বায়ু দূষণ: পাঁচ জেলার অবৈধ ইটভাটা বন্ধের নির্দেশ
2019.11.26
ঢাকা
পরিবেশ দূষণ রোধে রাজধানী ঢাকা ও এর আশেপাশের চার জেলার সব অবৈধ ইটভাটা আগামী ১৫ দিনের মধ্যে বন্ধ করার নির্দেশ দিয়েছে বাংলাদেশের উচ্চ আদালত।
এসব অবৈধ ইটভাটা বন্ধে প্রয়োজনে মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করতেও বলা হয়েছে। ঢাকা ছাড়াও নারায়ণগঞ্জ, মুন্সিগঞ্জ, গাজীপুর ও মানিকগঞ্জ জেলায় এসব অবৈধ ইটভাটা রয়েছে।
এসব ভাটায় ইট পোড়ানোর জন্য কাঠ ও কয়লা ব্যবহার করা হয়। পরিবেশ অধিদপ্তরের হিসাবে এই পাঁচটি জেলায় মোট ভাটার সংখ্যা প্রায় ১৩শ। এর মধ্যে ঢাকা জেলায় রয়েছে প্রায় সাড়ে চারশো ইটভাটা।
ঢাকা ও এর আশেপাশের এলাকায় বায়ু দূষণ রোধে একটি অভিন্ন নীতিমালা প্রণয়নের জন্যও পরিবেশ সচিবের নেতৃত্বে উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন কমিটি গঠনের আদেশ দিয়েছে আদালত। আগামী ৫ জানুয়ারির মধ্যে ওই কমিটিকে আদালতে প্রতিবেদন দিতে হবে।
একটি রিট আবেদনের শুনানির পরে মঙ্গলবার বিচারপতি এফ আর এম নাজমুল আহাসান ও বিচারপতি কে এম কামরুল কাদেরের হাইকোর্ট বেঞ্চ এ আদেশ দেন।
এই নির্দেশকে স্বাগত জানিয়ে পরিবেশ অধিদপ্তরের সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিচালক কাজী সারোয়ার ইমতিয়াজ হাশমি বেনারকে বলেন, “হাইকোর্ট যে সিদ্ধান্ত দিয়েছে তা অবশ্যই বাস্তবায়ন করতে হবে।”
গতকালের আদেশে বায়ু দূষণ রোধে রাস্তা, ফুটপাথ, ফ্লাইওভার, ওয়াকওভারের স্থানে জমিয়ে রাখা হয় বা জমে থাকা ধুলাবালি, ময়লা বা বর্জ্য-আবর্জনা সাত দিনের মধ্যে সিটি করপোরেশনকে অপসারণ করতে বলা হয়।
উচ্চ আদালতের নির্দেশনাটি এমন একটি সময়ে আসলো যখন বৈশ্বিক জরিপ বলছে, রাজধানী ঢাকার বায়ু দূষণ মারাত্মক বিপজ্জনক পর্যায়ে পৌঁছেছে।
বৈশ্বিকভাবে বায়ু দূষণ পর্যবেক্ষণকারী আন্তর্জাতিক সংস্থা এয়ার ভিজ্যুয়ালের পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী, গত ২৪ নভেম্বর সকাল সাতটা থেকে বিকেল সাড়ে পাঁচটা পর্যন্ত বেশির ভাগ সময় ঢাকাই ছিল বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত বায়ুর শহর।
সরকারের পদক্ষেপ কার্যকর নয়
রিট আবেদনের পক্ষে আদালতে আইনজীবী মনজিল মোরসেদ ও রাষ্ট্রপক্ষে ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল আবদুল্লাহ আল মাহমুদ বাশার শুনানি করেন। এছাড়া দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের পক্ষে আইনজীবী সাঈদ আহমেদ ও উত্তর সিটি করপোরেশনের পক্ষে তৌফিক ইনাম শুনানিতে অংশ নেন।
আইনজীবী মনজিল মোরসেদ বেনারকে বলেন, “রাজধানী ঢাকা এখন বায়ু দূষণের দিক থেকে এক নম্বর শহর। বায়ু দূষণ নিয়ন্ত্রণে আদালতের নির্দেশনা চেয়ে আমরা একটি আবেদন করেছিলাম।”
“ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন আদালতে হলফনামা দাখিল করে বলেছে যে, তারা পানি ছিটাচ্ছে। আর সরকারের পক্ষ থেকে জানানা হয়েছে যে, তারাও বায়ু দূষণ রোধে কাজ করছে। কিন্তু আমরা বলেছি তারা সবই করছে কিন্তু কার্যকর কিছু হচ্ছে না,” বলেন তিনি।
মনজিল মোরসেদ বলেন, “আদালতের কাছে আমরা ৫টি নির্দেশনা চেয়েছিলাম। তার মধ্যে আদালত তিনটি নির্দেশনা দিয়ে আদেশ দিয়েছেন।”
আগামী ৫ জানুয়ারি পরবর্তী আদেশের জন্য রাখা হয়েছে বলে জানান এই আইনজীবী।
