রোহিঙ্গা বিতাড়নের দুই বছর: বাংলাদেশে উত্তেজনা বাড়ছে
2019.08.25
কক্সবাজার ও ঢাকা
মিয়ানমার থেকে গণবিতারণের দ্বিতীয় বছরে রবিবার হাজার হাজার রোহিঙ্গা শরনার্থী বাংলাদেশের কক্সবাজার জেলায় বিক্ষোভ করেছে। অন্যদিকে দ্বিতীয় দফা ফেরত পাঠানোর প্রচেষ্টা ব্যর্থ হওয়ার প্রেক্ষাপটে মিয়ানমার যে সমালোচনা করেছে তার কড়া জবাব দিয়েছে বাংলাদেশ।
রোহিঙ্গা অধিকার কর্মী এবং রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটস সংগঠনের সভাপতি মুহিব উল্লাহ বলেছেন, “রোহিঙ্গারা যাতে নিরাপদে নিজ দেশে ফিরতে পারে সেজন্য মিয়ানমারের রাখাইনে শান্তি কামনায় শরনার্থীরা রবিবার কুতুপালং ক্যাম্পে বিশেষ মোনাজাত করেছে।”
বেনারকে তিনি বলেন, “মিয়ানমারের সেনাদের অত্যাচার থেকে বাঁচার জন্য দুই বছর হয় আমরা বাংলাদেশে এসেছি। এটা আমাদের দেশ নয়। আমরা আমাদের নিজ দেশে ফেরত যেতে চাই। মিয়ানমারে আমাদের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য আমরা জাতিসংঘসহ বিশ্ববাসীর কাছে আবেদন জানাচ্ছি।”
এদিকে বাংলাদেশ ‘স্বীকৃত পদ্ধতি’ অনুসরণ করতে না পারায় ২২ আগষ্ট প্রত্যাবাসন শুরু করার প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে, মিয়ানমারের এরকম দাবির পর বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলেছে, “যে পক্ষ এই সমস্যা তৈরির জন্য সম্পূর্ণ দায়ী, তার কাছ থেকে বাংলাদেশ সহযোগিতা করছে না এমন অভিযোগ ভিত্তিহীন, অসৎ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত এবং পুরোটাই অগ্রহণযোগ্য।”
রবিবার (২৫ আগস্ট) পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সহকারী সচিব মারজুক ইসলাম স্বাক্ষরিত সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, “রোহিঙ্গারা ফেরত যেতে রাজি না হওয়ায় প্রত্যাবাসন শুরু হয়নি। এজন্য মিয়ানমার যে দায়িত্ব পালন করেনি - সেটির ওপর দোষ দেওয়া যায়।”
“মিয়ানমারের দেয়া ৩৪৫০ বাস্তুচ্যুত ব্যক্তির তালিকা আগষ্টের ৮ তারিখে আমরা জাতিসংঘের শরনার্থী সংস্থা ইউএনএইচসিআরের কাছে অনুমোদনের জন্য দিয়েছিলাম। সংস্থাটি ৩৩২ পরিবারের ১২৭৬ ব্যক্তির সাক্ষাৎকার নিয়েছে। প্রায় সবগুলো পরিবার মিয়ানমারে তাদের নিরাপত্তা নিয়ে মারাত্মক উদ্বেগের কথা জানিয়েছে। তারা নাগরিকত্ব, চলাফেরার স্বাধীনতা, জমিজমার অধিকার এবং অত্যাচার নির্যাতনের বিচার চেয়েছে।”
এই সমস্যার টেকসই সমাধানের জন্য মিয়ানমার যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে সেটি বাস্তবায়নের আহ্বান জানিয়ে বাংলাদেশ বলেছে, “রোহিঙ্গাদের মূল সমস্যাগুলোর সমাধানে মিয়ানমারকে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।”
বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, “মিয়ানমারের মিথ্যা দাবি প্রত্যাবাসনে সহায়তা করবে না। দুই পক্ষের মধ্যে সম্পাদিত চুক্তি অনুযায়ী, বাস্তচ্যুত লোকদের স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে ফেরত যেতে জন্য উৎসাহিত করার দায়িত্ব সম্পূর্ণভাবে মিয়ানমারের। রাখাইনে সহায়ক পরিবেশ তৈরি এবং বিশ্বাসের ঘাটতি কমানোর দায়িত্বও মিয়ানমারের।”
শুক্রবার মিয়ানমারের তথ্যমন্ত্রণালয় বলেছিল, যাচাইবাছাই করা একটি তালিকা গত জানুয়ারি মাস থেকে সাত দফায় বাংলাদেশের কাছে পাঠানো হয়। কিন্তু ইউএনএইচসিআর প্রত্যাবাসন বিষয়ক স্বাক্ষাৎকার শুরু করতে বিলম্ব করেছে। মিয়ানমার আরও অভিযোগ করে বাংলাদেশ আশ্রয় নেয়া ৪৪৪ জন হিন্দুকে প্রত্যাবাসনে তাদের অনুরোধ উপেক্ষা করেছে।
নিগ্রহ চলছেই
রোহিঙ্গা সংকটের দ্বিতীয় বার্ষিকী উপলক্ষে যুক্তরাষ্ট্র সরকার এক বিবৃতিতে বলেছে, মিয়ানমারে রোহিঙ্গা এবং অন্যান্য সংখ্যালঘুদের উপর বৈষম্য ও নির্যাতন এখনো অব্যাহত আছে।
