বাবা-মায়ের পরিচয় না জানায় অধিকার বঞ্চিত হাজারো মানুষ

পুলক ঘটক
2019.06.27
ঢাকা
190627_Parents_identity_620.jpg ঢাকার কামরাঙ্গির চরে একটি ডাস্টবিনের ওপর দাঁড়ানো এক পথশিশু। বাংলাদেশে পথশিশু বা পরিবার থেকে হারিয়ে যাওয়া শিশুসহ অনেকেই পিতা-মাতার পরিচয় দিতে না পারায় বিভিন্ন নাগরিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হন। ১৫ জুন ২০১৯।
[সৌজন্যে: এ আর সুমন]

“আমার মা একজন যৌনকর্মী। আমি আমার বাবার নাম জানি না। কীভাবে বলব বাবার নাম? তবুও এসবি অফিসার আমার আকুতি মানতে রাজি নন। তিনি আমাকে বললেন, পাসপোর্ট হবে না,” বেনারকে বলছিলেন সুদীপ্তা মেহজাবিন (ছদ্মনাম)।

দৌলতদিয়া যৌনপল্লীর সন্নিকটে কর্মজীবী কল্যাণ সংস্থা (কেকেএস) পরিচালিত স্কুলে তাঁর পড়াশুনা শুরু হয়েছিল। কঠিন জীবনসংগ্রামে ধাপে ধাপে উত্তীর্ণ হয়ে তিনি সম্মানসহ স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেছেন।

২০০৭ সালে হেপাটাইটিস-বি ভাইরাসের সংক্রমণে জীবন সংকট তৈরি হলে ডাক্তাররা তাঁকে উন্নত চিকিৎসার জন্য ভারতে যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন। কিন্তু স্পেশাল ব্রাঞ্জ (এসবি) অফিসারের অসহযোগিতার কারণে তাঁর পার্সপোর্ট হয়নি।

সুদীপ্তার মতো অসংখ্য মানব সন্তান বাবার পরিচয় জানেন না। অনেকেই মায়ের পরিচয়ও জানেন না। অথচ বাংলাদেশের প্রায় সকল দাপ্তরিক কাজে বাবা-মায়ের নাম প্রকাশ বাধ্যতামূলক।

জন্ম নিবন্ধন, স্কুলে ভর্তি, সাধারণ পরীক্ষায় অংশগ্রহণ, ব্যাংক হিসাব খোলা, ভোটার তালিকায় নাম ওঠানো, জাতীয় পরিচয়পত্র, পাসর্পোট, চাকরি, সম্পত্তি ক্রয়বিক্রয়সহ সকল ধরনের নিবন্ধনের জন্য নিজের নামের সঙ্গে পিতামাতার নাম উল্লেখ করতে হয়।

এরকম বাস্তবতায় তাঁদেরকে মিথ্যা বাবা-মায়ের পরিচয়ে টিকে থাকতে হয়। দৌলতদিয়া যৌনপল্লী ছাড়াও অনাথ শিশুদের বিভিন্ন আশ্রয় কেন্দ্র ঘুরে এবং ভুক্তভোগীদের সঙ্গে কথা বলে বেনার প্রতিনিধি এই চিত্র দেখেছেন।

শুধু যৌনকর্মীর সন্তানরা নয়; পথ শিশু, বা পরিবার থেকে হারিয়ে যাওয়া শিশু, স্বামী পরিত্যক্তা নারীর সন্তান এবং ধর্ষণ কিংবা গণ-ধর্ষণের শিকার নারীর সন্তানরা পিতার পরিচয় দিতে না পারায় সবকিছু থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। অনিচ্ছা সত্ত্বেও অনেক মানুষকে নিজের নামের সঙ্গে অস্তিত্বহীন বাবার নাম জুড়ে দিতে বাধ্য করার বেশকিছু নজির পাওয়া গেছে।

আইন কী বলছে?

বাংলাদেশের সংবিধানে “সকল নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান” বলা হলেও বাস্তবে জন্ম পরিচয়ের কারণে অসংখ্য মানুষ মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।

আইন ও বিধিমালার স্ববিরোধী অবস্থান এবং ক্ষেত্রবিশেষে আইনি শূন্যতার কারণে বহু মানুষ ভুগছেন বলে জানিয়েছেন আইনবীদরা।

“যুগ যুগ ধরে এই অবস্থা চলে আসলেও আইন সংশোধনের কোনও উদ্যোগ নেই,” আক্ষেপ করে বলেছেন মানবাধিকার কর্মী খুশি কবির।

