বয়কটের ডাকে দাম কমেছে তরমুজের, এবার গরুর মাংস
2024.04.04
ঢাকা
রমজানের শুরুতেই বাজারে আসা তরমুজের অস্বাভাবিক দাম মূলত বয়কটের মাধ্যমে অর্ধেকেরও নিচে নামিয়ে এনেছেন বাংলাদেশের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারকারীরা।
গ্রীষ্মের মৌসুমে তরমুজের এমনিতেই উচ্চ চাহিদা থাকে, যা আরো বেড়ে যায় একই সময়ে রমজান মাস শুরু হওয়ার কারণে। রসালো ও জনপ্রিয় এই ফলটির দাম কমানোর আন্দোলনে নেমে সাফল্যে পেয়ে ভোক্তারা এখন গরুর মাংস বয়কট করার ডাক দিয়েছেন।
“ভোক্তা সিন্ডিকেট” নামে বয়কট আন্দোলনে নামা ক্রেতারা এখন বিশ্বাস করছেন, তরমুজের মতোই সাফল্য মিলবে গরুর মাংসের ক্ষেত্রেও। উচ্চ মূল্যের কারণে গরুর মাংস দীর্ঘদিন ধরেই নিম্ন ও নিম্নমধ্যবিত্তের ক্রয়সীমার বাইরে।
মূলত বিভিন্ন নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে যখন সরকার যখন দীর্ঘদিন ধরে ব্যর্থ এবং বাজারের সিন্ডিকেট ভাঙতে অসহায়ত্ব প্রকাশ করে আসছিলেন, তখন গত সপ্তাহে তরমুজের দাম অর্ধেক বা অর্ধেকের নিচে নামিয়ে আনতে পারার এই প্রচারণা ইতিবাচক হিসেবে মূল্যায়িত হচ্ছে বিভিন্ন মহলে।
এবার রোজা শুরু হওয়ার পরপরই বাজারে আসে তরমুজ। এ সময় আকার ভেদে প্রতিটি তরমুজ ৭০০ টাকা থেকে ১,০০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছিল, যা নিয়ে মূল ধারার গণমাধ্যমে প্রতিবেদন এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে হইচই হয়।
প্রান্তিক পর্যায়ের চাষীরা এতো মূল্য না পেলেও বাজারে তরমুজের উচ্চমূল্য ভোক্তাদের ক্ষেপিয়ে তোলে এবং তার প্রেক্ষিতেই এই বয়কট আন্দোলনের ডাক আসে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। এর পাশাপাশি সরকারের পক্ষ থেকে নির্দিষ্ট কিছু এলাকায় ভ্রাম্যমাণ আদালদত বসিয়ে দাম নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা হিসেবে জরিমানা করা হয়।
গত দুই সপ্তাহের বয়কট প্রচারণার প্রেক্ষিতে এখন বাজারে এই মৌসুমি ফলটি বিক্রি হচ্ছে আকার ভেদে দেড়শ থেকে সাড়ে তিনশ টাকার মধ্যে।
যেভাবে কার্যকর হয় বয়কট প্রচারণা
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বয়কট আন্দোলনের অন্যতম প্রধান প্রচারক জসিম উদ্দিন খান বেনারকে বলেন, এই ধরনের অস্বাভাবিক দাম তাদের ভার্চুয়াল প্ল্যাটফর্ম তথা প্রধানত ফেসবুকে সামাজিক আন্দোলন শুরু করতে বাধ্য করেছে এবং পরবর্তীতে এই প্রচারণা ইতিবাচক প্রভাব সৃষ্টি করতে পেরেছে।
"তরমুজ যেহেতু একটি পচনশীল ফল, সেহেতু এটি দ্রুত কাজ করেছে। আমরা মাত্র দুই সপ্তাহের মধ্যে সফল হয়েছি,” বলেন জসিম।
তিনি বলেন, অনেক ব্যবসায়ী ক্রেতা না পেয়ে বেশকিছু তরমুজ ফেলে দিতে বাধ্য হয়ে এবং এরপর তারা অবিলম্বে দাম কমিয়ে দেয়।
তিনি বলেন, এখন সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহারকারীরা গরুর মাংসের দাম বর্জনের প্রচারণা শুরু করেছে, যার বর্তমানে ন্যূনতম দাম কেজি প্রতি ৭০০ টাকা।
"আমি বিশ্বাস করি ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেট ভাঙতে ভোক্তা সিন্ডিকেট সফল হবে,” যোগ করেন তিনি।
ঢাকার নন্দিপাড়া এলাকার বেসরকারি চাকরিজীবী মো. সোলিমান আহমেদ বৃহস্পতিবার বেনারকে বলেন, তিনি মাত্র তিনশ টাকায় বড় আকারের একটি তরমুজ কিনেছেন। অথচ একই আকারের একটি তরমুজ সাড়ে সাতশ টাকায় চাওয়ায় তিনি গত সপ্তাহে বাজার থেকে সেটি কেনেননি।