“জবাবদিহিতার ঘাটতি এবং সেনাবাহিনীর উপর বেসামরিক তদারকির অভাবের কারণে বার্মার রাখাইন, কাচিন, শান এবং অন্যান্য প্রদেশে সেনাবাহিনী এখনো অত্যাচার চালাচ্ছে,” দাবি করে বিবৃতিতে বলা হয়, “আমরা সংশ্লিষ্ট সবাইকে মানবাধিকারের উপর শ্রদ্ধা রাখার জন্য এবং শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য রাজনৈতিক সংলাপের পথ বেছে নেওয়ার আহ্বান জানাই।”
ওয়াশিংটন গতমাসে মিয়ানমারের সেনাপ্রধানসহ আরও তিনজন জেনারেলের উপর ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিল। রোহিঙ্গা নেতারা এই ঘোষণাকে স্বাগত জানালেও তা পর্যাপ্ত নয় বলে দাবি করে।
হিউমাইন রাইটস ওয়াচ সম্প্রতি বলেছে, “রাখাইনে এখনো প্রায় ৫০০০০০ রোহিঙ্গা ভীতিকর অবস্থায় দিনাতিপাত করছে। মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনী তাদের চলাফেরার স্বাধীনতা সীমিত করে তাদেরকে ক্যাম্পে অথবা গ্রামের মধ্যে আটকে রেখেছে।”
হিউম্যান রাইটস ওয়াচের উপপরিচালক (এশিয়া) ফিল রবার্টসন বলেছেন, “জাতিগত নিধনের দু’বছর হয়ে গেলেও মিয়ানমার সরকার এখনো তাদের সেনাবাহিনীর বাড়াবাড়ির কথা অস্বীকার করে চলেছে। তারা সাক্ষ্য ও আলামত মুছে ফেলার জন্য রোহিঙ্গাদের ঘরবাড়ি বুলডোজার দিয়ে মাটিতে মিশিয়ে দিয়েছে – যা অপরাধ গোপন করার বড় নিদর্শন।”
আরাকান রোহিঙ্গা সলভেশন আর্মি (আরসা) ২০১৭’র ২৫ আগষ্ট মিয়ানমারের নিরাপত্তা চৌকিতে হামলার পর থেকে মিয়ানমার সেনাবাহিনী রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠির উপর হত্যা, নির্যাতন, ধর্ষণ, নিপিড়ন শুরু করে।
এর প্রেক্ষিতে প্রায় ৭৪০,০০০ রোহিঙ্গা মুসলিম সিমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়। জাতিসংঘ মিয়ানমারের এই অভিযানকে “গণহত্যা” এবং “জাতিগত নিধন” বলে আখ্যা দিলেও মিয়ানমার সব ধরণের বাড়াবাড়ির অভিযোগ অস্বীকার করেছে।
ক্যাম্পের কাছে গুলি বর্ষণ
কক্সবাজারের অধিবাসিরা বলছেন, শরনার্থী সংকটের কারণে তারা বিপর্যস্ত। শরনার্থীদের বিরুদ্ধে একজন স্থানীয় রাজনীতিক নেতাকে হত্যার অভিযোগ ওঠায় চলতি সপ্তাহে উত্তপ্ত পরিস্থিতি তৈরি হয়।
কক্সবাজারে রোহিঙ্গারা আসায় স্থানীয়দের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা মারাত্মকভাবে বিঘ্নিত হচ্ছে। আইন শৃঙ্খলার অবনতি ঘটেছে, জিনিসপত্রের দাম আকাশচুম্বি হয়ে গেছে, কৃষিকাজ প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে, পরিবেশের মারাত্মক ক্ষতি হয়েছে এবং সামগ্রিক উন্নয়ন প্রকৃয়া থমকে গেছে,” বেনারকে বলেছেন কক্সবাজার নাগরিক সমাজের সহসভাপতি কানন পাল।
তিনি বলেন, “এই অবস্থা চলতে থাকলে সামনের দিনগুলোতে কক্সবাজারে বিপর্যয় নেমে আসবে।”
গত রবিবার একদল অস্ত্রধারী স্থানীয় যুবলীগ নেতা ওমর ফারুককে টেকনাফে তার বাড়ির পাশে গুলি করে হত্যা করে। প্রতিবাদে স্থানীয় জনতা পরদিন কক্সবাজার টেকনাফ মহাসড়ক তিন ঘন্টার জন্য অবরোধ করে এবং একটি রোহিঙ্গা ক্যাম্পের ভেতরে দোকানপাট ও বাড়িঘর ভাঙচুর করে বলে স্থানীয় সংবাদমাধ্যমে এসেছে।
এরপর শনিবার পুলিশ অভিযানে নেমে টেকনাফের হিলনা শরনার্থী শিবিরের কাছে এই ঘটনায় সন্দেহভাজন দুই রোহিঙ্গাকে গুলি করে হত্যা করে। পুলিশ এই ঘটনাকে ‘বন্দুক যুদ্ধ’ হিসেবে বর্ণনা করেছে।
“আমরা অভিযানের সময় পুরো এলাকা ঘিরে ফেলি এবং তাদের আত্মসমর্পন করার আহ্বান জানাই। কিন্তু তারা আমাদের আহ্বান প্রত্যাখ্যান করে উল্টো গুলি চালায়,” টেকনাফ পুলিশ স্টেশনের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা বেনারকে বলেছেন।
বৃহশ্পতিবারের গুলি প্রসঙ্গে কানন পাল বলেন, “আমরা মানবিক কারণে তাদের আশ্রয় দিয়েছি। আজ রোহিঙ্গাদেরই কিছু মানুষ আমাদের উপর আক্রমণ করছে এবং মেরে ফেলছে। এটা স্থানীয়দের জন্য মারাত্মক উদ্বেগের বিষয়।”