অভিজিৎ রায়কে কুপিয়েছে চারজন, তিনজনকেই চিহ্নিত করতে পারেনি পুলিশ

কামরান রেজা চৌধুরী
2019.05.01
ঢাকা
Share on WhatsApp
Share on WhatsApp
190501_Avijit_Roy_story_1000.JPG ওয়াশিংটন ডিসিতে বার্তাসংস্থা রয়টার্সের সাথে কথা বলছেন অভিজিৎ রায়ের স্ত্রী বন্যা আহমেদ। ২০১৫ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় একুশে বইমেলা থেকে ফেরার পথে জঙ্গিরা কুপিয়ে হত্যা করে ব্লগার অভিজিৎ রায়কে। একই হামলায় মারাত্মকভাবে আহত হন বন্যা আহমেদ। হাতের একটি আঙুলও হারাতে হয় তাঁকে। ২৩ এপ্রিল ২০১৫।
[রয়টার্স]

আপডেট: ৩ মে ২০১৯। ইস্টার্ন সময় বিকেল ০৩.০০

বিজ্ঞানমনস্ক লেখক অভিজিৎ রায়কে যে চার জঙ্গি কুপিয়ে হত্যা করেছে তার মধ্যে তিনজনকেই চিহ্নিত করতে পারেনি পুলিশ। ফলে ওই তিন আসামিকে বাদ দিয়ে মোট ছয়জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের জন্য আদালতে আবেদন জানিয়েছে পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিট।

হত্যাকাণ্ডের চার বছর পরে গত ৯ এপ্রিল আদালতে জমা দেওয়া ওই অভিযোগপত্রে প্রধান তিন আসামীসহ ১৫ জনকে অব্যাহতির সুপারিশ করা হয়।

আগামী ৫ মে আদালতে এ মামলার অভিযোগ গঠনের দিন ধার্য রয়েছে জানিয়ে ঢাকা মহানগর সন্ত্রাস বিরোধী ট্রাইবুনালের পাবলিক প্রসিকিউটর জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বেনারকে বলেন, “আদালত চাইলে মামলাটি পুনরায় তদন্তের নির্দেশ দিতে পারেন।”

তবে পুলিশ বলছে, অভিযোগপত্র থেকে অব্যাহতি দেয়া হলেও হত্যাকারীরা গ্রেপ্তার হলে তাঁদের বিরুদ্ধে সম্পূরক অভিযোগপত্র দাখিল করা হবে।

এদিকে অভিজিৎ রায়ের বাবা অধ্যাপক অজয় রায়ের অভিযোগ, পুলিশ ইচ্ছে করেই অপরাধীদের ধরছে না।

তিনি বেনারকে বলেন, “তারা ইচ্ছা করলে সবাইকে ধরতে পারে। যারা অভিজিৎকে কুপিয়েছে তাদের তিনজনকে ধরছে না পুলিশ। মূল হোতা সেনাবাহিনীর সাবেক মেজর জিয়া ঘুরে বেড়াচ্ছে বলে শোনা যাচ্ছে।”

আক্ষেপ করে তিনি বলেন, “পুলিশ যদি না ধরে বা না ধরতে পারে তাহলে আমাদের আর কী করার আছে?”

অভিজিৎ​ রায় হত্যা মামলার অভিযোগপত্রের একটি কপি বেনারের কাছে রয়েছে।

এতে অভিযুক্তরা হলেন মোজাম্মেল হোসেন ওরফে সায়মন, আবু সিদ্দিক সোহেল ওরফে সাকিব ওরফে সাজিদ, আরাফাত রহমান সিয়াম ওরফে সাজ্জাদ, আকরাম হোসেন আবির ওরফে আদনান, শফিউর রহমান ফারাবি এবং চাকুরিচ্যুত মেজর মোহাম্মদ জিয়াউল হক।

এদের মধ্যে হত্যাকাণ্ডে সরাসরি অংশ নেওয়া আরাফাত রহমান এবং অন্য তিন জন কারাগারে। জিয়াউল হক ও আকরাম হোসেন পলাতক।

এই মামলায় অভিজিৎ রায়ের স্ত্রী রাফিদা আহমেদ বন্যাসহ ৩৪ জনকে সাক্ষী করা হয়েছে।

হত্যাকণ্ডের সাথে সংশ্লিষ্টতা না পাওয়ায় সাতজনকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। তাঁরা হলেন: সাদেক আলী ওরফে মিঠু, মোহাম্মদ তৌহিদুর রহমান, আমিনুল মল্লিক, জাফরান হাসান, জুলহাস বিশ্বাস, আব্দুর সবুর ওরফে রাজু সাদ ও মাইনুল হাসান শামীম।