সমাজের পুরুষতান্ত্রিক প্রচলন হিসেবে দীর্ঘকাল থেকে সকল দাপ্তরিক কাজে ব্যক্তির নিজের নামের সঙ্গে বাবার নাম লেখার রীতি চলে আসছে। ২০০০ সালের ২৭ আগস্ট মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয় থেকে জারি করা এক প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, এখন থেকে বাংলাদেশে সন্তানের পরিচিতি উল্লেখ করতে সব ক্ষেত্রে বাবার নামের পাশাপাশি বাধ্যতামূলকভাবে মায়ের নাম উল্লেখ করতে হবে।

“ঐ গেজেটে সমস্যার সমাধান না হয়ে তা আরও জটিল হয়েছে,” বলেন খুশি কবির।

এ প্রসঙ্গে তিনি গত ১৪ আগস্ট শেরে বাংলা নগর হাসপাতালের বাথরুম থেকে উদ্ধারকৃত শিশুটির প্রসঙ্গ উল্লেখ করে বলেন, “যে মা-বাবা ঐ শিশুটিকে ওভাবে ফেলে রেখে গেছে, সেই মা-বাবার পরিচয় দিতে শিশুটিকে কেন বাধ্য করা হবে?”

বাংলাদেশে প্রচলিত মুসলিম পারিবারিক আইনমতে সন্তান দত্তক নেওয়া অবৈধ বলে বেনারকে জানান বিশিষ্ট আইনজ্ঞ ও মানবাধিকার কর্মী ড. সারা হোসেন।

তিনি বলেন, “ফলে পরিচয়হীন অনাথ শিশুদের চাইলেও কেউ দত্তক নিতে পারে না। দত্তকের পরিবর্তে আদালত অনেকক্ষেত্রে পরিচয়হীন শিশুর জিম্মাদার হিসেবে কোনো ব্যক্তিকে দায়িত্ব দেয়। তাতে সংকট কাটে না। একজন শিশু তার জিম্মাদারদের বাবা-মা ডাকলেও সন্তান হিসেবে সম্পত্তি ও অন্যান্য অধিকার পায় না।”

এ প্রসঙ্গে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বেনারকে জানান, “বাবা অথবা মায়ের পরিচয় না জানা ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে অথবা বাবা কিংবা মায়ের নাম লিখতে অনিচ্ছুক ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে অভিভাবক হিসেবে কার নাম লেখা হবে সেব্যাপারে সুনির্দিষ্ট কোনও আইন নেই।”

পরিচয় সংকটে থাকা ব্যক্তিদের ভোটার তালিকায় নাম ওঠানো কিংবা জাতীয় পরিচয়পত্র প্রদানের ক্ষেত্রে কী বিধান অনুসরণ করা হয় জানতে চাইলে আইন বা বিধিতে এ বিষয়ে সুষ্পষ্ট কিছু বলা নেই বলে জানান নির্বাচন কমিশনার কবিতা খানম।

তিনি বলেন, “যৌনপল্লীর সন্তানদের ক্ষেত্রে তাদের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে পরিচয়পত্র দেওয়া হয়। তবে প্রায় সবাই বাবার পরিচয় হিসেবে কোনো না কোনও একটা নাম বলে।”

এ বিষয়ে আইন ও বিধিমালা সুস্পষ্ট করা উচিত বলে মনে করেন কবিতা খানম।

আদালতের রুল

মায়ের কাছে মানুষ হওয়া ঠাকুরগাও জেলার এক মেয়ে ২০০৭ সালে এসএসসি পরীক্ষার ফরম পূরণের সময় বাবার নাম উল্লেখ করেনি। এ কারণে রাজশাহী শিক্ষাবোর্ড তাকে পরীক্ষায় প্রবেশপত্র দেয়নি এবং মেয়েটির শিক্ষাজীবন সেখানেই শেষ হয়ে যায়।

ঐ ঘটনায় বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট (ব্লাস্ট), মহিলা পরিষদ এবং নারীপক্ষ যৌথভাবে হাইকোর্টে একটি রিট আবেদন করেছিল। আবেদন শুনানির পর ২০০৯ সালের ৩ আগস্ট হাইকোর্ট একটি রুল জারি করে।

এসএসসি অথবা এইচএসসি পরীক্ষায় অংশগ্রহণের জন্য বাবার নাম লেখার বাধ্যবাধকতা কেন অসাংবিধানিক বা অবৈধ ঘোষণা করা হবে না তা জানতে চায় আদালত। সরকার পক্ষ এর জবাব না দেওয়ায় আজ পর্যন্ত সেই রুলের শুনানি হয়নি।

“যুদ্ধশিশুদের বিষয়ে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘যে শিশুর বাবার পরিচয় নাই সেখানে লিখে দাও শেখ মুজিবুর রহমান’। তিনি রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব নিয়েছিলেন। রাষ্ট্রকেই এরকম ক্ষেত্রে দায়িত্ব নিতে হয়। বাবা বা মায়ের নাম লেখার বাধ্যবাধকতা থাকা উচিত নয়। এগুলো ঐচ্ছিক হতে পারে,” বলেন খুশি কবির।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।