ইসলাম অবমাননা: বিমানবন্দর থেকে ব্লগার আসাদ নূর গ্রেপ্তার

কামরান রেজা চৌধুরী
2017.12.26
ঢাকা
Share on WhatsApp
Share on WhatsApp
ধর্ম অবমাননাকারীদের ব্যাপারে হেফাজত ইসলামের কর্মীদের বিক্ষোভ । ৫ মে ,২০১৩ ধর্ম অবমাননাকারীদের ব্যাপারে হেফাজত ইসলামের কর্মীদের বিক্ষোভের ফাইল ছবি । ৫ মে ,২০১৩
AP

নিরাপত্তার তাগিদে দেশান্তরী ব্লগার আসাদ নূর দেশে ফেরার পর তথ্য প্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারায় গ্রেপ্তার হয়েছেন। নেপাল যাওয়ার চেষ্টাকালে ঢাকায় হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে সোমবার রাত সাড়ে ৮ টার দিকে ইমিগ্রেশন পুলিশ তাকে আটক করে।

ধর্ম অবমাননার মামলা থাকায় বিমানবন্দরে তার ব্যাপারে আগে থেকেই রেড অ্যালার্ট জারি করা ছিল বলে জানিয়েছেন পুলিশ কর্মকর্তারা।

“আসাদের বিরুদ্ধে ওয়ারেন্ট ছিল। বিদেশ যাওয়ার পথে বিমান বন্দর থেকে ইমিগ্রেশন পুলিশ তাকে সোমবার রাতে গ্রেপ্তার করে। ইমিগ্রেশন পুলিশ তাকে আমাদের কাছে হস্তান্তর করলে মঙ্গলবার তাকে আদালতে হাজির করা হয়,” বেনারকে জানান বিমানবন্দর থানার ভারপ্রাপ্ত সহকারী কমিশনার রুহুল আমিন সাগর।

মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের বিচারক আসাদুজ্জামানের জামিন আবেদন প্রত্যাখ্যান করে তাকে জেলে পাঠিয়েছেন বলে জানান আদালত কারাগারের অফিসার ইন চার্জ মোতালেব মিয়া।

আসাদ নূরের পুরো নাম আসাদুজ্জামান নূর। এ বছরের ১১ জানুয়ারি বরগুনার আমতলী থানায় তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনের অধীনে ধর্ম অবমাননার দায়ে বরগুনায় তার বিরুদ্ধে মামলা করেন ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের আমতলী শাখার সভাপতি মুফতি ওমর ফারুক।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বেনারকে বলেন, “আইনগতভাবেই আসাদের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগগুলো খণ্ডন করতে হবে।”

ধর্মনিরপেক্ষ ব্লগার এবং লেখকদের জন্য বাংলাদেশ ঝুঁকিপূর্ণ স্থান হিসাবে বিভিন্ন সময় উল্লেখ করা হয়েছে।

২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে ধর্মনিরপেক্ষ কর্মী ও ব্লগার আহমেদ রাজীব হায়দারকে হত্যার পর থেকে অন্তত ১০ লেখক, ব্লগার, প্রকাশক, কর্মী ও বুদ্ধিজীবীরা ইসলামপন্থী জঙ্গিদের মারাত্মক হামলায় নিহত হন।

২০১৫ সালের শুরুর দিকে আরও অনেক হামলার ঘটনা ঘটেছে। ২০১৬ সালের এপ্রিল মাসে নাজিমুদ্দিন সামাদ  ছিলেন সর্বশেষ নিহত হওয়া ব্লগার। এসব হত্যাকাণ্ডের বিচার হয় না বলেও অভিযোগ রয়েছে।

তবে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী বলেন, “আমরা ব্লগার হত্যার তদন্ত করছি না—এ কথা ঠিক নয়। রাজীব হত্যাকারীদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে। বিচার চলছে। অচিরেই সকল অভিজিৎ রায়সহ সকল ব্লগার হত্যার তদন্ত শেষ করা হবে। সময় দিয়ে তদন্ত শেষ করা যায় না।”

এদিকে আসাদের সঙ্গে একই মামলায় অপর অভিযুক্ত ব্লগার লিমন ফকির তখন থেকেই কারাবন্দী আছেন বলে বেনারকে জানিয়েছেন আমতলী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা শহীদ উল্লাহ।

“মামলার পরপরই লিমন ফকিরকে গ্রেপ্তার করা হয়। কিন্তু আসাদ নূর পলাতক ছিলেন। সোমবার তিনি বিমানবন্দর দিয়ে নেপালে যাওয়ার সময় ইমিগ্রেশন পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করে,” জানান শহীদ উল্লাহ।

তিনি বলেন, “জানুয়ারিতে আসাদ ফেসবুকে ও ইউটিউবে ইসলাম ও নবী মোহাম্মদ (সাঃ) সম্পর্কে আপত্তিজনক পোস্ট লিখেছিলেন। এক স্থানীয় মাদ্রাসার অধ্যক্ষ আইসিটি আইনের ৫৭ ধারার অধীনে একটি মামলা দায়ের করলে পুলিশ অভিযোগ তদন্ত করে 'সত্যতা’ খুঁজে পায়।”

