করোনাভাইরাস: ইউরোপ ও লাতিন আমেরিকার দেশগুলোর সাথে বিমান চলাচল বন্ধ
2021.04.01
ঢাকা
দেশে করোনাভাইরাসের ক্রমবর্ধমান বিস্তার ঠেকাতে এবার ব্রিটেন ছাড়া পুরো ইউরোপ ও লাতিন আমেরিকার অধিকাংশ দেশের সাথে ফ্লাইট বন্ধ করল সরকার।
বৃহস্পতিবার এক আদেশের মাধ্যমে এই নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ।
দেশে করোনাভাইরাস মহামারি শুরুর পর এবারই প্রথমবারের মতো এতগুলো দেশের সাথে বিমান যোগাযোগ বন্ধ করল বাংলাদেশ। গত বছর অন্যান্য দেশ মূলত বাংলাদেশ থেকে বিমান বন্ধ করেছিল।
সংক্রমণ ঠেকাতে সম্প্রতি ১৮ দফা সরকারি নির্দেশনা জারির কয়েক দিনের মধ্যে যাত্রীবাহী বিমান পরিচালনা বন্ধ করল সরকার। আগামী ৩ থেকে ১৫ এপ্রিল পর্যন্ত এই নিষেধাজ্ঞা থাকবে। তবে পণ্যবাহী বিমান ও ট্রানজিট বিমান চলবে।
হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের পরিচালক গ্রুপ ক্যাপ্টেন এএইচএম তৌহিদ-উল আহসান বৃহস্পতিবার বেনারকে বলেন, “বাংলাদেশে করোনাভাইরাস পরিস্থিতি অবনতির কারণে যুক্তরাজ্য ছাড়া ইউরোপীয় কোনো দেশ থেকে যাত্রী বাংলাদেশে প্রবেশ করতে পারবে না।”
তিনি বলেন, “ইউরোপীয় দেশ ছাড়াও আরো ১২টি দেশ থেকে কোনো যাত্রী বাংলাদেশে প্রবেশ করতে পারবে না। দেশগুলো হলো: আর্জেন্টিনা, বাহরাইন, ব্রাজিল, চিলি, জর্ডান, কুয়েত, লেবানন, পেরু, কাতার, দক্ষিণ আফ্রিকা, তুরস্ক এবং উরুগুয়ে।”
বিষয়টি ব্যাখ্যা করে পরিচালক বলেন, “আমেরিকা থেকে যাত্রী নিয়ে দোহা হয়ে বাংলাদেশে আসতে পারবে কাতার এয়ারওয়েজ। তবে কাতার থেকে কোনো বিমান যাত্রী নিয়ে বাংলাদেশে আসতে পারবে না। আবার তুরস্ক থেকে কোনো বিমান সরাসরি ঢাকায় যাত্রী পরিবহন করতে পারবে না।”
বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের ওই আদেশে বলা হয়েছে, ইউরোপীয় এবং ওই ১২ দেশ থেকে কোনো বিমান পরিচালনা করতে চাইলে তারা শুধু ট্রানজিট যাত্রী পরিবহন করতে পারবে। তবে ট্রানজিট যাত্রীদের বিমানবন্দরের টার্মিনালে থাকতে হবে।
এ ছাড়াও বাংলাদেশের বিমানবন্দরে অবতরণের পর অন্যান্য দেশ থেকে আগত যাত্রীদের টিকা দেয়া থাকলেও করোনাভাইরাস পরীক্ষার সার্টিফিকেট দেখাতে হবে। এই পরীক্ষা যাত্রার ৭২ ঘণ্টা আগে সম্পন্ন করতে হবে।
যাত্রীদের মধ্যে করোনাভাইরাসের কোনো লক্ষণ না থাকলেও তাঁদের কঠোরভাবে ১৪ দিনের সঙ্গনিরোধে থাকতে হবে।
তবে, কোনো যাত্রীর মধ্যে করোনাভাইরাসের লক্ষণ দেখা গেলে তাঁকে সরকারি ব্যবস্থাপনায় ১৪ দিনের বাধ্যতামূলক সঙ্গনিরোধে থাকতে হবে।
প্রয়োজন ‘সঙ্গনিরোধ কার্যকর করা’
রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মোশতাক হোসেন বেনারকে বলেন, “বিদেশ থেকে যাত্রী আসা কোনো সমস্যা নয়। সমস্যা হলো দেশে আগত যাত্রীদের কার্যকরভাবে সঙ্গনিরোধ করা যাচ্ছে না।”
