নারীদের জটিল রোগ ফিস্টুলা, চিকিৎসা সুবিধা খুবই কম
2019.08.28
ঢাকা
আপডেট: ২৮ আগস্ট ২০১৯। ইস্টার্ন সময় সন্ধ্যা ৬.০০
সিলেটের সুনামগঞ্জের সোনিয়া আক্তার (১৭)। তিন বছর আগে মাত্র ১৪ বছর বয়সে বিয়ে হয় তাঁর। পরের বছরই আসে প্রথম সন্তান।
অনাগত সন্তান ও সোনিয়াকে ঘিরে বাড়িতে ছিল সীমাহীন আনন্দ। কিন্তু প্রসব জটিলতায় সন্তানটির মৃত্যু এবং জন্মদান পরবর্তী রোগ সোনিয়াকে করেছে সংসারহীন ও স্বজনহীন।
সোনিয়ার অসুখের নাম ফিস্টুলা।
ঢাকার মামস ইন্সটিটিউট অব ফিস্টুলা অ্যান্ড উইমেন্স হেলথে (এমআইএফডব্লিউওএইচ) চিকিৎসা নিচ্ছেন সোনিয়া। সেখানে অপারেশন হয়েছে তাঁর। ২০ শয্যার এই হাসপাতালটির একটি শয্যায় বসে কথা বলছিলেন তিনি।
সোনিয়া বেনারকে বলেন, “বাবা মায়ের বড় সন্তান আমি। বড় আদরের ছিলাম। কিন্তু অল্প বয়সে বিয়ে এবং মা হতে গিয়ে সন্তান হারিয়েছি। জটিল এই অসুখে পড়েছি।”
“এখন পাশে আর কেউ নেই। স্বামী আমাকে তালাক দিয়ে আবার বিয়ে করেছে। বাবা–মায়ের কাছেও বোঝা হয়ে আছি। ফিস্টুলা এমন এক অসুখ যে, সারাক্ষণ নিজের শরীর দুর্গন্ধ হয়ে থাকে। ফলে কেউ কাছে আসে না, কোনো কাজও দেয় না।”
শুধু সোনিয়া আক্তার নন, বাংলাদেশে তাঁর মতো হাজারো ফিস্টুলা রোগী রয়েছেন।
চিকিৎসকদের মতে, ফিস্টুলা এমন একটি নারী স্বাস্থ্য সমস্যা যাতে আক্রান্তদের সন্তান প্রসবের রাস্তা দিয়ে সব সময় প্রস্রাব বা পায়খানা ঝরতে থাকে। সময়মতো পর্যাপ্ত চিকিৎসা না পেলে প্রসবের রাস্তায় ক্ষত সৃষ্টি হয়। এতে মূত্রপথ বা মলাশয়ের অস্বাভাবিক সংযোগ তৈরি হলে নারীদের অনবরত মল-মূত্র ঝরতে থাকে। এতে দীর্ঘস্থায়ী স্বাস্থ্য সমস্যা তৈরি হয়।
রাজধানীর আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণাকেন্দ্রের (আইসিডিডিআরবি) মেজর ইভালুয়েশন, মামনি এইচএসএস প্রজেক্ট ও ফিস্টুলা কেয়ার প্লাসের ২০১৬ সালে পরিচালিত এক জরিপ অনুসারে, বর্তমানে বাংলাদেশে অন্তত ১৯ হাজার ৭৫৫ জন নারী ফিস্টুলা রোগে ভুগছেন। প্রতি বছর অন্তত এক হাজার নারী নতুন করে এ রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন।
ফিস্টুলার অন্যতম কারণ বাল্য বিবাহ
চিকিৎসকেরা বলছেন, এই অসুখের অন্যতম কারণ বাল্য বিবাহ এবং কম বয়সে গর্ভধারণ। তা ছাড়া অপুষ্টিতে ভোগা, অপ্রশিক্ষিত দাইয়ের হাতে বাড়িতে প্রসব, স্বাস্থ্য সচেতনতার অভাবেও ফিস্টুলা হয়ে থাকে। অস্ত্রোপচারজনিত জটিলতাও ফিস্টুলা রোগের জন্য দায়ী।
মামস ইন্সটিটিউট অব ফিস্টুলা অ্যান্ড উইমেন্স হেলথের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ডা. সায়েবা আক্তার বেনারকে জানান, “অল্প বয়সে বিয়ে হলে মেয়েদের পেলভিসের (শ্রেণি) গঠন ঠিকমতো হয় না। প্রসবের সময় সন্তান সেখানে আটকে যায়। এদিকে জরায়ু থেকে চাপ আসতে থাকে।”
“বাড়িতে দাইয়ের হাতে প্রসবের সময় কোনো কোনো রোগীর বাচ্চা তিন চার দিন আটকে থাকে। পরে পেলভিস নরম হয়ে আসলে টেনে হিঁচড়ে বাচ্চা বের করে আনে। তখন পেলভিসের পচন ধরে। এতে সামনে প্রস্রাবের থলি এবং পেছনে পায়ুপথ ফুটো হয়ে যায়। ফলে সারাক্ষণ প্রস্রাব–পায়খানা ঝরতে থাকে। এটাই হলো ফিস্টুলা,” বলেন তিনি।
“আবার সন্তান প্রসবকালে জরায়ু বা যোনিপথে কোনো অস্ত্রোপচারের সময় কাটা-ছেঁড়ার ফলে প্রস্রাবের রাস্তার সাথে মূত্রপথ মিলে গেলেও ফিস্টুলা হয়,” ডা. সায়েবা বলেন।