শহীদুজ্জামান বলেন, “মামলার পর আসাদ ভারতে গিয়ে আত্মগোপন করেছিলেন। আমরা তার বিষয়ে ইমিগ্রেশন পুলিশকে জানিয়ে রেখেছিলাম।”

বরগুনার এসপি বিজয় বসাক বেনারকে জানান, সোমবার সন্ধ্যার দিকে বিমানবন্দরের ইমিগ্রেশন পুলিশ তার নেপাল যাওয়ার খবর নিশ্চিত হয়ে বরগুনা পুলিশকে খবর দেয়।”

কষ্টকর প্রবাসে

দেশছাড়া হয়ে প্রবাস জীবনের নানাবিধ টানাপোড়েন আর কষ্টে দিনাতিপাত করছিলেন ব্লগার আসাদ নূর। ভিসা ছাড়া অবৈধভাবে ভারতে অবস্থানকালে তাদের কষ্টকর অভিজ্ঞতার কথা বেনারের কাছে বর্ণনা করেছেন পলাতক ভিডিও ব্লগার হাফেজ মওলানা মুফতি আবদুল্লাহ আল মাসুদ।

গত ৭ ডিসেম্বর আসাদকে পশ্চিম বাঙলার বনগাঁ সীমান্ত এলাকায় পৌছে দিয়েছিলেন এই মওলানা মাসুদ।

“আসাদ বাংলাদেশে যাওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছিল। আমি তাকে নিষেধ করলেও সে মানতে চায়নি। বাধ্য হয়ে আমি এবং সাজ্জাদ নামের আরেকজন প্রবাসী ব্লগার তাকে বনগাঁ পৌঁছে দেই,” বেনারকে বলেন মাসুদ।

পুরান ঢাকার একটি মসজিদের প্রাক্তন ইমাম এবং একটি কওমি মাদ্রাসার সাবেক মুহতামীম (প্রিন্সিপাল) মুফতি আবদুল্লাহ আল মাসুদ এক বছর আগে নাস্তিক ব্লগারদের দলে নাম লেখান। প্রাণ বাঁচানোর জন্য তিনিও ভারতে আশ্রয় নিয়েছেন এবং এত দিন আসাদ নূরের সাহচর্যে ছিলেন।

আসাদের বাংলাদেশে ফেরা কারণ প্রসঙ্গে তিনি টেলিফোনে বেনারকে বলেন, “বেশ কয়েকটি কারণ আছে। প্রথমত, দেশের টান। দ্বিতীয়ত, হতাশা। এখান থেকে পশ্চিমের কোনো দেশে আশ্রয় নিতে চাচ্ছিল। সে ব্যাপারে মানবাধিকার সংগঠনগুলোর পর্যাপ্ত সহযোগিতাও পায়নি।”

“ভারতে অবস্থানকালে তিনি প্রেমে পড়েন। একপর্যায়ে ভারতেই স্থায়ী হওয়ার কথা ভাবলেও সেই মেয়েটির সঙ্গে দ্বন্দ্ব তৈরি এবং পুলিশি ঝামেলার কারণে তাঁকে আশ্রয় ত্যাগ করতে হয়। তিনি মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন। এ অবস্থায় তার বাংলাদেশে ফেরার আকাঙ্ক্ষা বাড়ে,” বলেন মুফতি মাসুদ।

“সর্বোপরি আসাদের ভিসা ছিল না। ভিসা করতে বাংলাদেশ যাওয়া ছাড়া উপায় ছিল না। বাংলাদেশ থেকে ওর কিছু বন্ধু ওকে সব ধরনের সহযোগিতা করার আশ্বাস দিয়েছিল। তার ভিত্তিতে আসাদ বাংলাদেশে যায়,” তিনি জানান।

গত ৭ ডিসেম্বর আসাদ বনগাঁ পৌঁছালেও সেদিন প্রবেশ না করে পরে সুবিধাজনক সময়ে সে বাংলাদেশে প্রবেশ করে বলে জানান মাসুদ।

আসাদকে ঘনিষ্ঠ দাবি করে মাসুদ বলছিলেন, “মানুষের বাক স্বাধীনতা হরণ করার আইনে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। আমি মানসিকভাবে ভারাক্রান্ত। শুধু ভিন্ন মতের কারণে কাউকে এভাবে জেলে পুরতে হবে এটা কল্পনা করতেও খারাপ লাগে।”

ফেসবুকে উল্লাস ক্ষোভ

ব্লগার আসাদ গ্রেপ্তারের খবরে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক গরম হয়ে উঠেছে। দেশে বিদেশে অবস্থানরত সেক্যুলার ব্লগার এবং মানবাধিকার কর্মীরা আসাদ নূরকে গ্রেপ্তারের প্রতিবাদে মুখর হলেও এই গ্রেপ্তারে উল্লাস প্রকাশ করে ফেসবুকে পোস্ট দিচ্ছেন বাংলাদেশের ইসলামপন্থী ব্লগাররা। ফেসবুকে আসাদ নূরের মুক্তির দাবিতে একটি পেজ খোলা হয়েছে।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।