অব্যাহতি দেওয়া অন্য আটজনের মধ্যে মান্না ইয়াহিয়া ওরফে মান্নান রাহি ও আবুল বাশার চিকিৎসাধীন অবস্থায় হাসপাতালে মারা গেছেন এবং মকুল রানা খিলগাঁও এলাকায় পুলিশের সাথে ‘বন্ধুকযুদ্ধে’ মারা যান।

এছাড়া নাম-ঠিকানা না পাওয়ায় অভিযোগ থেকে বাদ দেওয়া পাঁচজন হলেন, সেলিম, হাসান, আলী ওরফে খলিল, অনিক ও অন্তু।

অভিযোগপত্র অনুযায়ী আরাফাত, অনিক, অন্তু ও আলী অভিজিৎকে কুপিয়ে হত্যা করেন।

চার্জশিট থেকে আসামিদের বাদ দেওয়া প্রসঙ্গে ঢাকা মহানগর পুলিশের মুখপাত্র মাসুদুর রহমান বেনারকে বলেন, “আইন অনুযায়ী কোনো আসামীর প্রকৃত নাম ও স্থায়ী ঠিকানা না পাওয়া গেলে তার বিরুদ্ধে আমরা চার্জ আনতে পারি না। কিন্তু তাই বলে যে তারা বেঁচে যাবে সেটি ঠিক নয়।”

ধরা না পড়া আসামিদের জন্য অপেক্ষা করলে বিচার শুরু হতে অনেক বিলম্ব হবে মন্তব্য করে মাসুদুর রহমান বলেন “তারা যদি কোনোদিন ধরা পড়ে অথবা অন্য মামলায় গ্রেপ্তার হয় তখন তাদের বিরুদ্ধে সম্পূরক চার্জশিট দেওয়া হবে।”

প্রসঙ্গত ২০১৫ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি একুশে বইমেলা থেকের ফেরার সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি চত্বরের কাছে প্রগতিশীল লেখক অভিজিৎ রায়কে জঙ্গিরা কুপিয়ে হত্যা করে। একই হামলায় মারাত্মকভাবে আহত হন অভিজিতের স্ত্রী রাফিদা আহমেদ বন্যাও।

অভিযোগপত্রে হত্যাকাণ্ডের বিবরণ

অভিযোগপত্র অনুযায়ী, চাকুরিচ্যুত মেজর জিয়ার নেতৃত্বে অভিজিৎ রায় হত্যার ঘটনা ঘটিয়েছে জঙ্গি সংগঠন আনসারুল্লাহ বাংলা টিম (এবিটি)। নিজেদের মধ্যে যোগাযোগের জন্য জঙ্গিরা প্রটেক্টেড টেক্সড ব্যবহার করত।

২০১৫ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি জিয়ার নির্দেশ অনুযায়ী অভিজিৎ রায়কে হত্যার জন্য আরাফাত রহমানকে নির্দেশ দেয় মুকুল রানা।

১৯/২০ ফেব্রুয়ারি আরাফাত, আলী ওরফে খলিল, আনিক এবং অন্তুকে আশকোনার একটি বাসায় ডেকে পাঠায় মুকুল রানা। ওই দিন প্রত্যেককে দুই হাজার করে টাকা দিয়ে একটি করে কাঁধে ঝোলানো ব্যাগ ও চাপাতি কিনতে বলে মুকুল। পরে চার জঙ্গি সেদিনই টঙ্গী বাজার থেকে চারটি চাপাতি ও চারটি ব্যাগ কেনে।

ওই বৈঠকে মেজর জিয়া, সেলিম, মোজাম্মেল হোসেন ও হাসান উপস্থিত ছিল।

২০/২১ ফেব্রুয়ারি আরেক জঙ্গি আবু সিদ্দিক সোহেলকে এলিফ্যান্ট রোডের একটি বাসায় আসতে বলে মোজাম্মেল হোসেন। ওই বাসায় মোজাম্মেল, আকরাম হোসেন আবির ও হাসান থাকত।

মোজাম্মেল সেদিনের বৈঠকে আবু সিদ্দিকের উদ্দেশ্যে জানায়, “একজন বড় নাস্তিক ব্লগার আছে। বিদেশ থাকে। বর্তমানে দেশে এসেছে। তাকে হত্যা করতে হবে। ব্লগারের নাম অভিজিৎ রায়।”

আকরাম তার ল্যাপটপে অভিজিৎ রায়ের ছবি দেখিয়ে দেয় এবং তার ফেসবুক লিঙ্ক দেয়।

ওই দিনই মোজাম্মেলের নির্দেশে আবু সিদ্দিক, আকরাম এবং হাসান বই মেলায় যায়। মোজাম্মেল আলাদাভাবে মেলায় যায়। তারা অভিজিৎ রায়ের বইয়ের প্রকাশনা সংস্থা জাগৃতির স্টলে গিয়ে অভিজিৎ রায়কে খোঁজাখুঁজি করে।

