আগুনে পোড়া মুমূর্ষু রোগীর চিকিৎসা এখনও ঢাকা কেন্দ্রিক

আহম্মদ ফয়েজ
2024.04.12
ঢাকা
আগুনে পোড়া মুমূর্ষু রোগীর চিকিৎসা এখনও ঢাকা কেন্দ্রিক একটি বাণিজ্যিক ভবনে আগুন লেগে দগ্ধ এক রোগীর পরিবার সদস্যরা ঢাকার একটি হাসপাতালের বাইরে অপেক্ষা করছেন। ১ মার্চ ২০২৪। এপি
এপি

বাংলাদেশে ক্রমাগত বাড়ছে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা। তবে সে তুলনায় দেশজুড়ে চিকিৎসা সেবা এখনও অপ্রতুল রয়ে গেছে।  প্রত্যন্ত এলাকায় কেউ আগুনে পুড়লে তার জন্য পরিস্থিতি ভয়াবহ হয়ে ওঠে, কারণ এখন পর্যন্ত এই চিকিৎসা মূলত ঢাকা কেন্দ্রিক।

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটের ৩০০ শয্যা এবং শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের ৫০০ শয্যাই এখন পর্যন্ত আগুনে পোড়া রোগীদের জন্য সর্বোচ্চ সেবা নেওয়ার জায়গা।

এর বাইরে দীর্ঘ জটিলতার পর, গত কয়েক বছরে দেশের বিভাগীয় কয়েকটি শহরের হাসপাতালগুলোতে বার্ন ইউনিট স্থাপন হয়েছে।

এসব হাসপাতালে চিকিৎসক ও সরঞ্জামের অভাবে রোগীরা প্রয়োজনীয় সেবা থেকে বঞ্চিত হওয়ায় আগুনে পোড়া রোগীদের পুরো চাপ সামাল দিতে হয় ঢাকার দুটি প্রতিষ্ঠানকে।

নতুন বার্ন ইউনিটগুলোর অবস্থা বেহাল

বরিশালের শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ (শেবাচিম) হাসপাতালে আট বছর আগে চালু হয়েছিল বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিট। তবে কোনো রোগী একটু বেশি দগ্ধ হয়ে হাসপাতালে গেলে তাকে ঢাকায় পাঠিয়ে দেওয়া হয়।

হাসপাতালের পরিচালক ডা. এইচএম সাইফুল ইসলাম বেনারকে বলেন, “পর্যাপ্ত চিকিৎসক ও সরঞ্জামের অভাবে চাইলেও অনেক রোগীকে চিকিৎসা দেওয়া সম্ভব হয় না।”

খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ২০১৪ সালে ২০ শয্যার বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিট চালু হলেও নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র (আইসিইউ) ও অস্ত্রোপচার কক্ষ (ওটি) না থাকায় সংকটাপন্ন রোগীদের ঢাকাতে পাঠাতে হয় বলে জানিয়েছেন হাসপাতালটির উপপরিচালক ডা. হুসাইন শাফায়াত।

তিনি বেনারকে বলেন, “এখানে নানা রকম সংকট আছে, তবে এসব থেকে বেরিয়ে আসার জন্য নতুন উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। নির্মিত হচ্ছে নতুন বার্ন ইউনিট।”

স্বাস্থ্য অধিকার আন্দোলনের চেয়ারম্যান ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. রশিদ-ই-মাহবুব বেনারকে বলেন, “দেশের স্বাস্থ্য খাতের অবস্থাটাই এমন যে, সব কিছু ঢাকা কেন্দ্রিক। তবে আগুনে পোড়া রোগীদের ক্ষেত্রে এই অভিজ্ঞতাটা আসলেই ভয়াবহ।”

বর্তমান স্বাস্থ্যমন্ত্রী এ বিষয়ে খুবই আন্তরিক মন্তব্য করে তিনি বলেন, “এবার হয়তো এই খাতে কিছুটা হলেও উন্নতি আসবে।”