২০১৬ সালে সিলেটের ছাতকের রুহেনা বেগমের বিয়ে হয় মাত্র ১৬ বছর বয়সে। পরের বছর প্রথমে বাড়িতে সন্তান জন্মদানের চেষ্টা ব্যর্থ হলে হাসপাতালে ভর্তি হন। ততক্ষণে পেটের ভেতরে মারা যায় গর্ভের শিশু। হাসপাতালের ডাক্তাররা কয়েক ঘণ্টার চেষ্টায় মৃত সন্তান বের করে আনেন। তবে গত তিন বছর ধরে ফিস্টুলায় ভুগছেন রুহেনা।
মামস ইন্সটিটিউট অব ফিস্টুলা অ্যান্ড উইমেন্স হেলথ বিনা খরচে চিকিৎসা দিচ্ছে রুহেনাকে।
“গত তিন বছর ধরে এক রকম একাই থাকি। স্বামী, স্বজন থেকেও নেই। শেষ কবে শুকনো বিছানায় ঘুমিয়েছি মনে নেই। এই হাসপাতালে অপারেশন করার পরে কিছুটা ভালো আছি। জানি না সুস্থ হবো কিনা,” বেনারকে বলেন রুহেনা বেগম।
ডা. সায়েবা বলেন, প্রান্তিক মানুষ এখনো জানে না কোথায় ফিস্টুলার সঠিক চিকিৎসা হয়। তাছাড়া লজ্জায় অনেকে এই অসুখ নিয়ে মুখ খুলতে চান না।
তিনি বলেন, প্রসবজনিত ফিস্টুলা রোগীদের বড় অংশ বাল্য বিবাহের শিকার। এ ধরনের রোগীদের শরীরের গঠন সঠিক না হওয়া, সচেতনতা কম এবং বাড়িতে দাইয়ের হাতে সন্তান জন্মদানের চেষ্টার ফলে ফিস্টুলার মতো জটিল রোগে ভোগেন তাঁরা।
ডা. সায়েবা বলেন, “সমাজে যতটুকু শিক্ষার হার বেড়েছে ততটুকু সচেতনতা বাড়েনি। ফলে এখনো বাল্যবিবাহ হচ্ছে। অনেকে বাড়িতে দাইয়ের হাতে সন্তান জন্ম দিচ্ছে। এসব বিষয়ে সচেতন না হলে ফিস্টুলা রোগী কমানো যাবে না।”
২০১২ সাল থেকে এ পর্যন্ত প্রায় দুই হাজার ফিস্টুলা রোগীর অপারেশন হয়েছে ডা. সায়েবার এমআইএফডব্লিউওএইচ-এ। এদের বড় একটি অংশ বাল্য বিবাহের শিকার বলে জানান তিনি।
অপর্যাপ্ত চিকিৎসক
চিকিৎসা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সাধারণত দরিদ্র শ্রেণিই এই অসুখে পড়ে থাকে। সারা দেশব্যাপী ফিস্টুলা রোগী থাকলেও দেশে অভিজ্ঞ ডাক্তার কম হওয়ায় সকল রোগীকে চিকিৎসার আওতায় আনা সম্ভব হচ্ছে না।
এনজেন্ডার হেলথ বাংলাদেশের ফিস্টুলা কেয়ার প্লাস প্রকল্পের দেশীয় প্রকল্প ব্যবস্থাপক ড. শেখ নাজমুল হুদা বেনারকে বলেন, ফিস্টুলা অত্যন্ত জটিল রোগ। দেশের প্রান্তিক পর্যায়ে এই রোগীর সংখ্যা বেশি। তবে চিকিৎসা সুযোগ খুবই অপ্রতুল।
“সারা দেশে ৭-৮জন চিকিৎসক রয়েছেন, যারা দক্ষ হাতে ফিস্টুলার চিকিৎসা বা অপারেশন করতে পারেন,” বলেন তিনি।
ড. নাজমুল বলেন, “ফিস্টুলার চিকিৎসা সুযোগ প্রধানত ঢাকাকেন্দ্রিক। এনজেন্ডার হেলথ বাংলাদেশ সাতটি কেন্দ্রে বিনা মূল্যে ফিস্টুলার চিকিৎসা দিয়ে থাকে। এসব কেন্দ্রের সাফল্যের হার প্রায় ৮০ শতাংশ।”
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম আজাদ বেনারকে বলেন, দেশে ১০৮ জন প্রশিক্ষিত ফিস্টুলা সার্জন আছেন। তাঁদের মধ্যে ৬৮ জন দেশে রয়েছেন। তবে এদের সবাই সক্রিয়ভাবে কাজ করেন না। বলা যায়, চার থেকে পাঁচ জন ডাক্তারই বেশির ভাগ ফিস্টুলা অপারেশনগুলো করেন।
তিনি বলেন, “দেশে বছরে ছয় শ থেকে সাতশ ফিস্টুলা রোগীর অপারেশন করা হচ্ছে। বাকি চিকিৎসকেরা নিজেদের অর্জিত জ্ঞান কাজে লাগালে ফিস্টুলা রোগ নির্মূল করা সম্ভব।”
সরকার ২০৩০ সালের মধ্যে দেশ থেকে ফিস্টুলা দূর করার লক্ষ্যে এগিয়ে যাচ্ছে বলেও উল্লেখ করেন ডা. আবুল কালাম আজাদ। এ লক্ষ্যে বর্তমানে সরকারি ১১টি স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রে বিনা মূল্যে ফিস্টুলার অস্ত্রোপচার হয় বলে জানান তিনি।
সংশোধনী: ফিস্টুলা রোগে বাংলাদেশে প্রতি বছর এক হাজার রোগী আক্রান্ত হন। প্রথম প্রকাশে ভুলবশত তা দশ হাজার লেখা হয়েছিল।