নির্বাচনী সহিংসতা নিয়ে দুই দলের পাল্টাপাল্টি অভিযোগ

কামরান রেজা চৌধুরী
2018.12.28
ঢাকা
181228_Election_violence_1000.jpg [নিউজরুম ফটো]
[নিউজরুম ফটো]

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর থেকে সারা দেশে কয়েকশ সহিংস ঘটনা ঘটলেও এ সকল সহিংসতা বন্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে পারেনি নির্বাচন কমিশন। নির্বাচনী প্রচার শেষ হওয়ার দিন শুক্রবার সরকারি দল আওয়ামী লীগ এবং প্রধান বিরোধী দল বিএনপি সহিংসতার জন্য একে অপরকে দায়ী করেছে।

গত ১০ ডিসেম্বর আনুষ্ঠানিক প্রচার শুরুর পর থেকে কয়েক দফায় নির্বাচন কমিশনে এসে সহিংসতার ঘটনার ব্যাপারে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দায়ের করেছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট এবং বিরোধী জোট বিএনপির নেতৃত্বাধীন জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট।

তবে সহিংসতা বন্ধ হয়নি। নির্বাচনের মাত্র একদিন আগে শুক্রবার দুর্বৃত্তদের হামলার শিকার হয়েছেন পটুয়াখালী-৩ আসনের বিরোধী বিএনপি দলীয় প্রার্থী গোলাম মওলা রনি।

৩০ ডিসেম্বর নির্বাচনের ৪৮ ঘন্টা আগে বিএনপির পক্ষ থেকে অভিযোগ করে বলা হয়েছে, ‘পক্ষপাতদুষ্ট’ নির্বাচন কমিশন সেনাবাহিনীকে কাজ করতে দিচ্ছে না।

যথাযথ ব্যবস্থা না নিলে নির্বাচনের দিনে সহিংসতা বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা মানবাধিকার কর্মীদের।

তবে প্রধান নির্বাচন কমিশনার কেএম নুরুল হুদা শুক্রবার বলেছেন, “বিএনপি পক্ষপাতের যে অভিযোগ উত্থাপন করেছে তা ভুল প্রমাণিত হবে এবং উৎসবমূখর পরিবেশে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।”

১০ দিনে ৯৭২ টি সহিংস ঘটনা

নির্বাচন কমিশনের কাছে আসা সহিংসতার অভিযোগগুলো কমিশনের পক্ষ থেকে লিপিবদ্ধ করেছে সংস্থাপন শাখা।

নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বেনারকে বলেন, এ পর্যন্ত প্রায় সাতশ সহিংসতার অভিযোগ এসেছে কমিশনে।

তবে বেসরকারি মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটি একাদশ সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সংঘটিত সহিংসতার ঘটনা সম্পর্কে শুক্রবার প্রকাশিত এক বিবৃতিতে বলেছে, পয়লা ডিসেম্বর থেকে ২৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত সারাদেশে ৯৭২ সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে। এসকল ঘটনার লক্ষ্য ছিল বিরোধীদলের নেতা-কর্মীরা।

এসকল সহিংসতার ঘটনায় বিরোধীজোটের ২,৬২৩ এবং ক্ষমতাসীন মহাজোটের ৫৩৯ জন নেতাকর্মী আহত হয়েছেন। আরও আহত হয়েছেন ২৮ জন পুলিশ ও ২৮ জন সাংবাদিক।

সোসাইটির হিসাবে, এসব সহিংসতায় নিহত হয়েছেন ছয়জন মানুষ। তারা সবাই ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ জোটের। যাদের তিনজন নিহত হয়েছেন দলীয় কোন্দলের কারণে।

সংগঠনটির হিসাবে পাবনায় দুইজন, নোয়াখালী, ফরিদপুর, হবিগঞ্জ ও ময়মনসিংহে একজন করে নিহত হয়েছেন।

হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটির প্রধান নূর খান বেনারকে বলেন, নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা হওয়ার পর থেকে সরকারি বাহিনীর হাতে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন বিরোধী জোটের চারজন এবং গুলিবিদ্ধ হয়েছেন ১৪ জন।

তিনি বলেন, ক্ষমতাসীন মহাজোটের ২৫ জন সরকারি বাহিনীর হাতে গুলিবিদ্ধ হয়েছেন।

নূর খান বলেন, সরকারি বাহিনীর হাতে গ্রেপ্তার হয়েছেন বিএনপির ২,০৬৮ জন, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর ৫২২ জন এবং ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ১১ জন।

নির্বাচনকে সামনে রেখে ঢাকায় সেনাবাহিনীর যানবাহন তল্লাশি। ২৮ ডিসেম্বর ২০১৮।
নির্বাচনকে সামনে রেখে ঢাকায় সেনাবাহিনীর যানবাহন তল্লাশি। ২৮ ডিসেম্বর ২০১৮।
[নিউজরুম ফটো]

বিএনপির অভিযোগপ্রায় তিন হাজার হামলা

শুক্রবার দলীয় কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, “৮ নভেম্বর একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর থেকে ২৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত সারা দেশে ১০ হাজার ৩২৯ জন নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার ও ৮৪৪টি গায়েবি ও মিথ্যা মামলা দায়ের করেছে পুলিশ।”

“এ ছাড়া প্রার্থী ও নেতা–কর্মীদের ওপর দুই হাজার ৮৯৬ বার হামলা চালানো হয়েছে। এতে প্রাণহানি ঘটেছে নয়জনের আর আহত হয়েছেন ১৩ হাজার ২৫২ জন,” তিনি বলেন।

