করোনাভাইরাস: সংক্রমণ ঠেকাতে জনসমাগম সীমিত করার সিদ্ধান্ত
2021.03.29
ঢাকা
দেশে অস্বাভাবিক মাত্রায় করোনাভাইরাস সংক্রমণ বাড়ায় সামাজিক, রাজনৈতিক ও ধর্মীয়সহ সব ধরনের জনসমাগম সীমিত করার নির্দেশনা জারি করেছে সরকার।
এ বিষয়ে সোমবার প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে জারি করা ১৮ দফা নির্দেশনা মঙ্গলবার থেকে সারা দেশে কার্যকর হয়ে পরবর্তী দুই সপ্তাহ পর্যন্ত বলবৎ থাকবে বলে জানানো হয়েছে প্রজ্ঞাপনে।
গত ২৪ ঘণ্টায় দেশে পাঁচ হাজার ১৮১ জন নতুন করে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন, যা এখন পর্যন্ত বাংলাদেশে একদিনে আক্রান্তের সর্বোচ্চ সংখ্যা।
পরীক্ষা করা নমুনার তুলনায় সোমবার শনাক্তের হার ছাড়িয়ে গেছে ১৮ শতাংশের বেশি।
এই পরিস্থিতিতে শুধু জনসমাগম সীমিত করে খুব একটা ফল পাওয়া যাবে না বলে মত দিয়েছেন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। তাঁরা বলছেন, এখনই সর্বাত্মক উদ্যোগ না নিলে পরিস্থিতি ভয়াবহ হবে।
নানা রকম রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক অনুষ্ঠানের ডামাডোলে কর্তৃপক্ষ করোনাসংক্রমণ বাড়ার বিষয়টার দিকে নজর দেয়নি বলে বেনারের কাছে মন্তব্য করেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী।
তিনি বলেন, “আজ যে ১৮ দফা নির্দেশনা এসেছে, এটা আসলে করোনার পেছনে দৌড়ানোর মতো। তার সামনে গিয়ে আটকানো যাবে না।”
“সব ধরনের সভা–সমাবেশ, বিনোদন কেন্দ্র বন্ধ করতে হবে,” জানিয়ে তিনি বলেন, “বিপণী-বিতানগুলো একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য খোলা রেখে, গণপরিবহনে কড়াকড়ি আরোপ করে এবং হটস্পটগুলোকে লকডাউন দিতে হবে।”
“এরপরও যদি সংক্রমণ না কমে তাহলে পুরোপুরি লকডাউনে যেতে হবে,” বলেন ডা. লেলিন চৌধুরী।
তবে সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণের জন্য এখনই সাধারণ ছুটি ঘোষণার চিন্তা-ভাবনা নেই বলে সোমবার সাংবাদিকদের জানিয়েছেন জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন।
আগামী দুই সপ্তাহ ১৮ দফা নির্দেশনা প্রতিপালনের পরে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে বলে জানান তিনি।
১৮ দফা নির্দেশনা
সোমবার জারি করা নির্দেশনায় দেশে সামাজিক, রাজনৈতিক, ধর্মীয়সহ সব ধরনের জনসমাগম সীমিত করা হলেও উচ্চ সংক্রমণযুক্ত এলাকায় এগুলো নিষিদ্ধ করা হয়।
এতে বলা হয়, মসজিদসহ সব ধর্মীয় উপাসনালয়ে যথাযথ স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা নিশ্চিত করতে হবে। সব ধরনের পর্যটন ও বিনোদন কেন্দ্রে জনসমাগম সীমিত এবং সব ধরনের মেলা আয়োজন নিরুৎসাহিত করতে হবে।
তবে ঢাকায় চলমান একুশে বইমেলা সম্পর্কে নির্দেশনায় কিছু জানানো হয়নি।
নির্দেশনায় গণপরিবহনে স্বাস্থ্যবিধি মানার পাশাপাশি ধারণ ক্ষমতার অর্ধেকের বেশি যাত্রী পরিবহন না করা ও সংক্রমণের উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ এলাকাতে আন্তঃজেলা যান চলাচল সীমিত বা প্রয়োজনে বন্ধ করতে বলা হয়।
নির্দেশনায় বলা হয়, সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও কোচিং সেন্টার বন্ধ থাকবে, হোটেল-রেস্তোরায় ধারণ ক্ষমতার ৫০ ভাগ মানুষ প্রবেশ করতে পারবে এবং বিদেশ ফেরতদের বাধ্যতামূলকভাবে নিজ খরচে ১৪ দিন প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টিনে থাকতে হবে।
এছাড়া মাস্ক ছাড়া বের না হওয়া এবং রাত ১০টার পরে বাইরে যাওয়া নিয়ন্ত্রণের ওপরও জোর দেওয়া হয় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের ওই নির্দেশনায়।
