জলবায়ু চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সরে যাওয়ায় ক্ষতির মুখে বাংলাদেশ
2025.01.31
ঢাকা

প্যারিস চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্র সরে যাওয়ার ফলে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় বৈশ্বিক যে রাজনৈতিক মতৈক্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল তাতে ফাটল অনিবার্য হয়ে উঠেছে বলে মনে করছেন জলবায়ু বিশেষজ্ঞরা।
তাদের আশঙ্কা, যুক্তরাষ্ট্রকে অনুসরণ করে অনেক উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশ প্যারিস চুক্তির বাধ্যবাধতকা ভুলে কার্বন নিঃসরণ চালিয়ে যাবে, ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর প্রতি দায়িত্ব পালনও করবে না।
এর ফলে বিশ্বে কার্বন নিঃসরণ কমবে না এবং বাংলাদেশসহ সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর অস্তিত্ব হুমকির মুখে পড়তে পারে বলে আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা।
সবচেয়ে বড় ক্ষতি রাজনৈতিক
প্যারিস চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্র প্রত্যাহারের বিষয়টি ‘দুঃখজনক’ উল্লেখ করে পরিবেশ অধিদপ্তরের জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক শাখার পরিচালক মির্জা শওকত আলী বেনারকে বলেন, বছরের পর বছর আলোচনার ভিত্তিতে ও বিলিয়ন ডলার খরচ করে প্যারিস চুক্তি স্বাক্ষর হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র সরে যাওয়ার ফলে উন্নত দেশগুলোর যে অর্থ দেওয়ার কথা তা পাওয়া কঠিন হয়ে যাবে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, যুক্তরাষ্ট্র থাকলে বিশ্বের অধিকাংশ দেশই তাদের সাথে তাল মেলাতে প্যারিস চুক্তির আওতায় দায়িত্ব পালন করত।
“জলবায়ু পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় বৈশ্বিক যে রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল সেটি আর থাকবে না। ইউরোপীয় দেশগুলো রাজনৈতিক কমিটমেন্ট থেকে সরে না গেলেও যুক্তরাষ্ট্র চলে যাওয়ার ফলে কিছু দেশ তাদের দায়িত্ব এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করবে। যেমন অর্থ প্রদান ও দুষণ কমানোর ক্ষেত্রে অস্ট্রেলিয়া, কানাডার আগ্রহ কমতে পারে বলে আমাদের আশঙ্কা,” যোগ করেন শওকত আলী।
“এছাড়াও বিশ্বের সবচেয়ে বড় দুষণকারী দেশ চীন এবং আরেক দুষণকারী দেশ ভারতও যুক্তরাষ্ট্রের দোহাই দিয়ে চুক্তির আওতায় তাদের দায়িত্ব বা প্রতিশ্রিুতি থেকে সরে যেতে চাইবে,” মনে করেন এই বিশেষজ্ঞ।
বাংলাদেশ ক্ষতিগ্রস্ত হবে
বাংলাদেশে জলবায়ু অভিযোজনের জন্য বিভিন্ন প্রকল্পের টাকা মূলত সরকারি উৎস থেকে পেয়ে থাকে। তবুও বৈশ্বিক উৎস থেকে টাকা পাওয়া জরুরি এবং তা কঠিন হয়ে উঠবে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
২০২৩ সালে প্রকাশিত বৈশ্বিক ঝুঁকি সূচক অনুযায়ী, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বিশ্বের যেসব দেশ ক্ষতিগ্রস্ত হবে সেগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান নবম।
জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক জাতিসংঘের অধীন আন্ত-সরকারি সংস্থার বিশেষজ্ঞদের মতে, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সৃষ্ট সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি এবং উপকূলীয় অঞ্চলে ভাঙ্গনের কারণে ২০৫০ সাল নাগাদ বাংলাদেশের ১৭ ভাগ অঞ্চল সমুদ্রে তলিয়ে যাবে। এই সময়ের মধ্যে দেশের খাদ্য উৎপাদন শতকরা ৩০ ভাগ কমে আসবে।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ও জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত অর্থায়ন সংক্রান্ত গবেষক শারমিন্দ নীলর্মী বলেন, “বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবির্তনের অন্যতম ক্ষতিগ্রস্ত দেশ। কিন্তু আন্তর্জাতিক উৎস থেকে পাওয়া অর্থের পরিমাণ খুবই কম। গ্রিন ক্লাইমেট ফান্ড থেকে মাত্র ৫০০ মিলিয়ন ডলার মিলেছে। এই অর্থ বাংলাদেশের অর্থনীতির আকৃতি বিবেচনায় নিলে তেমন কিছুই না। জলবায়ু ট্রাস্ট ফান্ডের মাধ্যমে সরকার নিজস্ব অর্থায়নের মাধ্যমে অভিযোজন প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে।”
এছাড়া আরও কয়েকটি উৎস থেকে ১২০ মিলিয়ন ডলার সহায়তা এসেছে বাংলাদেশে বলে জানান তিনি।
বাংলাদেশের গ্রামীণ উন্নয়ন বিষয়ক সংস্থা পল্লী কর্ম সহায়ক ফাউন্ডেশন (পিকেএসএস) জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত দরিদ্র মানুষদের নিয়ে কাজ করে।
সংস্থাটির মহাপরিচালক এ. কে. এম. নুরুজ্জামান বেনারকে বলেন, প্যারিস চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সরে যাওয়া জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলার ক্ষেত্রে বিরাট একটি ধাক্কা। এর ফলে জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য বরাদ্দকৃত অর্থের পরিমাণ কমবে।
পিকেএসএস মহাপরিচালক বলেন, “জলবায়ু পরিবর্তন সম্পর্কিত আলোচনা আন্তর্জাতিক কূটনীতি এবং রাজনীতির অংশ। এখানে অনেক রাজনীতি কাজ করে। যুক্তরাষ্ট্র চলে যাওয়ার পর দেখা যাবে জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়টি অনেক দেশ হয়তো সিরিয়াসলি নেবে না।”
আন্তর্জাতিক রাজনীতির বিষয়ে উদাহরণ দিয়ে ড. নুরুজ্জামান বলেন, বাংলাদেশসহ বিভিন্ন ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলো অভিযোজনের জন্য অর্থ চায়। অর্থাৎ ক্ষতিগ্রস্তদের দারিদ্র দূর করতে এবং পরিবর্তিত জলবায়ুর সাথে মিলিয়ে তাঁদের জীবন-জীবিকা রক্ষা করতে অর্থ সহায়তা চায়।
তিনি বলেন, “এখনই একটি ১০ মিলিয়ন ডলারের একটি অভিযোজন প্রকল্প ছাড় করতে বাংলাদেশের প্রায় পাঁচ বছর লেগেছে। টাকা কমলে সেই সমস্যা আরও বাড়তে পারে।”
উল্লেখ্য, গত ২০ জানুয়ারি দায়িত্ব নেওয়ার পর নির্বাহী আদেশের মাধ্যমে ২০২৫ সালে স্বাক্ষরিত প্যারিস চুক্তি থেকে সরে যাওয়ার ঘোষণা দেন ট্রাম্প। তিনি নবায়নযোগ্য জ্বালানীর পরিবর্তে তেল-গ্যাস অনুসন্ধান চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেন।
এর আগে গত ২০২১ সালের ২০ জানুয়ারি প্রেসিডেন্ট বাইডেন দায়িত্ব গ্রহণের প্রথম দিনেই যুক্তরাষ্ট্র আনুষ্ঠনিকভাবে প্যারিস চুক্তিতে পুনরায় যোগদান করে।
ইউরোপীয় কমিশনের ২০২৪ সালের প্রতিবেদন অনুসারে, চীন, আমেরিকা, ভারত, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, রাশিয়া ও ব্রাজিল সম্মিলিতভাবে বৈশ্বিক মোট উৎপাদিত কার্বনের মোট ৫০ ভাগ উৎপাদন করে। এর মধ্যে চীনের কার্বন নিঃসরণের পরিমাণ শতকরা ৩০ ভাগ, যুক্তরাষ্ট্রের প্রায় ১৫ ভাগ।
ওয়ার্ল্ড রিসোর্সেস ইন্সটিটিউট বলছে, বাংলাদেশসহ নীচের দিকের ১০০ সবচেয়ে কম দূষণকারী দেশগুলো সম্মিলিতভাবে শতকরা তিনভাগের কম কার্বন নিঃসরণ করে। বাংলাদেশ বৈশ্বিক মোট উৎপাদিত কার্বনের দশমিক পাঁচ ভাগ উৎপাদন করে।
