হিন্দু উৎসব ঘিরে সংঘর্ষের জেরে পশ্চিমবঙ্গে উত্তেজনা
2018.03.29
কলকাতা
হিন্দু উৎসব রাম নবমীকে কেন্দ্র করে সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষের জেরে অশান্ত হয়ে উঠেছে পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণাঞ্চলের অনেক জায়গা। পশ্চিম বর্ধমান জেলার আসানসোল ও রাণীগঞ্জে পরিস্থিতি এখনো নিয়ন্ত্রণে আসেনি বলে দাবি বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর। বুধবার রাতেও আসানসোলে অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে বলে জানিয়েছে স্থানীয়রা।
বুধবার রাতেই কলকাতা থেকে তিনজন আইপিএস অফিসারের নেতৃত্বে বিশাল কমব্যাট ফোর্স উপদ্রুত এলাকায় পাঠানো হয়েছে বলে নবান্ন সূত্রে বলা হয়েছে। পশ্চিম বর্ধমানের জেলা শাসক শশাঙ্ক শেঠি জেলার ৬টি থানায় ১৪৪ ধারা জারি এবং ইন্টারনেট পরিষেবা বন্ধ করার খবর নিশ্চিত করেছেন।
তবে আসানসোল-দুর্গাপুর পুলিশ কমিশনারেটের প্রধান লক্ষ্মীনারায়ণ মিনা বেনারকে বলেন, “পরিস্থিতি আপাতত নিয়ন্ত্রণে। এখন পর্যন্ত ৬০ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।”
পশ্চিমবঙ্গের গভর্নর কেশরী নাথ ত্রিপাঠী এক বিবৃতিতে শান্তি রক্ষার আবেদন জানিয়ে বলেন, “কোনো হিংসা, সংঘর্ষ কাম্য নয়। শান্তি বজায় রেখে ধর্মীয় উৎসব করুন।”
রাজ্যের অন্যতম বিরোধী দল কমিউনিস্ট পার্টি অব ইন্ডিয়া মার্কসবাদীর রাজ্য সম্পাদক সূর্যকান্ত মিশ্র সাংবাদিকদের বলেন, “পরিস্থিতি দ্রুত নিয়ন্ত্রণে আনতে উত্তেজনাপ্রবণ এলাকায় আধা সামরিক বাহিনী মোতায়েন করা হোক। প্রয়োজনে সেনাবাহিনীর সাহায্য নিক রাজ্য সরকার।”
মিশ্র বৃহস্পতিবার বেনারকে বলেন, “উদ্ভূত পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনার জন্য রাজ্য সরকার সর্বদল বৈঠক ডাকুক।”
এদিকে বিজেপির রাজ্য সাধারণ সম্পাদক সায়ন্তন বসু বেনারকে বলেন, “গত কয়েক দিনে ৩ জনের মৃত্যুর খবরের পাশাপাশি আরও কয়েকটি মৃত্যুর খবর জানা গেলেও সে সম্পর্কে সরকারিভাবে কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি।”
“প্রতিটি ক্ষেত্রে সাম্প্রদায়িক সংঘাত তৈরি করা হয়েছে। এই ধরনের চক্রান্ত অনেক দিন ধরেই চলছে,” বলেন তিনি।
সায়ন্তন বসু বলেন, “সরেজমিনে পরিস্থিতি পর্যালোচনায় কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের প্রতিনিধিদল পাঠানোর দাবি জানিয়েছি আমরা।”
তিনি বলেন, বৃহষ্পতিবার আসানসোলের সাংসদ ও কেন্দ্রীয় মন্ত্রী বাবুল সুপ্রিয়কে ঘটনাস্থলে যেতে দেয়নি। উল্টে তাঁর বিরুদ্ধে এফআইআর করা হয়েছে।
মিডিয়ায় প্রকাশিত খবরে জানা গেছে, পুরুলিয়া, মুর্শিদাবাদ, উত্তর ২৪ পরগণা ও পশ্চিম বর্ধমানে রামনবমীর শোভাযাত্রাকে কেন্দ্র করে গত কয়েকদিনে সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষের অভিযোগ উঠেছে। এই সংঘর্ষে মারা গেছেন তিনজন। আহত হয়েছেন আসানসোল-দুর্গাপুর পুলিশ কমিশনারেটের ডেপুটি কমিশনারসহ বেশ কিছু মানুষ।
বুধবার কেন্দ্রীয় সরকার রাজ্যের মুখ্য সচিব মলয় দে’কে রামনবমী কেন্দ্র করে আইন শৃঙ্খলার অবনতি ঘটার বিস্তারিত রিপোর্ট চেয়ে পাঠিয়েছে বলে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রসচিব রাজীব গৌবা নিশ্চিত করেছেন। রাজ্য সরকারকে আধা সামরিক বাহিনী পাঠানোরও প্রস্তাব দিয়েছেন তিনি।