জেলায় জেলায় বার্ন ইউনিট করার উদ্যোগ

বাংলাদেশের চিকিৎসা খাতে আগুনে পোড়া রোগীদের জন্য চিকিৎসা নিশ্চিত করতে সবচেয়ে বেশি সক্রিয় ছিলেন প্রখ্যাত বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জন অধ্যাপক ডা. সামন্ত লাল সেন। তিনি গত কয়েক দশক ধরে কাজ করেছেন আগুনে পোড়া রোগীদের চিকিৎসা নিশ্চিত করতে।

আওয়ামী লীগ টানা চতুর্থবার সরকার গঠনের সময় মন্ত্রিসভায় ডাক পান এই চিকিৎসক। তার হাতেই এখন স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের ভার।

দেশের কিছু কিছু হাসপাতালে বার্ন ইউনিট স্থাপন করা হলেও যন্ত্রপাতির অভাব রয়েছে তা অকপটে স্বীকার করেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী।

বেনারের সঙ্গে আলাপকালে মঙ্গলবার তিনি বলেন, “এটা সত্য যে, এখনো আগুনে পোড়া রোগীদের চিকিৎসার প্রধান ভরসা ঢাকা। এর মূল কারণ হচ্ছে প্রান্তিক পর্যায়ে আমার চিকিৎসাটা পৌঁছে দিতে পারিনি।”

আগুনে পোড়া রোগী অন্যান্য রোগীর মতো নয় জানিয়ে তিনি বলেন, “একজন ব্যক্তি যদি পঞ্চগড় জেলায় আগুনে পোড়েন, তাহলে তাকে যদি চিকিৎসার জন্য ঢাকায় ছুটতে হয়, সেটা ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি তৈরি করে।”

আগুনে পোড়া রোগীর জন্য আক্রান্ত হওয়ার প্রথম ২৪ ঘণ্টাকে চিকিৎসা বিজ্ঞানে ‘গোল্ডেন আওয়ার’ বলা হয় জানিয়ে তিনি বলেন, “এই সময়ের মধ্যে একজন আগুনে পোড়া রোগীকে চিকিৎসকের শরণাপন্ন করা গেলে রোগীর জন্য ভীষণ উপকার হতে পারে। এর পর যখন একজন রোগীকে হাসপাতালে আনা হবে, সে ক্ষেত্রে ওই রোগীর বার্ন যদি ৫০ শতাংশের বেশি হয় বা শ্বাসনালী আক্রান্ত হয়ে থাকে, তাহলে তার জীবন বিপন্ন হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।”

“দেশের প্রতিটি জেলায় বার্ন ইউনিট করার পরিকল্পনা রয়েছে আমাদের সরকারের। এই লক্ষ্যে আমরা কাজ করে যাচ্ছ,” বলেন তিনি।

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটের তথ্য অনুসারে, দেশে প্রতি বছর আনুমানিক ছয় লাখ অগ্নিদগ্ধ মানুষ হাসপাতালে যান।

আগুনে পোড়া রোগীর অভিজ্ঞতা

২০২১ সালে শীত মৌসুমে আগুন পোহাতে গিয়ে দগ্ধ হন লক্ষ্মীপুরের রায়পুর উপজেলার মাসুদুর রহমান।

“আমার গায়ে আগুন লেগে বুক থেকে পা পর্যন্ত পুড়ে যায়।  এলাকার ও পরিবারের লোকেরা আমাকে সদর হাসপাতালে নিয়ে যান।  সেখানে প্রাথমিক চিকিৎসা নেওয়ার জন্য প্রায় ছয় ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হয়, এরপর আমাকে ঢাকায় পাঠিয়ে দেয়া হয়,” বলেন মাসুদ।

“ঢাকায় আসার সময় অ্যাম্বুলেন্সের ড্রাইভার আমার আত্মীয়দের বুঝিয়ে একটি বেসরকারি হাসপাতালে নিয়ে যায়।  সেখানে প্রায় দেড় লাখ টাকা বিল হয় তিন দিনে, কিন্তু আমার পরিস্থিতির উন্নতি হয়না,” বলেন তিনি।

মাসুদ বলেন, “পরবর্তীতে এক আত্মীয় আমাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে নিয়ে যায়, সেখানে আমি সঠিক চিকিৎসা পেয়েছি।  কিন্তু যেহেতু এই হাসপাতালে পৌঁছাতে আমার অনেক দেরি হয়ে গেছে সেহেতু এখনো আমার শরীরে কিছু দাগ থেকে গেছে যা স্বাভাবিকভাবে কখনোই সেরে যাবে না।”