এতে বলা হয়, জরুরি সেবায় নিয়োজিত প্রতিষ্ঠান ছাড়া সব সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান বা শিল্প কারখানা অর্ধেক জনবল দিয়ে পরিচালনা করতে হবে। স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানগুলো ও অফিসে মাস্ক পরাসহ যথাযথ স্বাস্থ্যবিধি পরিপালন নিশ্চিত করতে হবে।
উল্লেখ্য, দেশে করোনাভাইরাস শনাক্ত হওয়ার পর গত বছরের ১৭ মার্চ থেকে দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে। শুধু বিশেষ অনুরোধে কওমি মাদ্রাসাগুলো খোলার অনুমতি দেয় সরকার।
তবে সরকারের নতুন ১৮ দফা নির্দেশনা অনুসারে এখন সব ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকবে বলে সোমবার সাংবাদিকদের জানান শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি।
বই মেলার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত হয়নি
করোনাভাইরাস নিয়ন্ত্রণে সরকারের নতুন নির্দেশনায় জনসমাগম সীমিত করা ও মেলা আয়োজন নিরুৎসাহিত করতে বলা হলেও রাজধানী ঢাকায় চলমান একুশে বইমেলা বন্ধ হবে কিনা, সে বিষয়ে এখনো সিদ্ধান্ত হয়নি বলে জানিয়েছে বাংলা একাডেমি কর্তৃপক্ষ।
বাংলা একাডেমির পরিচালক ও মেলা আয়োজক কমিটির সদস্য সচিব জালাল আহমেদ বেনারকে বলেন, “করোনাভাইরাস সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ার প্রেক্ষিতে বই মেলা বন্ধ হবে কিনা সে বিষয়ে এখনো সিদ্ধান্ত হয়নি।”
তিনি বলেন, “বাংলা একাডেমি, প্রকাশকদের সমিতি এবং সরকারের যৌথ সিদ্ধান্তের প্রেক্ষিতে এবারের বইমেলা অনুষ্ঠিত হচ্ছে। সেজন্য সবার মতামত নিয়েই এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হবে।”
তবে বইমেলার সময় এক ঘণ্টা কমানো হয়েছে উল্লেখ করে জালাল আহমেদ বলেন, “এমনিতে করোনার সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ায় বই মেলায় জনসমাগম কমেছে।”
নতুন সিদ্ধান্তের প্রেক্ষিতে আপাতত সোমবার থেকে বইমেলা প্রতিদিন বিকেল ৩টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত খোলা থাকবে বলে জানান তিনি।
হাসপাতালে শয্যা মিলছে না
করোনা আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় হাসপাতালগুলোতে বিছানা পাওয়া যাচ্ছে না। একটি বেসরকারি সংস্থার কর্মকর্তা মো. কামরুজ্জামান বেনারকে জানান, তিনি তাঁর স্ত্রীর জন্য গ্রিন রোড এলাকার হেলথ অ্যান্ড হোপ সহ চারটি হাসপাতালে যোগাযোগ করেছেন, একটি কেবিনও ফাঁকা পাননি।
অবশেষে তিনি তাঁর স্ত্রীকে একটি হাসপাতালের ওয়ার্ডে ভর্তি করেছেন বলে জানান কামরুজ্জামান।
“এটা সত্য যে কোভিড আক্রান্ত রোগীদের ভর্তি করা যাচ্ছে না। প্রায় সব হাসপাতালে একই অবস্থা,” বেনারকে বলেন হেলথ অ্যান্ড হোপের চেয়ারম্যান ডা. লেলিন চৌধুরী।
এই পরিস্থিতিতে তাঁরা একটি নতুন ফ্লোরে দ্রুততম সময়ের মধ্যে কোভিড ইউনিট চালুর চেষ্টার করছেন বলে জানান তিনি।
করোনায় মোট মৃত্যু প্রায় নয় হাজার
সোমবার এ যাবতকালের সর্বোচ্চ রোগী শনাক্ত হওয়ার পাশাপাশি করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে ৪৫ জন মারা গেছেন বলে জানিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে, এ পর্যন্ত বাংলাদেশে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন ছয় লাখ ৮৯৫ জন, মৃত্যু হয়েছে আট হাজার ৯৪৯ জনের।
যুক্তরাষ্ট্রের জনস হপকিনস বিশ্ববিদ্যালয়ের হিসাবে, এ পর্যন্ত সারা বিশ্বে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন ১২ কোটি ৭৩ লাখ ১৯ হাজারের বেশি মানুষ, মারা গেছেন ২৭ লাখ ৮৫ হাজারের বেশি।