এর আগে বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে ঢাকার বায়ুদূষণ নিয়ে প্রকাশিত খবর ও প্রতিবেদন যুক্ত করে গত ২৭ জানুয়ারি এই রিট আবেদনটি করে পরিবেশ ও মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশ (এইচআরপিবি)।
পরদিন ওই রিটের শুনানি নিয়ে রুলসহ দেওয়া আদেশে ঢাকা শহরে যারা বায়ুদূষণের কারণ সৃষ্টি করছে, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে সপ্তাহে দুইবার ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করতে পরিবেশ অধিদপ্তরকে নির্দেশ দেয় আদালত।
এছাড়া রাজধানীতে উন্নয়ন ও সংস্কার কাজ চলা জায়গাগুলো ১৫দিনের মধ্যে এমনভাবে ঘিরে ফেলার নির্দেশ দেয়, যাতে শুকনো মৌসুমে ধুলো ছড়িয়ে বায়ু দূষণ বাড়তে না পারে। পাশাপাশি ধুলোবালি প্রবণ এলাকাগুলোতে দিনে দুইবার করে পানি ছিটাতে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে ব্যবস্থা নিতে বলা হয়।
সবচেয়ে দূষিত শহর ঢাকা
এয়ার ভিজ্যুয়ালের তথ্য অনুযায়ী, এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্সে (একিউআই), মঙ্গলবার সন্ধ্যা সাতটায় ঢাকার বায়ুর গড় মান ছিল ১৬৯। বায়ুর এই মান অস্বাস্থ্যকর বলে উল্লেখ করা হয়েছে। একই সময়ে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের নয়াদিল্লীর বায়ুর গড় মান দেখা যায় ২৬৬, যা অত্যন্ত অস্বাস্থ্যকর।
তবে গত রোববার বায়ু দূষণ সূচকে বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত বায়ুর শহরের তালিকার শীর্ষে উঠে আসে ঢাকা।
এদিন একিউআইয়ে ঢাকার স্কোর ছিল ২৪২। যার অর্থ, ঢাকায় বাতাসের মান অত্যন্ত অস্বাস্থ্যকর ও ঝুঁকিপূর্ণ। গবেষকেরা বলছেন, চলতি মাসে এ পর্যন্ত আট দিন (দিনের বেশির ভাগ সময়) ঢাকা ছিল বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত বায়ুর শহর।
উল্লেখ্য, প্রতিদিনের বাতাসের মান নিয়ে তৈরি করা একিউআই সূচকে ৫১ থেকে ১০০ স্কোর থাকার অর্থ বাতাসের মান গ্রহণযোগ্য। ১০১ থেকে ১৫০ স্কোরের অর্থ বাতাসের মান দূষিত। আর কোনো শহরে বায়ুর স্কোর ২০১ থেকে ৩০০-এর মধ্যে থাকলে ওই এলাকার বাসিন্দাদের মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকি থাকে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রাজধানীতে অনিয়ন্ত্রিত উন্নয়ন প্রকল্পের কারণে একযোগে রাস্তা খোঁড়া হচ্ছে, আর এ কারণে বায়ু দূষণের মাত্রা বেড়েছে। জরুরি ভিত্তিতে খোঁড়াখুঁড়ি বন্ধ করা এবং গাছ লাগানো এবং প্রতিদিন রাস্তাগুলোতে পানি দেওয়ার ব্যবস্থা করার মাধ্যমে এই দূষণ কমাতে পরামর্শ দিয়েছেন তাঁরা।
কাজী সারোয়ার ইমতিয়াজ হাশমি বেনারকে বলছিলেন, “ঢাকায় একদিকে খোঁড়াখুঁড়ির ধুলার কারণে দূষণ বেড়েছে, অন্যদিকে গাছের সংখ্যা কমেছে। আমাদের প্রচুর গাছ লাগাতে হবে।”
“নির্মাণকাজ যত দ্রুত সম্ভব শেষ করতে হবে। নিয়মিত পানি ছিটাতে হবে। নির্মাণ সামগ্রী সবসময় ঢেকে রাখতে হবে। আমরা এ সময় যদি ফোয়ারাগুলো চালু রাখতে পারি তাহলে ওইসব এলাকার দূষণ কিছুটা হলেও কমবে,” বলেন তিনি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক ড. আব্দুস সালাম বেনারকে বলেন, বেশ কিছুদিন ধরে বৃষ্টি না হওয়া, ঢাকার চারদিক থেকে দূষিত বাতাস আসা, ঢাকায় খোঁড়াখুঁড়ির পরিমাণ বেড়ে যাওয়া এবং কন্সট্রাকশনের কারণে ধূলিকণা বাড়ছে এবং চলতি মাসে ইটভাটাগুলো চালু হওয়ার কারণেই মূলত ঢাকার বায়ু দূষণ আরও বেড়ে গেছে।”
প্রসঙ্গত, শুকনো মৌসুমেই ভাটাগুলোতে বেশিরভাগ ইট উৎপাদন হয়।