5016eada-1c6d-47c2-bea8-9f52ecc3f13c.jpg
ঢাকার হাজারীবাগ বস্তিতে অগ্নি নির্বাপণের কাজ করছেন ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা। ১২ এপ্রিল ২০২৪। [সনি রামানী/বেনারনিউজ]

দেশে বাড়ছে অগ্নিকাণ্ড

ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের পরিসংখ্যান বলছে, দেশে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা বাড়ছে। প্রতিষ্ঠানটির হিসাব মতে, ২০২৩ সালে দেশে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে ২৭ হাজার ৬২৪টি, ২০২২ সালে ছিল ২৪ হাজার ১০২টি ও ২০২১ সালে ২১ হাজার ৬০১টি দুর্ঘটনা ঘটেছে।

পরিসংখ্যান বলছে, দেশে গত নয় বছরে কমপক্ষে এক লাখ ৯০ হাজারের বেশি অগ্নি দুর্ঘটনার ঘটনা ঘটেছে, যাতে হাজারের বেশি মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন।

সর্বশেষ দুটি বড় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় বেইলী রোডের একটি ভবনে আগুন লেগে ৪৬ জন এবং গাজীপুরে গ্যাস সিলিন্ডার থেকে অগ্নিকাণ্ডে ১৭ জন প্রাণ হারিয়েছেন।

দেশে ২০১৫ সালের পর থেকে গত কয়েক বছরে রাজধানী ঢাকার বঙ্গবাজার ও নিউ মার্কেটসহ বেশ কয়েকটি বড় অগ্নিদুর্ঘটনা ঘটেছে।

উল্লেখ্য, ২০১৯ সালে পুরান ঢাকার চুড়িহাট্টায় আগুনে ৭১ জনের মৃত্যু হয়, বনানীর এফআর টাওয়ারে আগুনে ২৭ জন, ২০২১ সালে মগবাজার ওয়্যারলেস এলাকায় একটি ভবনের নিচতলায় আগুনে ১২ জনের মৃত্যু হয়।  এছাড়া ওই বছর নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে সজীব গ্রুপের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান হাসেম ফুড অ্যান্ড বেভারেজ লিমিটেডের কারখানায় আগুনে অর্ধশতাধিক ব্যক্তি প্রাণ হারান এবং গত বছর বঙ্গবাজার কমপ্লেক্সের পাশাপাশি ঢাকা নিউ সুপার মার্কেটসহ আরও পাঁচটি মার্কেটে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে।

ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মাইন উদ্দিন বেনারকে বলেন, দেশে প্রতিনিয়ত আগুন লাগার ঘটনা বাড়তে থাকার পেছনে নানা রকম কারণ রয়েছে, তবে একটি বিষয় এখানে দেখা যায় যে, মানুষ অগ্নি নিরাপত্তা খাতে অর্থ খরচ করতে চায় না।

“একইসঙ্গে একটি দুর্ঘটনা ঘটে গেলে তার চিকিৎসা কী হবে সেসব নিয়েও নানা মহলে পূর্ব পরিকল্পনার অভাব দেখা যায়। আগুনের ঘটনা কমাতে হলে মানুষকে ভবনের নিরাপত্তায় জোর দিতে হবে এবং একটি ঘটনার পর করণীয় সম্পর্কেও সচেতন হতে হবে,’ যোগ করেন তিনি।

ঈদের পরদিন অন্তত চারটি আগুন

ঈদের পরদিন ঢাকা ও চট্টগ্রামসহ দেশের অন্তত চারটি স্থানে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে।

এর মধ্যে সবচেয়ে গুরুতর ঘটনাটি ঘটেছে রাজধানীতে। মিরপুরের ভাসানটেকে গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণে নারী-শিশুসহ ৬ জন দগ্ধ হয়েছেন। তারা সবাই একই পরিবারের সদস্য।

শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের আবাসিক চিকিৎসক ডা. তরিকুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, দগ্ধের পরিমাণ বেশি হওয়ায় তাদের সবার অবস্থা আশঙ্কাজন।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।