ছাড়া পেলেন শহিদুল আলম
2018.11.20
ঢাকা
আপডেট: ২০ নভেম্বর, ইস্টার্ন টাইম বিকেল ০৩:০০
‘সরকারের বিরুদ্ধে অপপ্রচার’ করার দায়ে তিন মাসের বেশি সময় কারাগারে কাটিয়ে অবশেষে জামিনে মুক্ত হলেন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন আলোকচিত্রী শহিদুল আলম।
মঙ্গলবার রাত আটটা ২০ মিনিটে কেরানীগঞ্জে অবস্থিত ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে বেরিয়ে আসেন দৃক গ্যালারির প্রতিষ্ঠাতা শহিদুল আলম।
বেরিয়ে আসা মাত্রই কারাগার প্রাঙ্গণে উপস্থিত তাঁর ছাত্র-ছাত্রী ও শুভাকাঙ্খীরা তাঁকে ঘিরে আনন্দধ্বনি করতে থাকেন।
শহিদুল আলম ডান হাত তুলে প্রতিবাদের ভঙ্গিতে তাঁর মুক্তিতে আনন্দ প্রকাশ করেন।
“আমার মুক্তি আলোয় আলোয় এই আকাশে,
আমার মুক্তি ধুলায় ধুলায় ঘাসে ঘাসে॥”
এই রবীন্দ্রসঙ্গীত গেয়ে প্রিয়জন ও শিক্ষার্থীদের আলিঙ্গন করেন শহিদুল আলম।
তাঁর সঙ্গে সবাই যোগ দিয়ে আনন্দে গান গাইতে শুরু করেন। শহিদুল আনন্দে তাঁর স্ত্রীকে রেহনুমা আহমেদকে জড়িয়ে ধরেন।
তাঁর ভক্তরা গান গাইতে গাইতে কারাগার প্রাঙ্গণের বাইরে এসে তাঁকে একটি মাইক্রোবাসে উঠিয়ে দেন। রেহনুমাকে পাশে নিয়ে তিনি ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা দেন।
কারাগার ফটকে শহিদুল বেনারকে বলেন, “একটি স্বাধীন দেশে একজন নাগরিকের যদি মত প্রকাশের স্বাধীনতা না থাকে, তবে তা জেলখানা থেকে আলাদা কিছু নয়। একটি স্বাধীন দেশের সকল নাগরিকেরই মত প্রকাশের স্বাধীনতা থাকা উচিত।”
কারাগারে কেমন ছিলেন এমন প্রশ্নের জবাবে শহিদুল বলেন, “কারাগারে সবাই যেমন থাকে তেমন ছিলাম। ভালো ছিলাম। তবে আমার সাফারিং (কষ্ট) জেলের মধ্যে দেখা অনেক মানুষের চেয়ে অনেক কম ছিল।”
রেহনুমা আহমেদ বেনারকে বলেন, “আমরা সবাই অত্যন্ত আনন্দিত। অবশেষে শহিদুল কারাগার থেকে মুক্তি পেয়েছেন, তাঁর ছাত্র-ছাত্রীদের মাঝে ফিরে এসেছেন এটিই বড় বিষয়।”
তিনি বলেন, “হাইকোর্ট তাঁর জামিন আদেশে বলেছেন, শহিদুলের বিশেষ ব্যবস্থায় ও নিবিড় চিকিৎসা দরকার। তাই আমরা তাঁকে আজ রাতেই হাসপাতালে ভর্তি করাব। সেখানে স্বাস্থ্য পরীক্ষা ও চিকিৎসা শেষে তিনি বাসায় ফিরবেন।”
তিনি বলেন, “শহিদুলের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ আমরা আইনিভাবে মোকাবিলা করব।”
মামলা প্রত্যাহারের দাবি হিউম্যান রাইটস ওয়াচের
নিরাপদ সড়কের দাবিতে চলমান শিক্ষার্থীদের আন্দোলনকে সমর্থন করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও বিদেশি টেলিভিশনে সরকারের সমালোচনা করে বক্তব্য দেবার কারণে গত ৫ আগস্ট শহিদুল আলমকে তথ্য ও প্রযুক্তি আইনে গ্রেপ্তার করা হয়। কয়েকবার জামিন আবেদন খারিজ হবার পর ১৫ নভেম্বর হাই কোর্ট তাঁকে জামিন দেয়।
শহিদুল আলমের বিরুদ্ধে মামলা ও আটকের পুরো ঘটনাটিকে “শুরু থেকেই একটি মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা,” বলে বেনারের কাছে মন্তব্য করেছেন হিউম্যান রাইটস ওয়াচের এশিয়া বিষয়ক ডিরেক্টর ফিল রবার্টসন।
তিনি বলেন, “শহিদুল আলমের ওপর বাংলাদেশ সরকারের মানবাধিকার লঙ্ঘনের এই ঘটনার মূল কারণ, তিনি আল জাজিরা ও অন্যান্য মাধ্যমে বিশ্ববাসীর কাছে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের বিষয়ে কথা বলার দুঃসাহস দেখিয়েছিলেন।”
“সাংবাদিকতা অপরাধ হিসেবে গণ্য হওয়া উচিত নয়, মন্তব্য করে শহিদুল আলমের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলা প্রত্যাহার ও কারাবাসের দিনগুলোর জন্য ক্ষতিপূরণ দেবার জন্য বাংলাদেশ সরকারের কাছে দাবি জানান রবার্টসন।
