কালো টাকা সাদা করার সুযোগ ঘিরে বিতর্ক
2024.06.06
ঢাকা

চার বছর পর আবারও অপ্রদর্শিত আয় বৈধ করার সুযোগ দিয়েছে সরকার, যা নিয়ে তুমুল বিতর্ক ও সমালোচনা সৃষ্টি হয়েছে।
বৃহস্পতিবার ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেট উপস্থাপনকালে এই সুযোগের কথা ঘোষণা করেন অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী। উল্লেখ্য, এ বছর প্রস্তাবিত বাজেটের আকার সাত লাখ ৯৭ হাজার কোটি টাকা।
অর্থমন্ত্রীর প্রস্তাবিত অর্থ বিল-২০২৪ অনুযায়ী “অপ্রদর্শিত” সিকিউরিটিজ, নগদ অর্থ, ব্যাংকে গচ্ছিত অর্থ, আর্থিক স্কিম ও ইন্সট্রুমেন্ট এবং সকল প্রকার সঞ্চয়ের মোট পরিমাণের শতকরা ১৫ শতাংশ কর পরিশোধ করে বৈধ করা যাবে।
একইভাবে অপ্রদর্শিত স্থাপনা, বাড়ি, ফ্ল্যাট, অ্যাপার্টমেন্ট ও ফ্লোর স্পেস প্রতি বর্গমিটার স্থান ভেদে ছয় হাজার থেকে ৫০০ টাকা হারে কর দিয়ে বৈধ করা যাবে।
ভূমির ক্ষেত্রে স্থান ভেদে করের পরিমাণ প্রতি বর্গমিটার ১৫ হাজার টাকা থেকে ৩০০ টাকা দিয়ে বৈধ করা যাবে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডসহ দেশের কোন সংবিধিবদ্ধ সংস্থা এ ব্যাপারে প্রশ্ন তুলবে না।
বাজেট বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী বলেন, ডেটা ভেরিফিকেশন সিস্টেম চালু করায় বিভিন্ন কোম্পানির অপ্রদর্শিত আয় ও সম্পদের তথ্য প্রকাশ নিয়ে আইনি জটিলতা তৈরি হয়েছে। তাছাড়া রিটার্ন দাখিলের ক্ষেত্রে করদাতাদের অজ্ঞতাসহ অনিবার্য পরিস্থিতির কারণে অর্জিত সম্পদ প্রকাশে ত্রুটি থাকতে পারে।
“এ অবস্থায় করদাতাদের আয়কর রিটার্নের এই ভুল সংশোধনের সুযোগ করে দেয়া এবং অর্থনীতির মূল ধারায় অর্থের প্রবাহ বাড়ানোর লক্ষ্যে আয়কর আইনে কর প্রণোদনার ওপর একটি ধারা সংযোজনের প্রস্তাব করছি, যোগ করেন অর্থমন্ত্রী।
চার বছর আগে ২০২০-২১ অর্থবছরে কালো টাকা সাদা করার ঢালাও সুযোগ ঘোসণা করেন তখনকার অর্থমন্ত্রী আ.হ.ম. মুস্তাফা কামাল। তিনি ২০২২-২৩ অর্থবছরে বিদেশে পাচার হয়ে যাওয়া টাকা বৈধ করার সুযোগ প্রদান করেন। তবে তাতে আশানুরুপ সাড়া মেলেনি।
সাবেক অর্থমন্ত্রী ও অর্থ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির বর্তমান সভাপতি আ. হ. ম. মুস্তাফা কামাল বেনারকে বলেন, “আমার সময়ও অপ্রদর্শিত টাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়া হয়েছিল। সেটি করা হয়েছিল, বাস্তব অবস্থা বিবেচনা করে। ”
তিনি বলেন, “বিপুল পরিমাণ টাকা বিভিন্ন হাতে চলে গেছে। কিছু মানুষের হাতে অনেক অপ্রদর্শিত টাকা রয়েছে। এগুলোকে অর্থনীতির মূল ধারায় ফিরিয়ে আনতে হবে। সেকারণেই কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দিতে হয়।”
মুস্তাফা কামাল বলেন, “এই টাকা যদি অর্থনীতির মূল ধারায় ফিরিয়ে আনা যায় এবং সেগুলো বিনিয়োগে করা হয়, তাহলে অর্থনীতিতে গতি আসবে। দেশের মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে।, দারিদ্র কমবে।”
তবে দুর্নীতির বিরুদ্ধে কথা বলা এবং একইসাথে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেয়া দুর্নীতিকে রাষ্ট্রীয়ভাবে উৎসাহিত করা কি না এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “তাদের আকর্ষণীয় সুযোগ না দিলে এই অর্থ অর্থনীতির মূল ধারায় আসবে না। টাকা অন্য জায়গায় চলে যাবে।”
পলিসি রিসার্চ ইন্সটিটিউট এর নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ. মনসুর বলেন, অপ্রদর্শিত আয় এবং কালো টাকা একই কথা। সরকার ‘কালো টাকা’ শব্দ দুটি ব্যবহার করছে না।
তিনি বেনারকে বলেন, “বাংলাদেশের প্রায় সব সরকারই বাজেটে কালো টাকা অর্থাৎ দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত টাকা বৈধ করার সুযোগ দিয়েছে। আবারও দেওয়া হলো। এটি রাষ্ট্রীয়ভাবে দুর্নীতিকে উৎসাহিত দেওয়া বলা যেতে পারে।”
আহসান এইচ. মনসুর বলেন, “আরও বড় বিষয় হলো বৈধ আয়ের জন্য একজন শতকরা ৩০ শতাংশ কর দেবেন, আরেকজন দুর্নীতিবাজ, অর্থপাচারকারী দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত অর্থ ১৫ ভাগ কর দিয়ে বৈধ করবেন—এটি কেমন কথা?”