ড. শারমিন্দ নীলর্মী বেনারকে বলেন, প্যারিস চুক্তি থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র চলে যাওয়ার ফলে চীনসহ অন্যান্য দেশ যারা কার্বন নিঃসরণের জন্য বেশি দায়ী সেসব দেশগুলো তাদের দায় এড়িয়ে যেতে চাইবে। এর ফলে সবচেয়ে বেশি নেতিবাচক ফলাফল ভোগ করবে বাংলাদেশসহ গরীব ও স্বল্পোন্নত দেশগুলো।”
লাভবান হতে পারে চীন
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও জ্বালানি এবং পরিবেশ বিষয়ক গবেষক ড. ইজাজ হোসেন বুধবার বেনারকে বলেন, “ট্রাম্পের মেয়াদে নবায়নযোগ্য জ্বালানীর প্রতি তার সরকারের প্রাধান্য না থাকলেও মার্কিন কোম্পানিগুলো যারা নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে বিনিয়োগ করেছে তারা ব্যবসা বন্ধ করবে না।”
“কারণ বিশ্বে নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবসা দ্রুত প্রসার ঘটছে। এভাবে বাড়তে থাকলে এক পর্যায়ে যুক্তরাষ্ট্রও জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে সরে এসে নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে চলে আসবে,” যোগ করেন তিনি।
ড. ইজাজ বলেন, “তবে প্যারিস চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্র প্রত্যাহারের কারণে চীন নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবসায় কিছুটা এগিয়ে যাবে বলা যায়। চীন ইতোমধ্যে নির্ধারিত সময়সীমার আগেই তার নবায়নযোগ্য জ্বালানির লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করেছে।”
তিনি বলেন, “ট্রাম্প নতুন করে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের ওপর জোর দেওয়ায় বিশ্ববাজারে তেল-গ্যাসের সরবরাহ বাড়বে। তেল-গ্যাসের দাম কমবে। এবং এর ফলে আমাদের জন্য কিছুটা সুবিধা আনবে।”
বাংলাদেশ সোলার অ্যাণ্ড রিনিউয়েবল এনার্জি অ্যাসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট নুরুল আক্তার বেনারকে বলেন, “মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহারে বসে নেই। ব্যক্তি পর্যায়ে অসংখ্য বাসাবাড়িসহ প্রতিষ্ঠানে নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহৃত হচ্ছে।”

ইন্টারন্যাশনাল এনার্জি এজেন্সির তথ্য অনুসারে, নবায়নযোগ্য জ্বালানি ছয় প্রযুক্তি সোলার, বায়ু, বৈদুতিক গাড়ি, ব্যাটারি, ইলেকট্রলেসার এবং তাপচালিত পাম্পের বৈশ্বিক বাজার আকৃতি ২০২৩ সালে ৭০০ বিলিয়ন ডলার এবং ২০৩৫ সালে তা বেড়ে দাঁড়াবে দুই ট্রিলিয়ন ডলারে। এই বাজার আকৃতি বৈশ্বিক অপরিশোধিত তেলের বাজারের সমান।
উল্লেখ্য, বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবের মধ্যে রয়েছে ভূপৃষ্ঠের তাপমাত্রা বৃদ্ধি, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, অনাবৃষ্টি, অতিবৃষ্টি, বন্যা, জলাবদ্ধতা, লবণাক্ততা, খাদ্য সঙ্কট, স্বাস্থ্যঝুঁকিসহ বিভিন্ন প্রতিকূল পরিস্থিতি।
বিশ্বে জলবায়ু পরিবর্তনের মূল কারণ হলো, শিল্পায়নের ফলে ব্যবহৃত জীবাশ্ম জালানি যেমন কয়লা, পেট্রোলিয়াম পণ্য, গ্যাস ইত্যাদি পোড়ানোর ফলে জলবায়ুতে অতিমাত্রায় কার্বন ডাই অক্সাইডসহ বিভিন্ন ক্ষতিকর পদার্থ যোগ হয়।
এ ছাড়া কৃষিকাজের ফলে জলবায়ুতে মিথেন গ্যাস উৎপাদিত হয়। এসব গ্যাসের কারণে ভূ-পৃষ্ঠের তাপমাত্রা বৃদ্ধি পায় এবং অ্যান্ট্যার্কটিকা অঞ্চলসহ বিভিন্ন শীত প্রধান অঞ্চলে বাড়তি বরফ গলে যোগ হয়ে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি পাচ্ছে।
এর ফলে বাংলাদেশসহ সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে নিচু স্থানে অবস্থিত দেশগুলোর অস্তিত্ব হুমকির মুখে পড়ছে। কিন্তু বৈশ্বিক এই পরিবর্তনে জন্য দরিদ্র ও অনুন্নত দেশগুলো দায়ী নয়।
প্যারিস চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্র সরে যাওয়ার ফলে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় বৈশ্বিক যে রাজনৈতিক মতৈক্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল তাতে ফাটল অনিবার্য হয়ে উঠেছে বলে মনে করছেন জলবায়ু বিশেষজ্ঞরা।
তাদের আশঙ্কা, যুক্তরাষ্ট্রকে অনুসরণ করে অনেক উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশ প্যারিস চুক্তির বাধ্যবাধতকা ভুলে কার্বন নিঃসরণ চালিয়ে যাবে, ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর প্রতি দায়িত্ব পালনও করবে না।
এর ফলে বিশ্বে কার্বন নিঃসরণ কমবে না এবং বাংলাদেশসহ সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর অস্তিত্ব হুমকির মুখে পড়তে পারে বলে আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা।
সবচেয়ে বড় ক্ষতি রাজনৈতিক
প্যারিস চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্র প্রত্যাহারের বিষয়টি ‘দুঃখজনক’ উল্লেখ করে পরিবেশ অধিদপ্তরের জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক শাখার পরিচালক মির্জা শওকত আলী বেনারকে বলেন, বছরের পর বছর আলোচনার ভিত্তিতে ও বিলিয়ন ডলার খরচ করে প্যারিস চুক্তি স্বাক্ষর হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র সরে যাওয়ার ফলে উন্নত দেশগুলোর যে অর্থ দেওয়ার কথা তা পাওয়া কঠিন হয়ে যাবে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, যুক্তরাষ্ট্র থাকলে বিশ্বের অধিকাংশ দেশই তাদের সাথে তাল মেলাতে প্যারিস চুক্তির আওতায় দায়িত্ব পালন করত।
“জলবায়ু পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় বৈশ্বিক যে রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল সেটি আর থাকবে না। ইউরোপীয় দেশগুলো রাজনৈতিক কমিটমেন্ট থেকে সরে না গেলেও যুক্তরাষ্ট্র চলে যাওয়ার ফলে কিছু দেশ তাদের দায়িত্ব এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করবে। যেমন অর্থ প্রদান ও দুষণ কমানোর ক্ষেত্রে অস্ট্রেলিয়া, কানাডার আগ্রহ কমতে পারে বলে আমাদের আশঙ্কা,” যোগ করেন শওকত আলী।
“এছাড়াও বিশ্বের সবচেয়ে বড় দুষণকারী দেশ চীন এবং আরেক দুষণকারী দেশ ভারতও যুক্তরাষ্ট্রের দোহাই দিয়ে চুক্তির আওতায় তাদের দায়িত্ব বা প্রতিশ্রিুতি থেকে সরে যেতে চাইবে,” মনে করেন এই বিশেষজ্ঞ।
বাংলাদেশ ক্ষতিগ্রস্ত হবে
বাংলাদেশে জলবায়ু অভিযোজনের জন্য বিভিন্ন প্রকল্পের টাকা মূলত সরকারি উৎস থেকে পেয়ে থাকে। তবুও বৈশ্বিক উৎস থেকে টাকা পাওয়া জরুরি এবং তা কঠিন হয়ে উঠবে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
২০২৩ সালে প্রকাশিত বৈশ্বিক ঝুঁকি সূচক অনুযায়ী, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বিশ্বের যেসব দেশ ক্ষতিগ্রস্ত হবে সেগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান নবম।
জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক জাতিসংঘের অধীন আন্ত-সরকারি সংস্থার বিশেষজ্ঞদের মতে, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সৃষ্ট সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি এবং উপকূলীয় অঞ্চলে ভাঙ্গনের কারণে ২০৫০ সাল নাগাদ বাংলাদেশের ১৭ ভাগ অঞ্চল সমুদ্রে তলিয়ে যাবে। এই সময়ের মধ্যে দেশের খাদ্য উৎপাদন শতকরা ৩০ ভাগ কমে আসবে।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ও জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত অর্থায়ন সংক্রান্ত গবেষক শারমিন্দ নীলর্মী বলেন, “বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবির্তনের অন্যতম ক্ষতিগ্রস্ত দেশ। কিন্তু আন্তর্জাতিক উৎস থেকে পাওয়া অর্থের পরিমাণ খুবই কম। গ্রিন ক্লাইমেট ফান্ড থেকে মাত্র ৫০০ মিলিয়ন ডলার মিলেছে। এই অর্থ বাংলাদেশের অর্থনীতির আকৃতি বিবেচনায় নিলে তেমন কিছুই না। জলবায়ু ট্রাস্ট ফান্ডের মাধ্যমে সরকার নিজস্ব অর্থায়নের মাধ্যমে অভিযোজন প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে।”
এছাড়া আরও কয়েকটি উৎস থেকে ১২০ মিলিয়ন ডলার সহায়তা এসেছে বাংলাদেশে বলে জানান তিনি।
বাংলাদেশের গ্রামীণ উন্নয়ন বিষয়ক সংস্থা পল্লী কর্ম সহায়ক ফাউন্ডেশন (পিকেএসএস) জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত দরিদ্র মানুষদের নিয়ে কাজ করে।
সংস্থাটির মহাপরিচালক এ. কে. এম. নুরুজ্জামান বেনারকে বলেন, প্যারিস চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সরে যাওয়া জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলার ক্ষেত্রে বিরাট একটি ধাক্কা। এর ফলে জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য বরাদ্দকৃত অর্থের পরিমাণ কমবে।
পিকেএসএস মহাপরিচালক বলেন, “জলবায়ু পরিবর্তন সম্পর্কিত আলোচনা আন্তর্জাতিক কূটনীতি এবং রাজনীতির অংশ। এখানে অনেক রাজনীতি কাজ করে। যুক্তরাষ্ট্র চলে যাওয়ার পর দেখা যাবে জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়টি অনেক দেশ হয়তো সিরিয়াসলি নেবে না।”
আন্তর্জাতিক রাজনীতির বিষয়ে উদাহরণ দিয়ে ড. নুরুজ্জামান বলেন, বাংলাদেশসহ বিভিন্ন ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলো অভিযোজনের জন্য অর্থ চায়। অর্থাৎ ক্ষতিগ্রস্তদের দারিদ্র দূর করতে এবং পরিবর্তিত জলবায়ুর সাথে মিলিয়ে তাঁদের জীবন-জীবিকা রক্ষা করতে অর্থ সহায়তা চায়।
তিনি বলেন, “এখনই একটি ১০ মিলিয়ন ডলারের একটি অভিযোজন প্রকল্প ছাড় করতে বাংলাদেশের প্রায় পাঁচ বছর লেগেছে। টাকা কমলে সেই সমস্যা আরও বাড়তে পারে।”
উল্লেখ্য, গত ২০ জানুয়ারি দায়িত্ব নেওয়ার পর নির্বাহী আদেশের মাধ্যমে ২০২৫ সালে স্বাক্ষরিত প্যারিস চুক্তি থেকে সরে যাওয়ার ঘোষণা দেন ট্রাম্প। তিনি নবায়নযোগ্য জ্বালানীর পরিবর্তে তেল-গ্যাস অনুসন্ধান চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেন।

এর আগে গত ২০২১ সালের ২০ জানুয়ারি প্রেসিডেন্ট বাইডেন দায়িত্ব গ্রহণের প্রথম দিনেই যুক্তরাষ্ট্র আনুষ্ঠনিকভাবে প্যারিস চুক্তিতে পুনরায় যোগদান করে।
ইউরোপীয় কমিশনের ২০২৪ সালের প্রতিবেদন অনুসারে, চীন, আমেরিকা, ভারত, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, রাশিয়া ও ব্রাজিল সম্মিলিতভাবে বৈশ্বিক মোট উৎপাদিত কার্বনের মোট ৫০ ভাগ উৎপাদন করে। এর মধ্যে চীনের কার্বন নিঃসরণের পরিমাণ শতকরা ৩০ ভাগ, যুক্তরাষ্ট্রের প্রায় ১৫ ভাগ।
ওয়ার্ল্ড রিসোর্সেস ইন্সটিটিউট বলছে, বাংলাদেশসহ নীচের দিকের ১০০ সবচেয়ে কম দূষণকারী দেশগুলো সম্মিলিতভাবে শতকরা তিনভাগের কম কার্বন নিঃসরণ করে। বাংলাদেশ বৈশ্বিক মোট উৎপাদিত কার্বনের দশমিক পাঁচ ভাগ উৎপাদন করে।
ড. শারমিন্দ নীলর্মী বেনারকে বলেন, প্যারিস চুক্তি থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র চলে যাওয়ার ফলে চীনসহ অন্যান্য দেশ যারা কার্বন নিঃসরণের জন্য বেশি দায়ী সেসব দেশগুলো তাদের দায় এড়িয়ে যেতে চাইবে। এর ফলে সবচেয়ে বেশি নেতিবাচক ফলাফল ভোগ করবে বাংলাদেশসহ গরীব ও স্বল্পোন্নত দেশগুলো।”
লাভবান হতে পারে চীন
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও জ্বালানি এবং পরিবেশ বিষয়ক গবেষক ড. ইজাজ হোসেন বুধবার বেনারকে বলেন, “ট্রাম্পের মেয়াদে নবায়নযোগ্য জ্বালানীর প্রতি তার সরকারের প্রাধান্য না থাকলেও মার্কিন কোম্পানিগুলো যারা নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে বিনিয়োগ করেছে তারা ব্যবসা বন্ধ করবে না।”
“কারণ বিশ্বে নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবসা দ্রুত প্রসার ঘটছে। এভাবে বাড়তে থাকলে এক পর্যায়ে যুক্তরাষ্ট্রও জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে সরে এসে নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে চলে আসবে,” যোগ করেন তিনি।
ড. ইজাজ বলেন, “তবে প্যারিস চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্র প্রত্যাহারের কারণে চীন নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবসায় কিছুটা এগিয়ে যাবে বলা যায়। চীন ইতোমধ্যে নির্ধারিত সময়সীমার আগেই তার নবায়নযোগ্য জ্বালানির লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করেছে।”
তিনি বলেন, “ট্রাম্প নতুন করে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের ওপর জোর দেওয়ায় বিশ্ববাজারে তেল-গ্যাসের সরবরাহ বাড়বে। তেল-গ্যাসের দাম কমবে। এবং এর ফলে আমাদের জন্য কিছুটা সুবিধা আনবে।”
বাংলাদেশ সোলার অ্যাণ্ড রিনিউয়েবল এনার্জি অ্যাসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট নুরুল আক্তার বেনারকে বলেন, “মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহারে বসে নেই। ব্যক্তি পর্যায়ে অসংখ্য বাসাবাড়িসহ প্রতিষ্ঠানে নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহৃত হচ্ছে।”
ইন্টারন্যাশনাল এনার্জি এজেন্সির তথ্য অনুসারে, নবায়নযোগ্য জ্বালানি ছয় প্রযুক্তি সোলার, বায়ু, বৈদুতিক গাড়ি, ব্যাটারি, ইলেকট্রলেসার এবং তাপচালিত পাম্পের বৈশ্বিক বাজার আকৃতি ২০২৩ সালে ৭০০ বিলিয়ন ডলার এবং ২০৩৫ সালে তা বেড়ে দাঁড়াবে দুই ট্রিলিয়ন ডলারে। এই বাজার আকৃতি বৈশ্বিক অপরিশোধিত তেলের বাজারের সমান।
উল্লেখ্য, বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবের মধ্যে রয়েছে ভূপৃষ্ঠের তাপমাত্রা বৃদ্ধি, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, অনাবৃষ্টি, অতিবৃষ্টি, বন্যা, জলাবদ্ধতা, লবণাক্ততা, খাদ্য সঙ্কট, স্বাস্থ্যঝুঁকিসহ বিভিন্ন প্রতিকূল পরিস্থিতি।
বিশ্বে জলবায়ু পরিবর্তনের মূল কারণ হলো, শিল্পায়নের ফলে ব্যবহৃত জীবাশ্ম জালানি যেমন কয়লা, পেট্রোলিয়াম পণ্য, গ্যাস ইত্যাদি পোড়ানোর ফলে জলবায়ুতে অতিমাত্রায় কার্বন ডাই অক্সাইডসহ বিভিন্ন ক্ষতিকর পদার্থ যোগ হয়।
এ ছাড়া কৃষিকাজের ফলে জলবায়ুতে মিথেন গ্যাস উৎপাদিত হয়। এসব গ্যাসের কারণে ভূ-পৃষ্ঠের তাপমাত্রা বৃদ্ধি পায় এবং অ্যান্ট্যার্কটিকা অঞ্চলসহ বিভিন্ন শীত প্রধান অঞ্চলে বাড়তি বরফ গলে যোগ হয়ে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি পাচ্ছে।
এর ফলে বাংলাদেশসহ সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে নিচু স্থানে অবস্থিত দেশগুলোর অস্তিত্ব হুমকির মুখে পড়ছে। কিন্তু বৈশ্বিক এই পরিবর্তনে জন্য দরিদ্র ও অনুন্নত দেশগুলো দায়ী নয়।