রিজভী বলেন, “আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও আওয়ামী লীগের ক্যাডাররা গতকাল দেশের বিভিন্ন স্থানে ধানের শীষের প্রার্থীদের মিছিলে বাধা দিয়েছে। বিএনপির নির্বাচনী এজেন্ট, কর্মী ও সমর্থকদের এলাকাছাড়া করা হচ্ছে। আওয়ামী সন্ত্রাসীরা গ্রামে-গ্রামে সশস্ত্র মহড়া দিচ্ছে। সর্বত্র এক ভীতিকর অবস্থা বিদ্যমান।”

তিনি বলেন, “সেনাবাহিনীকে মাঠে নামিয়ে হাত-পা বেঁধে রেখেছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার। তাদের স্বাধীনভাবে কাজ করতে দেওয়া হচ্ছে না।”

শুক্রবার দুপুরে দুর্বৃত্তদের হামলার শিকার হয়েছেন পটুয়াখালী-৩ আসনের বিএনপি প্রার্থী গোলাম মওলা রনি। তিনি নিজেই বেনারের কাছে তার ওপর হামলার ঘটনা নিশ্চিত করেন।

বিএনপি বলেছে, তাদের ১৮ জন প্রার্থী কারাগারে আছেন। আর ২৩ আসনে তাদের প্রার্থীদের বাতিল করে দেয়া হয়েছে।

তবে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকে এসব অভিযোগ অস্বীকার করা হয়েছে।

ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া বলেছেন, পুলিশের আচরণ মোটেই পক্ষপাতমূলক নয়। পুলিশ যা কিছু করছে নিরপেক্ষতা ও পেশাদারির সঙ্গে করছে। অনুরাগ–বিরাগের বশবর্তী হয়ে নয়।

গতকাল শুক্রবার উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুলে ভোটকেন্দ্র পরিদর্শন শেষে ঢাকা মহানগর পুলিশের কমিশনার মো. আছাদুজ্জামান মিয়া এ কথা বলেন।

নিহত নয়: আওয়ামী লীগ

আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর কবির নানক শুক্রবার সাংবাদিকদের বলেন, “বিএনপি-জামায়াতের সন্ত্রাসীরা আমাদের ৪৪৫ জন নেতা-কর্মীকে আক্রমণ করেছে, ১৭৪টি নির্বাচনী ক্যাম্প ভাঙচুর করেছে।

তিনি বলেন, সারা দেশে আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদের লক্ষ্য করে আক্রমণ করছে বিএনপি-জামায়াত জোট। তাদের হামলায় নয়জন আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মী নিহত হয়েছে বলে দাবি করেন নানক।

অভিযোগ তদন্তের নির্দেশ: ইসি

ক্ষমতাসীন মহাজোট ও বিরোধী জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের অভিযোগের প্রেক্ষিতে কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে এমন প্রশ্নের জবাবে হেলালুদ্দীন আহমদ বেনারকে বলেন, “আমাদের কাছে যে সকল সহিংসতার অভিযোগ এসেছে সেগুলোর প্রতিটি তদন্ত করে দেখতে নির্দেশ দিয়েছি।”

পুলিশ ওই সকল ঘটনা তদন্ত করে নির্বাচন কমিশনকে কী জানিয়েছে সে ব্যাপারে কিছু বলেননি সচিব।

তিনি বলেন, “আমরা আশঙ্কা করছি, নির্বাচনের দিনে আরও সহিংসতার ঘটনা ঘটতে পারে। সুতরাং, সহিংস ঘটনা প্রতিরোধে নির্বাচন কমিশন যথাযথ ব্যবস্থা নেবে।”

আগামী রোববার নির্বাচনে সহিংসতা ঠেকাতে ছয় লাখ আট হাজারের অধিক আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য সারা দেশে মোতায়েন করা হবে বলে জানান ইসি সচিব।

সাংবাদিকদের ওপর হামলার নিন্দা

নির্বাচনী প্রচারণার সময় ১২ জন সাংবাদিক হামলার শিকার হয়েছেন বলে শুক্রবার এক বিবৃতিতে জানিয়েছে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডার্স।

এছাড়াও নির্বাচনের আগ মুহূর্তে অবাধ তথ্যপ্রবাহে বাধা সৃষ্টি করার ঘটনাকে মর্মাহত হওয়ার মতো বিষয় বলে মন্তব্য করেছে সংগঠনটি।

গত ২৪ ডিসেম্বর ৩০ জনের মতো মুখোশধারী ব্যক্তি দৈনিক যুগান্তর ও যমুনা টিভির সাংবাদিকদের ওপর নওয়াবগঞ্জের কাছে হামলা চালায় বলে বিবৃতিতে জানানো হয়।

ওই হামলার ঘটনায় পুলিশের নিষ্ক্রিয়তারও সমালোচনা করা হয় এতে।

“সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে সাম্প্রতিক ওই সহিংসতার ঘটনা রোববারের নির্বাচনী ফলাফলের বিশ্বাসযোগ্যতাকে ইতিমধ্যেই ক্ষতিগ্রস্ত করে ফেলেছে,” বিবৃতিতে বলেন সংগঠনটির এশিয়া প্যাসিফিক ডেস্কের প্রধান ড্যানিয়েল বাস্টার্ড।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।