চীনা কোম্পানিকে জরিমানা করেছে বাংলাদেশের কাস্টমস বিভাগ
2024.04.08
ঢাকা
বাংলাদেশ সরকারের দেওয়া শুল্কমুক্ত সুবিধার অপব্যবহার করে জরিমানার মুখে পড়েছে চীনের রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন প্রকৌশল ও নির্মাণ প্রতিষ্ঠান সিনোহাইড্রো কর্পোরেশন লিমিটেড।
বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য ২০১৪ সাল থেকে শুল্কমুক্ত সুবিধায় ৯০ টি আমদানি চালানের মাধ্যমে আসা যন্ত্রপাতি ও পণ্য নির্দিষ্ট মেয়াদ শেষে ফেরত নেওয়ার শর্ত থাকলেও তা মানেনি সিনোহাইড্রো। এমনকি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকেও তারা বিষয়টি অবহিত করেনি।
এই প্রেক্ষাপটে গত তিন সপ্তাহ ধরে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) আওতাধীন চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউজ অন্তত ৪০টি আমদানি চালানের অনিয়ম চিহ্নিত করে প্রতিষ্ঠানটিকে শুল্ক-কর ও অন্যান্য জরিমানা পরিশোধের জন্য দাবিনামা জারি করেছে।
এর একটি অনুলিপি বেনারের হাতে এসেছে, যা গত ২০ মার্চ অভিযুক্ত প্রতিষ্ঠান ও তার স্থানীয় প্রতিনিধিকে (ক্লিয়ারিং এন্ড ফরোয়ার্ডিং বা সিএন্ডএফ এজেন্ট) পাঠানো হয়। চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউজের কমিশনার মোহাম্মদ ফাইজুর রহমান ও উপ-কমিশনার কাজী ইরাজ ইশতিয়াক দাবিনামায় সাক্ষর করেন।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে কাজী ইরাজ ইশতিয়াক সোমবার বেনারকে বলেন, “এখন পর্যন্ত ৩৬টি চালানোর বিপরীতে দাবিনামা জারি করা হয়েছে। আরো পাঁচটি শিগগিরই পাঠানো হবে।”
তিনি বলেন, “প্রতিষ্ঠানটির প্রতিনিধিরা আমাদের সঙ্গে দেখা করে তাদের অনিয়মের বিষয়টি স্বীকার করেছেন এবং এই অর্থ তারা পরিশোধ করে দেওয়ার কথা জানিয়েছেন।”
তিনি বলেন, ৯০টির বেশি চালানোর ক্ষেত্রে তাদের অনিয়ম পাওয়া গেছে। সব চালানোর জন্য আমরা যে দাবিনামা জারি করবো, তার ভাষা প্রায় একই, কেবল পন্যের দর অনুযায়ী টাকার পরিমাণে পরিবর্তন হবে।”
তবে এর ফলে সবমিলিয়ে দাবিকৃত শুল্ককর বা জরিমানার পরিমাণ কত, সে তথ্য জানাতে পারেননি তিনি।
তবে কাস্টমস কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, যেসব চালান আমদানি করা হয়েছে, তার প্রতিটির মূল্য ২০ লাখ টাকা থেকে দুই কোটি টাকা পর্যন্ত। এসব পণ্য চালানোর উপর শুল্ককরের পরিমাণ ৬৪ শতাংশ পর্যন্ত। অর্থাৎ নিয়ম লঙ্ঘন করায় প্রতিষ্ঠানটিকে সর্বোচ্চ এ হারে কর দিতে হবে। এর সঙ্গে রয়েছে ৪০০ শতাংশ পর্যন্ত জরিমানা।
বেনারের হাতে আসা ওই দাবিনায় বলা হয়, “ফেরত নেওয়ার শর্তে আমদানিকৃত পণ্য যথাসময়ে পুন:রপ্তানি করতে ব্যর্থ হওয়ার অপরাধ স্বীকার করে আমদানিকারক (সিনোহাইড্রো কর্পোরেশন) সংক্ষিপ্ত বিচারের আবেদন করেছে।”
এতে বলা হয়, প্রতিষ্ঠানটি সংঘটিত অনিয়মের দায় স্বীকার করেছে।
অভিযোগের বিষয়ে জানতে সিনোহাইড্রোর ঢাকায় অবস্থিত স্থানীয় কার্যালয়ে সোমবার মেইল পাঠানো হয় বেনারের পক্ষ থেকে।
এর একদিন আগে রোববার মেইল পাঠানো হয় ঢাকায় অবস্থিত চীনা দূতাবাসের ই-মেইলে। তবে সোমবার রাত আটটায় এ প্রতিবেদন লেখার সময় পর্যন্ত কোনও জবাব পাওয়া যায়নি।
তবে কাস্টমসের দাবিনামা সম্বলিত ওই আদেশে সিনোহাইড্রো ছাড়াও প্রতিষ্ঠানটির পণ্য চালান আমদানি ও বন্দর থেকে খালাসের দায়িত্বে থাকা চট্টগ্রামের সাইফুল মাইনুল এন্ড কোম্পানিকে শুল্ককর ও জরিমানার অর্থ আদায় করে সরকারের কোষাগারে জমা দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়।
এই সূত্র ধরে জানতে চাইলে প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক এএনএম শহীদুল ইসলাম চৌধুরী ২৯টি চালানের চিঠি পাওয়ার কথা স্বীকার করেন।
বেনারকে তিনি বলেন, “আমরা কেবল ওইসব পণ্য বন্দর থেকে ছাড় করার প্রক্রিয়া সম্পন্ন করেছি। এরপর তারা ওই পণ্য ফেরত নিয়েছে কিনা, তা জানা নেই।”
“তারা (সিনোহাইড্রো) কাস্টমস কর্তৃপক্ষের সঙ্গে দেখা করেছে এবং দাবিনামার অর্থ পরিশোধ করার কথা জানিয়েছে,” জানান শহীদুল ইসলাম।
লজিস্টিক খাত বিশেষজ্ঞ ও ইন্টারন্যাশনাল ফাইন্যান্স কর্পোরেশনের সাবেক জ্যেষ্ঠ অর্থনীতিবিদ ড. এম মাশরুর রিয়াজ বেনারকে বলেন, “আমাদের প্রকল্প বাস্তবায়ন ও বাস্তবায়ন পরবর্তী যে তদারকির অভাব রয়েছে, সিনোহাইড্রোর এ ঘটনা তারই বড় প্রমাণ।”
জরিমানার বিষয়ে তিনি বলেন, “কাস্টমসের এ সিদ্ধান্ত ইতিবাচক। কোন দেশ বা কোন কোম্পানি, তা বিবেচনা না করে আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে হবে।”
বিক্রি করে শুল্ক ফাঁকি দিয়েছে সিনোহাইড্রো?