পরের দিন তারা অভিজিৎ রায়কে দেখতে পায়। সেদিন মেলা থেকে বেরিয়ে ধানমন্ডির একটি রেস্তোরায় খেতে যান তিনি। সেখানে সোহেল, মোজাম্মেল, আকরাম এবং হাসান অভিজিৎ রায়কে অনুসরণ করে।

২৪ ফেব্রুয়ারি স্ত্রী রাফিদা আহমেদ বন্যার মামার ইন্দিরা রোড়ের বাড়িতে গিয়েছিলেন অভিজিৎ​। এসময় জঙ্গিরা তাঁদের অনুসরণ করে এবং সেই বাসার দারোয়ানের কাছ থেকে তথ্য নিয়ে অভিজিৎ এর অবস্থান সম্পর্কে নিশ্চিত হয়।

হত্যাকাণ্ডের দিন ২৬ ফেব্রুয়ারি আবু সিদ্দিক, আকরাম, হাসান, মোজাম্মেল এলিফেন্ট রোডের বাসায় যায়। বই মেলায় কে কোথায় অবস্থান নেবে এবং অভিজিৎ রায়কে কীভাবে অনুসরণ করা হবে সে ব্যাপারে বুঝিয়ে দেয় মোজাম্মেল।

কিছুক্ষণ পর মোজাম্মেল সবাইকে জানায়, অভিজিৎ বই মেলায় এসেছে।

মুকুল রানার নির্দেশে টিএসসি মোড়ে বই মেলার গেটের কাছে চাপাতি নিয়ে অবস্থান নেয় আলী ওরফে খলিল এবং অনিক। আরাফাত রহমান একটি চাপাতি এবং অন্তু একটি চাপাতি ও একটি নাইন এমএম পিস্তল নিয়ে অভিজিৎ রায়ের গাড়ির কাছে অবস্থান নেয়।

সে সময় মেজর জিয়া, সেলিম, মুকুল রানা, মোজাম্মেল হোসেন, আবু সিদ্দিক, আকরাম হোসেন ও হাসান বই মেলায় উপস্থিত ছিল।

রাত আনুমানিক সাড়ে আটটা থেকে নয়টার মধ্যে বই মেলা থেকে বের হয়ে আসেন অভিজিৎ রায় ও তার স্ত্রী রাফিদা আহমেদ বন্যা।

এর মধ্যেই আরাফাত রহমান ও অন্তুকে টিএসসি মোড়ের যেখানে আলী এবং অনিক অবস্থান নিয়েছিল সেখানে যেতে বলে মেজর জিয়া।

আরাফাত রহমান ও অন্তু সেখানে গিয়ে দেখে অভিজিৎ রায়কে কোপাচ্ছে আলী ওরফে খলিল এবং অনিক। সেখানে গিয়ে তারাও অভিজিৎকে কোপায় বলে উল্লেখ করা হয় তদন্ত প্রতিবেদনে।

হত্যাকণ্ডের সময় মেজর জিয়া, সেলিম, মুকুল রানা, মোজাম্মেল হোসেন, আবু সিদ্দিক, আকরাম হোসেন চারদিক ঘিরে রাখে যাতে হত্যাকারীরা নিরাপদে পালিয়ে যেতে পারে।

অভিযোগপত্রের বলা হয়, হত্যাকাণ্ডের আগে ফেসবুক পোস্টের মাধ্যমে ইসলামকে অবমাননার জন্য কয়েক দফা অভিজিৎকে হত্যার হুমকি দেন ফারাবি। এছাড়া হত্যার প্ররোচনা ও হত্যাকারীদের তথ্যপ্রদান করে সহায়তার অভিযোগ আনা হয় ফারাবির বিরুদ্ধে।

অভিযুক্তদের কী ধরনের শাস্তি হতে পারে

অভিজিৎ রায় হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় ২০০৯ সালের (সংশোধনী ২০১৩) সন্ত্রাস বিরোধী আইনের ছয় নম্বর ধারার বিভিন্ন উপধারা অভিযোগ আনা হয়েছে।

অভিযোগপত্রে নির্দিষ্ট কোনো অভিযুক্ত’র বিরুদ্ধে নির্দিষ্ট উপধারা উল্লেখ করা হয়নি। বরং ছয় জনকেই যৌথভাবে কয়েকটি উপধারায় অভিযুক্ত করা হয়ছে।

সন্ত্রাস বিরোধী আইন অনুযায়ী সরাসরি হত্যাকাণ্ডে যুক্ত থাকার সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড। এছাড়া হত্যার পরিকল্পনা, হত্যাকাণ্ডে সহায়তা এবং নিষিদ্ধ সংগঠনের সাথে যুক্ততার অপরাধ প্রমাণিত হলে সর্বোচ্চ চৌদ্দ বছর পর্যন্ত বিভিন্ন মেয়াদে সাজা হতে পারে।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।