ঢাকার গ্রীনরোড এলাকার বাসিন্দা শামীমা আক্তার বেনারকে বলেন, ফেসবুকে তরমুজ না কেনার প্রচারণায় তারা সমর্থন করে পারিবারিকভাবে সিদ্ধান্ত নিয়ে এটা কেনা থেকে বিরত ছিলেন। সাত থেকে দশদিন পর দাম কমে আসলে তারা তরমুজ কেনা শুরু করেন।
রাজধানীর বাংলামোটর এলাকার ভোক্তা মুহাম্মদ জামান ক্রেতা বলেন, “যেহেতু প্রতিবাদে কাজ হয়েছে এখন আমি গরুর মাংস বয়কট করার বিষয়েও সিরিয়াস। আমি বিশ্বাস করি শিগগিরই গরুর মাংসের দাম কমবে।”
সেগুনবাগিচা এলাকার তরমুজ খুচরা বিক্রেতা মো. মোতালেব হোসেন বেনারকে জানান, মার্চের শেষ সপ্তাহে অন্তত পাঁচ দিন বিক্রি না থাকায় তিনি মারাত্মক লোকসানের সম্মুখীন হয়েছেন এবং নষ্ট হওয়ায় অন্তত ১০০ তরমুজ ফেলে দিতে বাধ্য হয়েছেন।
রাজধানীর সবচেয়ে বড় পাইকারি বাজার কাওরান বাজারের তরমুজ ব্যবসায়ী আক্তার মিয়া বেনারকে জানান, গত এক সপ্তাহে হঠাৎ করেই তরমুজের দাম কমে গেছে।
“সোশ্যাল মিডিয়া আন্দোলন নিয়ে আমাদের কোনো মন্তব্য নেই... এখন দাম খুবই কম। আমি মনে করি মানুষ এখন খুশি," যোগ করেন তিনি।
ইতিবাচক প্রভাব ফেলেছে সামাজিক বয়কট
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অর্থনীতি অধ্যাপক আব্দুল বায়েস বেনারকে বলেন, সামাজিক আন্দোলন সবসময়ই কিছু না কিছু ইতিবাচক প্রভাব ফেলে।
“এবার সোশ্যাল মিডিয়া বয়কট বাজারে প্রভাব ফেলেছে। একই সাথে এই প্রচারণা একটি বিষয় স্পষ্ট করেছে যে সরকার বাজার নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়েছে,” বলেন তিনি।
তিনি বলেন, কৃষকদের কোনো সিন্ডিকেট না থাকায় শেষ পর্যন্ত তারা বেশিরভাগ সময় ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত থাকে।
তিনি বলেন, মধ্যস্বত্বভোগীরা বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে এবং তাদের শক্তিশালী যোগসূত্র রয়েছে।
কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের এই প্রচারণাকে স্বাগত জানিয়ে বলেছেন, এটি বাজারে কিছু ইতিবাচক প্রভাব নিশ্চিত করতে সক্ষম হয়েছে।
বেনারের সাথে আলাপকালে তিনি বলেন, “দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি জনজীবনকে দুর্বিষহ করে তুলছে। বিশেষ করে নিম্নবিত্ত বা মধ্যবিত্ত কীভাবে জীবনযাপন করছে তা অনেকে কল্পনাও করতে পারে না। মানুষ তাদের সঞ্চয় ভেঙে বা ধার করে প্রতিদিনের প্রয়োজনে কেনাকাটা করছে।”
ব্যবসায়ীদের লোভই বাজারদর বৃদ্ধির কারণ উল্লেখ করে তিনি বলেন, এখন অধিকাংশ মন্ত্রী ও সংসদ সদস্য ব্যবসায়ী, ভোক্তা অধিকার উপেক্ষিত হওয়ার এটি বড় কারণ।
দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) সাবেক এই চেয়ারম্যান বলেন, “ভোক্তার অধিকার রক্ষায় দেশে অনেক আইন আছে। কিন্তু সংসদ ও সরকারে ব্যবসায়ীদের আধিপত্য থাকায় সেসব আইনের বাস্তবায়ন হচ্ছে না।”
দ্রব্যমূল্যের বিষয়ে জানতে চাইলে বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী আহসানুল ইসলাম টিটু বেনারকে বলেন, সরকার প্রয়োজনীয় মনিটরিং নিশ্চিত করায় রমজান মাসে কোনো পণ্যের দাম বাড়েনি।
সোশ্যাল মিডিয়ার প্রচারণা সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, “দেখুন, বাজারের ভারসাম্য বজায় রাখতে ভোক্তাদের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আমরা সোশ্যাল মিডিয়ায় এই প্রচারণার প্রশংসা করি।”
তিনি বলেন, তার সরকার এখন পণ্যের বাজার স্থিতিশীল রাখতে এবং সরবরাহ শৃঙ্খলা স্বাভাবিক করতে কাজ করছে।