কাস্টমসের নিয়ম অনুযায়ী, বিভিন্ন প্রকল্পে ব্যবহার হওয়া আমদানিকৃত যন্ত্রপাতি ও পণ্য ব্যবহার করার পর তা ফেরত নিতে হবে।
ফেরত নিতে না পারলে সময় বাড়ানোর জন্য আবেদন করতে হবে কিংবা প্রযোজ্য শুল্ককর পরিশোধ করে তা ব্যবহার করা যাবে। কিন্তু এই নিয়মের ব্যত্যয় করেছে সিনোহাইড্রো।
কাস্টমস বিভাগের একজন সিনিয়র কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বেনারকে বলেন, “যেসব পন্যের জন্য দাবিনামা জারি করা হয়েছে, ওগুলো তারা সম্ভবত স্থানীয়ভাবে বিক্রি করে দিয়েছে।”
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে এএনএম শহীদুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, “তারা এসব যন্ত্রপাতি বিক্রি করেছে কিনা, তা আমাদের জানা নেই।”
অবশ্য ঢাকা থেকে প্রকাশিত দ্য ডেইলি স্টারের গত ৩১ ডিসেম্বর প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়, “সিনোহাইড্রো গত নয় বছরে একটি পণ্যও ফেরত নেয়নি। প্রতিষ্ঠানটি আমদানি বিধি লঙ্ঘন করে বাংলাদেশে এসব নির্মাণ সামগ্রী ও ভারী যন্ত্রপাতি বিক্রি করেছে এবং এখনো বিক্রি করছে।”
ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, “শুল্কমুক্ত সুবিধায় গত ৯ বছরে প্রায় ১০৩ মিলিয়ন ডলার বা এক হাজার ১৪৫ কোটি টাকার যন্ত্রপাতি, যানবাহন ও আনুষঙ্গিক পণ্য আমদানি করেছে সিনোহাইড্রো।”
আমদানি করা এসব পণ্যের মধ্যে রযেছে ডাম্প ট্রাক, ফর্কলিফট, ডিজেল ইঞ্জিন, কংক্রিট মিক্সিং ট্রাক, কেবল, সাবমারসিবল পাম্প, জেনারেটর, ট্রাক ক্রেন, লোডার, বুলডোজার, রোড রোলার, এক্সকাভেটর, মিক্সিং প্ল্যান্ট, সিলিন্ডার, স্টিল পাইপ, ড্রেজার ও রাবার পাইপ ইত্যাদি।
এই অনিয়ম প্রসঙ্গে বাংলাদেশ-চায়না চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রির (বিসিসিআই) সাধারন সম্পাদক আল মামুন মৃধা বেনারকে বলেন, “প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে স্থানীয় আইনের প্রতি আমরা শ্রদ্ধাশীল। এ বিষয়ে ব্যত্যয় হলে, কেউ অনিয়ম করলে–তা সমর্থন করি না।”
“তবে কিছু প্রকল্প বাস্তবায়নে অস্বাভাবিক দেরি হওয়ার কারনে যন্ত্রপাতি স্ক্র্যাপে পরিণত হয়, ফলে তা ফেরত নেওয়ার খরচ বেড়ে যায়, এ বিষয়টিও বিবেচনায় রাখতে হবে,” যোগ করেন আল মামুন মৃধা।
উল্লেখ্য, সিনোহাইড্রো কর্পোরেশন পদ্মা বহুমুখী সেতু প্রকল্পের নদীশাসন প্রকল্প ছাড়াও বিদ্যুৎ খাত ও অবকাঠামোসহ বেশকিছু বড় প্রকল্প বাস্তবায়নে যুক্ত ছিল এবং আছে। আমদানি হওয়া যন্ত্রপাতির বেশিরভাগই আমদানি হয়েছে চট্টগ্রাম বন্দরের মাধ্যমে, যার শুল্ক-করের বিষয়টি দেখভালের দায়িত্ব চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউজের।