ফিলিপাইনে পরিবর্তনশীল জলবায়ু মোকাবেলায় সক্ষম নতুন ধান উদ্ভাবন
2023.07.27
লস বানোস, ফিলিপাইন
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে ঝুঁকিপূর্ণ দেশ ফিলিপাইনে চরম তাপমাত্রা, খরা, বন্যা এবং লবণাক্ততার মুখেও টিকে থাকতে সক্ষম বিভিন্ন জাতের নতুন ধান উদ্ভাবন করেছে আন্তর্জাতিক ধান গবেষণা কেন্দ্র (ইরি)।
ম্যানিলায় প্রতিষ্ঠানটির সদরদপ্তরে বিজ্ঞানীদের মতে, “বৈশ্বিক উষ্ণায়নে ধানের চেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ আর কোনো ফসল নেই।”
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ইরি এবং এর সহযোগী প্রতিষ্ঠানগুলো ধানের নতুন নতুন জাত নিয়ে এসেছে, যা প্রতিকূল আবহাওয়া ও উচ্চ মাত্রার লবণাক্ত মাটিতেও বাড়তে পারে। উদ্ভাবনের এই প্রক্রিয়ায় বিশেষজ্ঞরা আশাবাদী, আগামীতে আরো বেশি জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব-সহনশীল জাত আসবে।
“জলবায়ু পরিবর্তন এবং ঘন ঘন ঘূর্ণিঝড় ও খরার প্রেক্ষিতে আমাদের এই ধরনের নতুন জাতের ধান আরও বেশি প্রয়োজন হতে পারে,” চলতি মাসের শুরুতে ইরি’র আমন্ত্রণে পরিদর্শনকারী এক সাংবাদিক দলকে বলেন প্রতিষ্ঠানটির জ্যেষ্ঠ বিজ্ঞানী এলিস ল্যাবোর্ট।
বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল ১০টি দেশের মধ্যে এশিয়ার পাঁচ দেশ: ভারত, চীন, ইন্দোনেশিয়া, পাকিস্তান এবং বাংলাদেশের মানুষের খাদ্যের প্রধান উৎস ধান। “তাই ইরি’র পক্ষ থেকে আমরা নজর রাখছি, কোথায় এই জাতগুলো সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন,” বলেন ল্যাবোর্ট।
ধানের এই জাতগুলো সরবরাহ করা হলে কৃষকরা যেকোনো প্রতিকূল পরিবেশে তা ফলাতে পারবে জানিয়ে একই ব্রিফিংয়ে ফিলিপাইনের কৃষি মন্ত্রণালয়ের আন্ডার সেক্রেটারি মার্সেডিটা সোম্বিলা বলেন, এর ফলে “স্থানীয় পর্যায়ে ধানের উৎপাদন ও সরবরাহ স্থিতিশীল হবার পাশাপাশি চালের দামও স্থিতিশীল হবে।”
চলতি মাসের শুরুর দিকে জাতিসংঘের বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থা ক্রমবর্ধমান তাপমাত্রা সম্পর্কে এক নতুন সতর্ক বার্তা দিয়েছে। তারা বলেছে, গ্রীষ্মমণ্ডলীয় প্রশান্ত মহাসাগরে সাত বছরের মধ্যে এই প্রথম এল নিনো আবহাওয়ার (সমুদ্রে অস্বাভাবিক প্রবাহ যা বন্যা, খরা এবং অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগের সাথে সম্পর্কযুক্ত) লক্ষণ দেখা দিয়েছে।
একই সাথে ফিলিপাইনের রাষ্ট্রীয় আবহাওয়া ব্যুরো সেখানে এল নিনোর সূচনা ঘোষণা করেছে এবং বছরের শেষের দিকে এর প্রভাব অনুভূত হতে পারে বলে জনগণকে সতর্ক করেছে।
পরিবেশগত প্রতিকূলতাগুলোর মধ্যে খরার ব্যাপ্তি সবচেয়ে বেশি এবং এটি সবচেয়ে বেশি ক্ষতিকারক হিসেবে বিবেচিত।
বিজ্ঞানীদের মতে, খরার কারণে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ৮৮ হাজার ৮০০ বর্গমাইল এলাকার ধান উৎপাদন ব্যাহত হয়। সবচেয়ে বেশি সংখ্যক ধান চাষি এই অঞ্চলেই বাস করেন। যেসব কৃষক বৃষ্টিনির্ভর বা যাদের সেচের সুবিধা নেই, বৃষ্টি কম হলেই তাঁরা ধান চাষে বিপাকে পড়েন।
ইরি জানিয়েছে, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ভারতে ‘সহভাগী’, ফিলিপাইনে ‘সাহোদ উলান’ এবং নেপালে ‘সুখা’সহ বেশ কয়েকটি দেশে খরা-সহনশীল নতুন জাতের ধান ছাড়া হয়েছে।
পাশাপাশি, বন্যা সহনশীল জাতের একটি নতুন ধান বর্তমানে ফিলিপাইনসহ এশিয়ার বন্যা ও ঘূর্ণিঝড় প্রবণ কয়েকটি দেশে চাষ করা হচ্ছে।
ইরি’র মতে, বন্যা আবাদের যেকোনো পর্যায়ে ধানের ক্ষতির কারণ হতে পারে। কারণ ধানক্ষেত সম্পূর্ণ ডুবে গেলে ধানগাছ বেঁচে থাকার সম্ভাবনা খুবই কম।
বন্যার কারণে বাংলাদেশ ও ভারতের কৃষকরা বছরে প্রায় ৪০ লাখ টন ধান হারান, যা দিয়ে ৩ কোটি মানুষের খাদ্যের সংস্থান হতে পারে বলে জানান বিজ্ঞানীরা।
ফিলিপাইনে ২০২১ সালের ডিসেম্বরে সুপার টাইফুন রাই’র আঘাতে প্রায় ২১.৫ কোটি মার্কিন ডলার মূল্যের ফসল ও কৃষি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। অনেক এলাকায় ধান ক্ষেত একেবারে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়।
ইরির সমীক্ষার উদ্ধৃতি দিয়ে বিজ্ঞানী এলিস ল্যাবোর্ট জানান, ওই টাইফুনের কারণে তৈরি বন্যায় প্রচলিত জাতের ধানগুলো সম্পূর্ণ নিশ্চিহ্ন হয়ে গেলেও নিমজ্জন-প্রতিরোধী জাতগুলো তখনও টিকে ছিল।
“এটি হাইব্রিড ধানের মতো উচ্চ ফলনশীল নয়। তবে যেখানে বন্যায় জমি ডুবে যায় সেখানে এটি চাষ কৃষকদের জন্য সবচেয়ে ভালো উপায়,” বলেন এলিস ল্যাবোর্ট।
বাংলাদেশে বন্যার ঝুঁকিপ্রবণ এলাকাগুলোতে দেখা গেছে বন্যারোধী ধানের জাত চাষ করে কৃষকরা প্রতি হেক্টরে বাড়তি প্রায় ১০ হাজার টাকার ফসল পেয়েছেন।
“এতে সাধারণ মানুষের অনেক সুবিধা আছে,” জানিয়ে এ প্রসঙ্গে ইরি’র গবেষণা বিভাগের উপমহাপরিচালক অজয় কোহলি বলেন, “এই অর্থের একটি অংশ শিশুদের শিক্ষায় যাচ্ছে। এতে আমরা বাস্তব ক্ষেত্রে পরিবর্তনের সূচনা দেখতে পাই।”
“ভারত ও বাংলাদেশে যেসব এলাকায় গবেষণাটি পরিচালিত হয়েছিল, সেখানকার একটি সাধারণ পরিবারের কথা কল্পনা করুন। সেসব পরিবারে মা-বাবা শিক্ষিত না হলেও শিশুরা কিন্তু শিক্ষিত হচ্ছে; কয়েক বছরের মধ্যে পরিবারের পুরো পরিবেশ বদলে যাচ্ছে,” বলেন কোহলি।
তাপমাত্রা, লবণ প্রতিরোধ
ধান উৎপাদনের ওপর বৈশ্বিক উষ্ণায়নের উল্লেখযোগ্য প্রভাব আছে। তাই তাপ, ঠাণ্ডা এবং মাটির লবণাক্ততা সহনশীল আরো বিভিন্ন জাতের ধান আবিষ্কার করা হয়েছে বলে জানিয়েছে ইরি।
ধানের উৎপত্তি গ্রীষ্মমণ্ডলীয় অঞ্চলে হলেও চরম তাপমাত্রা ধানের ফলন ও চালের মান ক্ষতিগ্রস্ত করে। একইসাথে নিম্ন তাপমাত্রাও ধান চাষে ব্যাপক ক্ষতির কারণ হতে পারে।
ইরি’র প্রতিবেদন অনুযায়ী নিম্ন তাপমাত্রার কারণে শুধু চীনেই ৩০ লাখ থেকে ৫০ লাখ টন পর্যন্ত ধানের উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্ত হবার রেকর্ড রয়েছে।
চরম তাপমাত্রার পাশাপাশি সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ক্রমশ বাড়ায় লবণাক্ত পানি ঢুকে জমিতে উচ্চ লবণাক্ততা তৈরি করছে, যা প্রচলিত ধানগুলো সহ্য করতে পারে না।
ইরি’র বিজ্ঞানীরা ধানের লবণ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানোর উপায় খুঁজে পেয়েছেন। তাঁরা লবণ-সহনশীল এবং বন্যা-সহনশীল ধানের জাতগুলোর বৈশিষ্ট্যও খুঁজে পেয়েছেন, যেগুলোকে একত্রিত করে বন্যার এবং উচ্চ লবণাক্ততা সহ্য করতে সক্ষম আরেকটি জাত তৈরি করা যেতে পারে।
কিন্তু নতুন ধানের জাত চাষে কৃষকদের রাজি করানোই সরকারের জন্য চ্যালেঞ্জ।
ফিলিপাইনের কৃষি মন্ত্রণালয়ের আন্ডার সেক্রেটারি মার্সেডিটা সোম্বিলা বলেন, অনেক কৃষক অন্যদের জমিতে চাষের ফলাফল কী হয়, অথবা প্রচলিত পদ্ধতিতে চাষ করে নিজেরা কোনো বিপর্যয়ের শিকার না হওয়া পর্যন্ত নতুন কোনো জাত চাষ করতে চান না।
তিনি বলেন, চট করে একটি নতুন জাতের ধান গ্রহণ করতে তাঁরা দ্বিধা করেন। বিশেষ করে যদি দেখা যায় যে প্রচলিত পদ্ধতিতে চাষ করে তাঁরা ভালোই ফল পাচ্ছেন, তাহলে কেন পদ্ধতি পরিবর্তন করতে হবে তা তাঁদের বোঝানো কঠিন।