তৃণমূল কংগ্রেসের মহাসচিব ও শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় সাংবাদিকদের বলেন, “এর থেকেও কঠিন পরিস্থিতি রাজ্য সরকার নিজেদের ক্ষমতায় সামলেছে। আমরা পরিস্থিতির উপর নজর রাখছি। রাজ্যে শান্তি বিঘ্নিত করতে ভারতীয় জনতা পার্টি ইচ্ছাকৃতভাবে গোলমাল পাকাচ্ছে।”
রামনবমীকে কেন্দ্র করে সাম্প্রদায়িক সংঘাত
রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য পবিত্র সরকার বেনারকে বলেন, “যখন ধর্মের কোনো প্রতীককে সামনে রেখে শ্রেষ্ঠত্বের দাবি করে আস্ফালন, হুংকার তোলা হয় তখন তা অন্যদের বিপক্ষেই পরিচালিত হয়। এ ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। ফলে দেখা দিয়েছে ধর্মীয় সংঘাত।”
ভাষা ও চেতনা সমিতির সম্পাদক অধ্যাপক ইমানুল হক বেনারকে বলেন, “বাঙালির সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে পাল্টে দেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে। বিভেদের প্রাচীর তোলা হচ্ছে।”
তবে এ বছর রাজ্যের শাসক দল তৃণমূল কংগ্রেস যেভাবে বিজেপিকে টেক্কা দিতে পশ্চিমবঙ্গ জুড়ে রামনবমী পালনে নেমে পড়েছিল তাকে উদ্বেগজনক বলে মনে করছেন বিশিষ্টজনেরা।
পবিত্র সরকার বলেন, “জনসমর্থন কমে যাওয়ার আশঙ্কা থেকেই তৃণমূল কংগ্রেস বিজেপিকে পাল্লা দিতে রামনবমী পালনে নেমে পড়েছিল।”
“ভারতীয় পূরাণের একটি চরিত্র হলেন রাম। হিন্দুদের কাছে ভগবান হিসেবে আদৃত রামের জন্মদিন পালিত হয় রাম নবমী হিসেবে। তবে উত্তর ভারতে রাম কথায় মুগ্ধ হিন্দুরা। পশ্চিমবঙ্গে রামনবমী অনেক হিন্দু বাড়িতে পালিত হলেও রাজ্যে প্রকাশ্যে রামের জন্মদিন পালনের কোনো চর্চা ছিল না। আর অস্ত্র নিয়ে শোভাযাত্রারও কোনো নজির ছিল না,” বেনারকে বলেন সাবেক শিক্ষিকা তনুশ্রী সেনগুপ্ত।
তিনি বলেন, “গত বছরই পশ্চিমবঙ্গে ভারতীয় জনতা পার্টি এবং অন্যান্য হিন্দু সংগঠনের উদ্যোগে অস্ত্র হাতে রাম নবমীর শোভাযাত্রা হয়। এ বছর সরকারের পক্ষ থেকে অস্ত্র হাতে মিছিল শোভাযাত্রা নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হলেও হিন্দু সংগঠনগুলি পরম্পরার অজুহাতে ২৫ মার্চ এবং পরবর্তী দিনগুলিতে বহু জায়গাতেই নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে অস্ত্র হাতে মিছিল করেছে।”
মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় অবশ্য সাংবাদিকদের বলেন, “গুন্ডামি করতে ধর্মের মোড়ক ব্যবহার করা হচ্ছে। এটা চলতে দেবো না। বাংলার সংস্কৃতিতে এসব চলে না।”
ভোটব্যাংকের রাজনীতির পরিণতি
“রামকে পুজো করার উদ্দেশ্য নিয়ে এই উৎসব হচ্ছে না। বরং রামকে সামনে রেখে ভোটের প্রচারে নেমেছে হিন্দু সংগঠনগুলি,” বলেন ইমানুল হক।
তাঁর মতে, “সামনেই পঞ্চায়েত নির্বাচন। এই নির্বাচনের আগে হিন্দু ভোটব্যাংকের কাছে শ্রেষ্ঠত্বের বার্তা দিতেই বিজেপি ও তাঁদের অঙ্গ হিন্দু সংগঠনগুলি ধর্মীয় উৎসবের নামে মাতামাতি করছে।”
তিনি বলেন, “রাজ্যের শাসক দলও নির্বাচনের দিকে তাকিয়ে ফাঁকা মাঠে গোল করতে দিতে রাজি হয়নি। তারাও সমানভাবে হিন্দু ভোটব্যাংকের কাছে পৌঁছাতে চেয়েছে। কিন্তু ধর্মান্ধতা দিয়ে ধর্মান্ধতার মোকাবিলা করা যায় না। রাজ্যের শাসক দল সেই ভুল ফাঁদে পা দিয়েছে।”
কমিউনিস্ট পার্টি অব ইন্ডিয়া মার্কসবাদী দলের পরিষদীয় নেতা সুজন চক্রবর্তী বেনারকে বলেন, “বিজেপির সঙ্গে তাল মিলিয়ে তৃণমূল কংগ্রেসও সমানভাবে উসকানির রাজনীতি করে চলেছে। বিভেদের এই রাজনীতির ফলেই রাজ্যে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট হচ্ছে।”