এদিকে রেহনুমা আহমেদ বলেন, “এখন আমাদের উচিৎ ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের যেসকল রিপ্রেসিভ বিধান আছে সেগুলো বাতিল করার জন্য শিল্পী, সাহিত্যিক, একটিভিস্ট, সাংবাদিক সকলের একত্রে কাজ করা।”
মুক্তি নিয়ে নাটকীয়তা
বৃহস্পতিবার হাইকোর্ট থেকে জামিন পাওয়ার পর বিভিন্ন আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে মঙ্গলবার সকাল সাড়ে এগারোটায় ঢাকা মহানগর মুখ্য হাকিমের আদালত থেকে শহিদুলের মুক্তির আদেশ কারা কর্তৃপক্ষের কাছে পৌঁছায় বলে বেনারকে জানান শহিদুল আলমের আইনজীবী জীবনানন্দ জয়ন্ত।
তিনি বলেন, “কিন্তু তাঁর মুক্তি বিলম্বিত করা হয়। বেলা দুটার দিকে কারাগারের এক কর্মকর্তা এসে আমাদের জানান যে শহিদুল আলমকে কারাগারে নেয়ার সময় যে স্থায়ী ঠিকানা দেয়া হয় তার সাথে আদালত থেকে দেয়া মুক্তির আদেশে উল্লেখ করা ঠিকানার মিল নেই।”
জয়ন্ত বলেন, পরে মুক্তির আদেশটি মহানগর মুখ্য হাকিমের আদালত থেকে সংশোধনের করে জেলগেটে দেয়া হয় বিকাল পাঁচটা ৫৫ মিনিটে।
রেহনুমা আহমেদ বলেন, কারাগারের কর্মকর্তারা আমাকে বলেছিলেন সন্ধ্যা ছয়টার আগে সংশোধিত আদেশ আসলে শহিদুলকে মুক্তি দেয়া হবে।
এদিকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের সুপার ইকবাল কবির চৌধুরী বেনারকে বলেন, শহিদুলের মুক্তির আদেশে ঠিকানা ভুল ছিল। সেটি সংশোধন করে আমাদের কাছে বিকাল চারটার মধ্যে না পৌঁছায় আমরা ছাড়তে পারিনি।”
তিনি বলেন, “আগামীকাল বুধবার সকালে তাকে মুক্তি দেয়া হবে।”
রেহনুমা আহমেদ কারাগারের কর্মকর্তাদের সাথে যোগাযোগ করে তাঁর মুক্তির ব্যবস্থা করতে না পারায় সন্ধ্যায় কারাগার প্রাঙ্গণে হাজির হন শহিদুলের প্রধান আইনজীবী সারা হোসেন ও জ্যোতির্ময় বড়ুয়া।
আদালতে থেকে মুক্তির আদেশ যাওয়ার পরও শহিদুলকে মুক্তি না দেওয়ায় কারা কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে আদালত অবমাননা মামলা করার হুমকি দেন সারা হোসেন।
এরপর একজন ডেপুটি জেলার কারাগারের বাইরে এসে সারা হোসেন ও রেহনুমা আহমেদের সাথে কথা বলে আশ্বস্ত করেন যে, বুধবার সকাল ১০টা থেকে সাড়ে ১০টায় শহিদুলকে মুক্তি দেয়া হবে।
রাত আটটার দিকে সবাই কারাগার প্রাঙ্গণ ত্যাগ করতে থাকেন।
এর প্রায় ১০ মিনিট পর কারাগার থেকে রেহনুমা আহমেদকে ফোন করে কারা ফটকে আসতে বলা হয়। তার প্রায় ১০ মিনিট পর শহিদুল আলম হাসতে হাসতে বেরিয়ে আসেন।
ব্যারিস্টার সারা হোসেন তার প্রতিক্রিয়ায় বলেন, “অবশেষে শহিদুল আলম মুক্তি পেলেন। কারা কর্তৃপক্ষ উচ্চ আদালতের নির্দেশ মেনে তাকে মুক্তি দিয়েছে। তাই আমাদের আর আদালত অবমাননার মামলা করতে হলো না।”
রাষ্ট্র জামিনের বিরোধিতা করেনি
বৃহস্পতিবার জামিন হলেও শহিদুলের মুক্তি পেতে কিছুটা সময় লেগে যাওয়ার কারণ হলো রাষ্ট্রপক্ষের বিরোধিতা।
রাষ্ট্রপক্ষ হাইকোর্টের দেয়া জামিনের বিরোধিতা করে সোমবার আপিল বিভাগের চেম্বার জজের আদালতে পিটিশন দায়ের করে।
আবেদনের ওপর শুনানির জন্য সোমবার চেম্বার আদালতের কার্যতালিকায় ছিল রাষ্ট্রপক্ষের আবেদনটি।
কিন্তু রাষ্ট্রপক্ষ থেকে অ্যাটর্নি জেনারেল উপস্থিত থাকলেও তিনি শহিদুলের জামিনের বিরোধিতা করে কোনো বক্তব্য দেননি।
মঙ্গলবারও আবেদনটি চেম্বার জজ আদালতের কার্যতালিকায় ছিল, তবে শহিদুলের জামিন বিরোধিতা করে সরকারের পক্ষ থেকে কোনো যুক্তি পেশ করা হয়নি।
অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেছেন, তারা শহিদুলের জামিনের ব্যাপারে চেম্বার জজ আদালতে কোনো বিরোধিতা করেননি। তিনি বলেন, সরকার আদালত ও আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল।