চার মাসে বিএনপির হাজারখানেক নেতা-কর্মীর সাজা নিয়ে প্রশ্ন
2023.12.11
ঢাকা

গত কয়েক মাসে বাংলাদেশের প্রধান বিরোধী দল বিএনপি ও এর অঙ্গ সংগঠনের প্রায় এক হাজার নেতা-কর্মীর বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দিয়েছে দেশের বিভিন্ন আদালত। এর মধ্যে মৃত্যুদণ্ড পেয়েছেন নয় জন।
সর্বশেষ ১০ বছর আগের একটি মামলায় সোমবার যুবদলের সাবেক সভাপতি সাইফুল আলম নীরবসহ বিএনপির ১০ নেতা-কর্মীকে তিন বছরের কারাদণ্ড দিয়েছে আদালত।
রাজধানীর তেজগাঁও থানায় নাশকতা ও গাড়িতে আগুন দেওয়ার অভিযোগে তাদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছিল। বিচারিক আদালতের কৌঁসুলি (পিপি) মো. আবদুল্লাহ আবু বেনারকে তথ্যের সত্যতা নিশ্চিত করেছেন।
আইনজীবী ও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ‘রাজনৈতিক’ মামলায় বিএনপি নেতা-কর্মীদের বেশির ভাগ সাজা পুলিশ সদস্যদের জবানবন্দির ওপর ভিত্তি করে হয়েছে। তাছাড়া এসব মামলার দ্রুত বিচার কাজ সম্পন্ন হওয়ায় ন্যায় বিচার নিশ্চিত হয়েছে কি না তা নিয়ে প্রশ্ন থেকে যায়।
এ প্রসঙ্গে বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বেনারকে জানান, চলতি বছরের আগস্ট মাস থেকে সোমবার পর্যন্ত মোট ৬১টি মামলায় নয় জনের মৃত্যুদণ্ড এবং ৯৯৮ জন নেতা-কর্মীকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে।
“বিএনপিকে নেতৃত্ব শূন্য করার প্রয়াসে সরকারের নির্দেশনায় মিথ্যা মামলায় ফরমায়েশি রায় দিচ্ছে আদালত। এসব রায়ে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা যাচ্ছে, বিএনপি নেতা-কর্মীদের দুই বছরের বেশি সাজা দেওয়া হচ্ছে; যাতে করে তারা নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার অযোগ্য হন,” বলেন রিজভী।
প্রসঙ্গত, বাংলাদেশের সংবিধানের ৬৬ (২) অনুচ্ছেদ অনুসারে, ফৌজদারি মামলায় দুই বছরের দণ্ডপ্রাপ্ত হলে কেউ নির্বাচনে অংশ নিতে পারবে না।
তফসিল অনুযায়ী, আগামী ৭ জানুয়ারি দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।
বিএনপির শীর্ষস্থানীয় প্রায় সব নেতা কয়েক ডজন করে মামলার আসামি এবং অনেকেই বিচারের মুখোমুখি।
চলতি মাসের শেষ ১১ দিনে ২০টি মামলায় বিএনপির অন্তত ২৪৮ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। এর আগে নভেম্বরে ৩৩টি মামলায় বিএনপির ৬১৫ জন, অক্টোবরে ছয় মামলায় ৭১ জন এবং আগস্টে তিনটি মামলায় ২৭ জনকে কারাদণ্ড দেওয়া দিয়েছে আদালত।
এ প্রসঙ্গে সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী এবং আইন ও সালিশ কেন্দ্রের চেয়ারপার্সন জেড আই খান পান্না বেনারকে বলেন, “সাম্প্রতিক সময়ে বিএনপিসহ বিরোধীদের বিরুদ্ধে আলাদিনের প্রদীপের মতো মামলাগুলো দ্রুত ও রাতারাতি শেষ হতে দেখে আমি বিস্মিত!
“বিএনপি নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে থাকা মামলার মতো অন্যান্য মামলাগুলো দ্রুত শেষ করার আহ্বান জানাচ্ছি; অন্যথায় এসব মামলায় দ্রুত বিচার হয়ে যাওয়ার ঘটনায় ন্যায়বিচার নিয়ে প্রশ্ন উঠবে,” যোগ করেন তিনি।
সাম্প্রতিক মাসগুলোতে যেসব মামলায় বিরোধী নেতা-কর্মীরা দোষী সাব্যস্ত হচ্ছেন, সেগুলোর বেশির ভাগই ২০১৩ থেকে ২০১৮ সালে দায়ের হওয়া। এসব মামলার বাদী, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সমর্থক নেতাকর্মী অথবা পুলিশ।
বিশেষ ক্ষমতা আইন, বিস্ফোরক দ্রব্য আইন ও দণ্ডবিধির অধীনে দায়ের করা এসব মামলা “রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত” বলে অভিহিত করেছে বিএনপি।
বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতা ও আইনজীবী মাসুদ আহমেদ তালুকদার বেনারকে বলেন, “সরকার বিএনপি নেতা-কর্মীদের মিথ্যা ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত মামলায় দ্রুত শাস্তি দিতে নিম্ন আদালতকে যেন দায়িত্ব দিয়েছে।”
বিএনপি নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে অস্বাভাবিক গতিতে বিচার চলছে দাবি করে এই আইনজীবী বলেন, “তারা আদালতে ন্যায়বিচার বঞ্চিত হচ্ছে।”
মৃত ও গুমের শিকার ব্যক্তিরও সাজা
নাশকতার অভিযোগে পুলিশের দায়ের করা সাম্প্রতিক কিছু মামলায় বিএনপির কয়েকজন মৃত ব্যক্তি ও এক দশক ধরে গুম আছেন এমন ব্যক্তিকে আদালত সাজা দিয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
গত ২৩ ও ২৯ নভেম্বর বিএনপির দুই মৃত ব্যক্তিকে সাজা দিয়েছে আদালত। ২৯ নভেম্বর সবুজবাগ থানায় ২০১২ সালে করা এক মামলায় বিএনপি ও এর অঙ্গ সংগঠনের ১৫ নেতা-কর্মীকে আড়াই বছরের কারাদণ্ড দেয় আদালত। এর মধ্যে ২০২১ সালের ১৩ জুলাই মারা যাওয়া ৭৩ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপির নেতা সোহরাওয়ার্দী চেয়ারম্যানকেও সাজা দেওয়া হয়েছে।
অন্যদিকে, ২০১৭ সালে পল্টন থানায় দায়ের হওয়া এক মামলায় ২৩ নভেম্বর বিএনপির ৩৬ নেতা-কর্মীকে চার বছরের কারাদণ্ড ও প্রত্যেককে পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা অনাদায়ে ১৭ দিন কারাদণ্ড দেওয়া হয়।
এই মামলার আইনজীবী আবু বক্কর সাংবাদিকদের জানান, মামলার আসামি তানভীর আদিল খান বাবু কয়েক বছর আগে মারা গেছেন।
২০১৩ সালের ডিসেম্বরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পরিচয়ে সাদা পোশাকে তুলে নেওয়ার পর থেকে নিখোঁজ শাহীনবাগের বিএনপি নেতা সাজেদুল ইসলাম সুমন। গাড়িতে আগুন দেওয়ার অভিযোগে দায়ের হওয়া একটি মামলায় তাকে আড়াই বছরের কারাদণ্ড দিয়েছে ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালত।
২০১৩ সালের ২৫ মে রাত সাড়ে ১১টার দিকে মহাখালী আয়েশা মেমোরিয়াল হাসপাতালের সামনে একটি প্রাইভেটকারে আগুন দেওয়ার ঘটনায় মামলাটি দায়ের হয়। আদালত ওই মামলার রায় ঘোষণা করে গত নভেম্বর মাসে।
এ প্রসঙ্গে পিপি আবদুল্লাহ বলেন, কোনো আসামি মারা গেলে তা আদালতকে অবহিত করার দায়িত্ব আসামিপক্ষের আইনজীবীর। এখানে বিচারিক প্রক্রিয়ার কোনো ত্রুটি নেই।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরামের মহাসচিব ও বিএনপির আইন বিষয়ক সম্পাদক ব্যারিস্টার কায়সার কামাল বেনারকে বলেন, “মৃত ব্যক্তিকে সাজা দেওয়া আইন ও সংবিধান পরিপন্থি।”
পুলিশের জবানবন্দির ভিত্তিতে সাজা
আইনজীবী মাসুদ তালুকদার বলেন, “সাজা দেওয়া বেশির ভাগ মামলায় দেখা গেছে, এসব মামলায় পুলিশ নিজেই বাদী, নিজেই সাক্ষী। শুধু পুলিশের জবানবন্দির ভিত্তিতে সাজা দেওয়া হচ্ছে। আসামিপক্ষের আইনজীবীরাও তাদের মক্কেলদের রক্ষা করার সুযোগ পাচ্ছেন না, এটা নজিরবিহীন ঘটনা।”
জেডআই খান পান্না বলেন, “আইনের শাসন নিশ্চিত হলে শুধুমাত্র পুলিশের জবানবন্দির ভিত্তিতে বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের দোষী সাব্যস্ত করার রায়গুলো উচ্চ আদালতে বহাল থাকবে না।”
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশের অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন বেনারকে বলেন, “বিচারিক প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে আদালত রায় ঘোষণা করছেন, এখানে অনিয়মের কিছু নেই।”
উল্লেখ্য, চলতি বছরের ২১ অক্টোবর ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে আইনজীবী মহাসমাবেশে সরকারবিরোধী আন্দোলনের সময় যানবাহনসহ নানা জায়গায় আগুন দিয়ে মানুষ হত্যার ঘটনায় যেসব মামলা হয়েছে, সেগুলো দ্রুত নিষ্পত্তির নির্দেশনা দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
তিনি বলেছিলেন, “যেসব জেলায় আগুন সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে, দ্রুত তাদের বিচার করতে হবে। কেউ অন্যায় করবে আর বিচার হবে না সেটা হতে পারে না।”