“তাহলে তো দেখা যাচ্ছে, বৈধ পথে আয় করা অন্যায়! এর ফলে দুর্নীতি আরও বৃদ্ধি পাবে, দুর্নীতিবাজেরা উৎসাহিত হবে।”
আহসান এইচ. মনসুর বলেন, “কালো টাকা সাদা করার প্রস্তাব দিয়ে দুর্নীতির বিরুদ্ধে কথা বলা পরস্পরবিরোধী। সরকারের এই প্রস্তাবের ফলে দুর্নীতিবাজরা দুই ধরণের সুবিধা নেবে। একদিকে তারা অর্ধেক কর দেবে, আবার বিদেশে পাচার করা টাকা বাংলাদেশে বিনিয়োগ দেখিয়ে রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন সুবিধা নেবে।”

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বেনারকে বলেন, “সরকার যত ধরণের ব্যাখ্যাই প্রদান করুক না কেন, কালো টাকা সাদা করার যে সুযোগ দেওয়া হয়েছে, সেটি সাধারণ মানুষ গ্রহন করবে না, তারা দুর্নীতিবাজদের বিচার দেখতে চায়।”
তিনি বলেন, “আমরা বার বার সরকারকে বলে আসছি, কালোটাকা বৈধ করার সুযোগ দেওয়া বন্ধ করতে হবে। অন্যথায় দেশে দুর্নীতি বন্ধ হবে না।”
ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, “এমন সুযোগ দেওয়ার অর্থ হলো, দুর্নীতির মাধ্যমে আয় করো এবং বছর শেষে কম পরিমাণ কর দিয়ে সেগুলো বৈধ করে নাও।”
তিনি বলেন, “কালো টাকা সাদা করার যে ঢালাও সুযোগ দেওয়া হয়েছে সেটি আমাদের সংবিধানের ২০ অনুচ্ছেদ বিরোধী। এই অনুচ্ছেদ অনুযায়ী আয় করা ছাড়া কোন অর্থের মালিক হতে পারবে না। সংবিধানের আরেকটি বিধান অনুযায়ী আইন কখনও বৈষম্যমূলক হতে পারবে না।”
কোন আমলে কত অবৈধ টাকা বৈধ?
জাতীয় সংসদে অর্থমন্ত্রীদের দেওয়া তথ্য ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের তথ্য অনুসারে, বিভিন্ন সরকারের আমলে বিভিন্নভাবে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়া হয়।
আগে কালো টাকা সাদা করলেও সরকারের কিছু বিভাগ এ নিয়ে প্রশ্ন তুলতে পারতে। কিন্তু গত কয়েক বছর কালো টাকা বৈধ করার ব্যাপারে বাজেটে যে প্রস্তাব দেওয়া হয় সেখানে বলা হয়েছে, নির্দিষ্ট পরিমাণ কর প্রদান করলে রাষ্ট্রীয় কোন সংস্থাই আয়ের উৎস সম্পর্কে প্রশ্ন করতে পারবে না। এবছরও তেমন সুযোগ দেওয়া হলো।
জিয়াউর রহমান এবং এইচ এম এরশাদের শাসনামলেও কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়া হয়েছিল।
১৯৯১-৯৬ সাল পর্যন্ত বিএনপি সরকারের মেয়াদে কর দিয়ে ১৫০ কোটি ৭৯ লাখ টাকা বৈধ করেন বিভিন্ন ব্যক্তি।
১৯৯৬-২০০১ সালে আওয়ামী লীগের শাসনামালে কর ও জরিমানা দিয়ে ৯৫০ কোটি ৪১ লাখ টাকা বৈধ করা হয়।
২০০১ থেকে ২০০৬ পর্যন্ত বিএনপি সরকারের সময় ৮২৭ কোটি ৭৪ লাখ টাকা সাদা করা হয়।
সেনা-সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে (২০০৭-০৮) ৯১১ কোটি টাকা কর ও জরিমানা দিয়ে নয় হাজার ৬৮২ কোটি ৯৯ লাখ কালো টাকা সাদা করেছেন বিভিন্ন ব্যক্তি।
২০০৯ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত আওয়ামী লীগের আমলে প্রায় তিন হাজার ৫০০ কোটি টাকা কর ও জরিমানা দিয়ে কমপক্ষে ৩২ হাজার কোটি টাকা বৈধ করেছেন বিভিন্ন ব্যক্তি।