নিজের খরচেই ভেঙে ফেলতে হবে অবৈধভাবে নির্মিত বিজিএমইএ ভবন
2016.11.08
Dhaka
দুই দশক ধরে আলোচিত ঢাকার অন্যতম অবৈধ স্থাপনা ‘বিজিএমইএ কমপ্লেক্স’ ভেঙে ফেলার বিষয়টি প্রায় নিশ্চিত হয়ে গেছে। তৈরি পোশাকশিল্প প্রস্তুত ও রপ্তানিকারক সমিতিকে (বিজিএমইএ) এই ভবন নিজ খরচে ভাঙতে নির্দেশ দিয়েছে উচ্চ আদালত।
ভবনটি ভাঙার আদেশসংক্রান্ত আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ রায় মঙ্গলবার প্রকাশ করা হয়। সুপ্রিম কোর্টের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত ৩৫ পৃষ্ঠার এই রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন পরিবেশবাদিরা, যাঁরা এটি ভাঙার দাবি জানিয়ে আসছিলেন।
তবে এই ভবনটির সঙ্গে পরোক্ষভাবে দেশের ৪০ লাখ পোশাক শ্রমিকের স্বার্থ জড়িত। দেশের গার্মেন্টস শিল্প বিকাশে যেসব মালিক ভূমিকা রাখছেন, এটি তাঁদেরই কেন্দ্রবিন্দু।
আদালতের দৃষ্টিতে জমির মালিকানা ছিল না। এর পাশাপাশি জলাধার আইন লঙ্ঘন করে বেগুনবাড়ি খাল ও হাতিরঝিল লেকের ওপর ভবনটি গড়ে তোলার অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে।
গতকাল প্রকাশিত রায়ে বলা হয়, বিজিএমইএ নিজ উদ্যোগে ভবন ভাঙতে ব্যর্থ হলে রায়ের কপি পাওয়ার ৯০ দিনের মধ্যে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) ওই ভবন ভেঙে দেবে। সে ক্ষেত্রে ভবন ভাঙার যাবতীয় খরচ বিজিএমইএর কাছ থেকে আদায় করতে বলা হয়েছে।
জলাধারের ক্ষতি করে বেআইনিভাবে গড়ে তোলা হয় এই বিশাল ভবন। হাই কোর্ট ২০১১ সালে এক রায়ে ভবনটি ভাঙার নির্দেশ দেয়। ২ জুন প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বাধীন চার সদস্যের আপিল বিভাগ লিভ টু আপিল খারিজ করে রায় দেন। সেই আদেশ মঙ্গলবার প্রকাশ হয়েছে।
হাই কোর্ট রায়ে বলেছিল, “বিজিএমইএ ভবনটি সৌন্দর্যমণ্ডিত হাতিরঝিল প্রকল্পে একটি ক্যান্সারের মতো। এ ধ্বংসাত্মক ভবন অচিরেই বিনষ্ট না করা হলে এটি শুধু হাতিরঝিল প্রকল্পই নয়, সমস্ত ঢাকা শহরকে সংক্রামিত করবে।”
ভবনটি নকশা অনুযায়ী করা হয়নি বলে রাজউক অভিযোগ করে আসছিল। আর পরিবেশবাদী বিভিন্ন সংগঠন বলে আসছে, বিজিএমইএ ভবন নির্মাণের জন্য বেগুনবাড়ি খালের একাংশ ভরাট করে ফেলায় এর গতিপথ পরিবর্তিত হয়েছে, যা পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর।
হাই কোর্টের রায়ে বলা হয়, “একটি গুরুত্বপূর্ণ সংগঠন হিসেবে বিজিএমইএর আইনের প্রতি আরও বেশি শ্রদ্ধাশীল হওয়া বাঞ্ছনীয় ছিল। তারা তা না করে আইনকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করেছে।”
২০১০ সালের ২ অক্টোবর একটি ইংরেজি দৈনিকে প্রকাশিত সংবাদে বলা হয়, রাজউকের অনুমতি ছাড়া বিজিএমইএ ভবন নির্মাণ করা হয়েছে। এটি আদালতের দৃষ্টিগোচর করা হলে আদালত স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে রুল জারি করেন।
হাইকোর্ট ২০১১ সালের ৩ এপ্রিল ভবনটি ভেঙে ফেলতে রায় দেন এবং জলাধার আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে বলেন। এই রায়ের বিরুদ্ধে বিজিএমইএ আপিল করে। কিন্তু তাদের আপিল খারিজ করে দেয় আপিল বিভাগ।
রিভিউ আবেদনের সুযোগ আছে
গতকাল পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি প্রকাশের পর বিজিএমইএ আপিল বিভাগের রায় পুনর্বিবেচনার (রিভিউ) আবেদন করতে পারে।
এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে বিজিএমই-এর কৌসুলি ব্যারিস্টার রফিক-উল হক সাংবাকিদের বলেন, মক্কেলের অভিপ্রায় অনুসারে পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
বিজিএমইএর সহসভাপতি মোহাম্মদ নাছির বেনারকে বলেন, “আমরা রিভিউ আবেদন করব। রিভিউ আবেদন বিবেচনা না করা হলে বিজিএমইএ আদালতের কাছে যৌক্তিক সময় চাইবে, যাতে মালামাল অন্যত্র সরিয়ে নেওয়া সম্ভব হয়।’ তবে এ প্রসঙ্গে মামলায় হাই কোর্টের অ্যামিকাস কিউরি হিসেবে দায়িত্ব পালনকারী মনজিল মোরসেদ বেনারকে জানান যে “রিভিউয়ে রায় পাল্টানোর ইতিহাস খুবই বিরল, এই ভবনটি যে অবৈধভাবে গড়ে উঠেছে, তা নিয়ে আর কোনো সন্দেহ নেই।”
আদালতের রায় বাস্তবায়নে কী উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে জানতে চাইলে রাজউক চেয়ারম্যান এম বজলুল করিম চৌধুরী সাংবাদিকদের বলেন, এই বিশাল ভবন ভাঙার খরচ কে দেবে, তা নিশ্চিত হতে না পারায় এতোদিন অপেক্ষা করা হয়েছে। পূর্ণাঙ্গ রায় পাওয়ার পর এখন সিদ্ধান্ত নেওয়া সহজ হবে।
রায়ের কিছু পর্যবেক্ষণ
রায়ে বলা হয়, বেগুনবাড়ি খাল ও হাতিরঝিল প্রাকৃতিক জলাধার। এই জলাধার দুটি দিয়ে এক তৃতীয়াংশ দূষিত পানির পাশাপাশি বৃষ্টির পানি সরু নালার মাধ্যমে নির্গত হয়। রাজধানী ঢাকাকে জলাবদ্ধতা থেকে রক্ষায় এ দুটি জলাধারের গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা রয়েছে। জলাধারের বৈশিষ্ট্য পরিবর্তন করে বাণিজ্যিক ভবন করা আইনসঙ্গ নয়।
রায়ে আরও বলা হয়, দুটি জলাধার ঘিরে সৌন্দর্য বাড়ানোর জন্য সরকার এক হাজার ৪৮০ কোটি টাকার প্রকল্প নিয়েছে। এ অবস্থায় হাই কোর্টের রায় বাতিল করার বা এতে হস্তক্ষেপ করার যুক্তিসংগত কারণ দেখাতে পারেননি আবেদনকারী।
রায়ে আরও বলা হয়, ভবন নির্মাণ আইন ১৯৯৬ অনুযায়ী রাজউক থেকে নকশা অনুমোদনের জন্য জমির মালিকানার প্রমাণপত্র দাখিল করতে হয়। জমির মালিকানা সঠিক হলে আইন অনুযায়ী রাজউক তা অনুমোদন করতে পারে। কিন্তু এক্ষেত্রে আলোচিত জমিটি রপ্তানী উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) কাছ থেকে নিয়েছে বিজিএমইএ। অথচ ইপিবি ওই জমির মালিক ছিল না।
প্রকাশিত রায়ে আরও বলা হয়, ভবন নির্মাণের জন্য জলাধার আইন-২০০০ এবং পরিবেশ সংরক্ষণ আইন-১৯৯৫ অনুযায়ী পরিবেশগত ছাড়পত্র নিতে হয়। এখানে তাও অনুপস্থিত ছিল।
ভবনের অতীত
আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকাকালে ১৯৯৮ সালে বিজিএমইএ তাদের প্রধান কার্যালয় ভবন নির্মাণের জন্য সোনারগাঁও হোটেলের পাশে বেগুনবাড়ী খালপাড়ের এ জায়গাটি নির্ধারণ করে এবং বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অনুমতি নিয়ে রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) কাছ থেকে ৫ কোটি ১৭ লাখ টাকায় জমিটি কেনে।
তখনকার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ওই বছরই বিজিএমইএ ভবনের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। ২৮ নভেম্বর শুরু হয় ভবন তৈরির কাজ। ২০০৬ সালের অক্টোবরে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া বিজিএমইএর ভবনটি উদ্বোধন করেন।