্ত্রপাতি কেনে এবং ব্যবহার করে। এটা স্বচ্ছ গণতন্ত্রের জন্য উন্নত চর্চা নয়,” বলেন তিনি।
প্রশ্নবিদ্ধ সাংবাদিকতা
ফাঁস হওয়া এসব কথোপকথোন প্রচার নিয়ে বিএনপি চেয়ারপারসনের প্রেস উইং সদস্য শামসুদ্দিন দিদারের অভিমত, নির্বাচনের দোরগোড়ায় এসে এরকম ‘একপেশে’ সংবাদ পরিবেশন করা উচিত না।”
অধ্যাপক নিউটনও মনে করেন, ফোনালাপ ফাঁস কেন এমন ‘একপেশে’ তা গণমাধ্যমে আসা উচিত ছিল।
“তবে গণমাধ্যমের হাতে কোনো তথ্য এলে তারা যদি দেখে তা জাতি বা দেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ এবং মিথ্যা নয়, তা সেটা তারা প্রকাশ করতেই পারে,” বলেন রাবির এই শিক্ষক।
ড. কামাল হত্যার ষড়যন্ত্র
সর্বশেষ বুধবার বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল একাত্তর টিভির ফাঁস করা এক ফোনালাপে জানানো হয়, জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের শীর্ষ নেতা ড. কামাল হোসেনকে লন্ডনে অবস্থানকারী বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান হত্যা পরিকল্পনা করেছেন।
কামালের দল গণফোরামের সাধারণ সম্পাদক মোস্তফা মহসিন মন্টুর সঙ্গে শওকত নামে সিলেটে বসবাসকারী বাংলাদেশ ন্যাশনালিস্ট ফ্রন্টের (বিএনএফ) এক সদস্যের ওই দিন সকাল নয়টায় এ আলাপ হয় বলে জানায় টেলিভিশন চ্যানেলটি।
এরপরই দুপুরে মতিঝিলে ড. কামাল হোসেনের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন পুলিশ কর্মকর্তারা। পরে ড. কামাল সাংবাদিকদের বলেন, “এসব নিয়ে শঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। পুলিশ বলেছে, আমার নিরাপত্তা নিয়ে তারা উদ্বিগ্ন। আমি তাদেরকে বলেছি, আমার নিরাপত্তার প্রয়োজন নেই।”
ফাঁসছে বিএনপি প্রার্থীরাই
এর আগে মঙ্গলবার বরিশাল-৩ আসনে বিএনপির প্রার্থী অ্যাডভোকেট জয়নুল আবেদীন আবুল কালাম নামে এক ব্যক্তির সঙ্গে ফোনালাপে ওসিসহ পুলিশের চার সদস্যকে টাকা দিয়ে আসার কথা বলেন।
সোমবারও বিএনপির দুই প্রার্থীর ফোনালাপ ফাঁস করা হয়। চ্যানেল টুয়েন্টিফোর প্রকাশিত বরিশাল-২ (উজিরপুর-বানারীপাড়া) আসনে বিএনপি প্রার্থী এস সরফুদ্দিন আহমদ সান্টুর ফোনালাপে শোনা যায় তিনি বলছেন, “আমার সামনে যারা পরবে আমি গুলি করে দিব।”
একইদিন সময় টিভিতে নোয়াখালী-১ (চাটখিল ও সোনাইমুড়ীর একাংশ) আসনে বিএনপির প্রার্থী মাহবুব উদ্দিন খোকনের সঙ্গে সোনাইমুড়ি উপজেলা বিএনপির নেতা নুরুন্নবীর কথোপকথন ফাঁস করা হয়। যেখানে মারামারি হবে জানিয়ে ‘লাঠি-সোটা’ প্রস্তুত করতে বলেন খোকন।
শনিবার (২২ ডিসেম্বর) রাজশাহী সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র ও নগর বিএনপির সভাপতি মোসাদ্দেক হোসেন বুলবুলের ফোনালাপের অডিও রেকর্ড সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ফাঁস হয়। ওই আলাপে বুলবুল একজনকে বলছিলেন, “লাঠিসোটা জোগাড় করো, ২৮ তারিখ লাগবে।”
এর আগে বিভিন্ন সময় বিএনপি ও ঐক্যফ্রন্টের বিভিন্ন শীর্ষ নেতার ফোনালাপ ফাঁসের ঘটনা ঘটেছে।
ফোনালাপ ফাঁস প্রসঙ্গে বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন বেনারকে বলেন, “আমি মনে করি, রাষ্ট্রের একটি সংস্থা সংবিধান লঙ্ঘন করছে। আমাদের মৌলিক অধিকার হরণ করা হয়েছে।”
ফাঁস হওয়া নিজের ফোনালাপের ব্যাপারে তিনি বলেন, “আমার ফোনালাপে কোনো ভুল ছিল না। আমি অস্ত্রধারীদের বিরুদ্ধে পুরুষদের লাঠি আর নারীদের ঝাড়ু নিয়ে যেতে বলেছিলাম। ভোটের দিন মানুষকে রক্ষায় এটাই আমার কৌশল।”
“নাগরিকরা কথার মালিকানা নিজেদের হাতেই রাখবে, নাকি বাণিজ্যিক কর্পোরেশন, বিভিন্ন মোবাইল অপারেটর বা সরকারি বিভিন্ন সংস্থার হাতে তুলে দেবে, এটা ঠিক করা দায়িত্ব তাদেরই,” এ প্রসঙ্গে বলেন সেলিম রেজা নিউটন।