তিনি বলেন, “আমি মনে করি, এতগুলো দেশের সাথে ফ্লাইট বন্ধ করা কোনো ভালো সিদ্ধান্ত নয়। আমাদের উচিত সঙ্গনিরোধ কার্যকর করা।”
রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা এএসএম আলমগীর বলেন, “আমাদের গবেষণায় আমরা দেখেছি, মানুষ সামাজিক দূরত্ব মানলে, মাস্ক ব্যবহার করলে সংক্রমণ কমে যায়।”
“আবার সংক্রমণ কমলেই অধিকাংশ মানুষ সামাজিক দূরত্ব মানেন না, মাস্ক ব্যবহার করেন না এবং সঙ্গে সঙ্গে সংক্রমণ বাড়তে থাকে,” জানিয়ে তিনি বলেন, “দেশের অধিকাংশ মানুষই মাস্ক পরছেন না, স্বাস্থ্যবিধি মানছেন না।”
শনাক্তের হার ২৩ শতাংশ!
বৃহস্পতিবার স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এক বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, বুধবার সকাল আটটা থেকে বৃহস্পতিবার সকাল আটটার মধ্যে সারাদেশে মোট ছয় হাজার ৪৬৯ জন ব্যক্তি নতুন করে করোনাভাইরাসে সংক্রমিত হয়েছেন। আর মৃত্যুবরণ করেছেন, ৫৯ জন।
গত বছর ৮ মার্চ থেকে পহেলা এপ্রিল পর্যন্ত বাংলাদেশে ছয় লাখ ১৭ হাজার ৭৬৪ জন ব্যক্তি করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন। আর গত বছরের ১৮ মার্চ থেকে সর্বমোট প্রাণ হারিয়েছেন নয় হাজার ১০৫ জন।
গত বছরের মার্চে শুরু হওয়া প্রথম ঢেউয়ে জুন-জুলাই মাসে করোনা সংক্রমণ সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছায়। ২ জুলাই সর্বোচ্চ চার হাজার ১৯ জন রোগী করোনাভাইরাসে সংক্রমিত হন।
এরপর থেকে ধীরে ধীরে কমতে থাকে সংক্রমণ। সেই ধারা অব্যাহত থাকে এ বছর ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হিসাবে ফেব্রুয়ারি মাসে মাত্র ১১ হাজার ৭৭ জন করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হন। পরীক্ষা করা নমুনার বিপরীতে শতকরা হারে যা ছিল দুই দশমিক আট ভাগ। ওই মাসে প্রাণ হারান ২৮১ জন।
তবে মার্চ মাস থেকে পরিস্থিতি পাল্টাতে থাকে, বেড়ে যায় সংক্রমণ। এই মাসে গড় শনাক্তের হার দশ ভাগের বেশি। বৃহস্পতিবার শনাক্তের হার পৌঁছেছে প্রায় ২৩ ভাগে।
স্বাস্থ্যবিধি মানতে প্রধানমন্ত্রীর আহ্বান
বৃহস্পতিবার থেকে শুরু হওয়া জাতীয় সংসদের অধিবেশনে দেওয়া বক্তব্যে জনগণকে মাস্ক ব্যবহার করতে এবং স্বাস্থ্যবিধি মানতে আহ্বান জানান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
বাসস জানায়, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা করোনাভাইরাস হঠাৎ বেড়ে যাওয়ার কারণে স্বাস্থ্য নির্দেশিকা মেনে এর সংক্রমণ প্রতিহত করতে সরকারকে সহায়তার জন্য দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।
বাইরে বের হলে মাস্ক ব্যবহার, জনসমাগম এড়ানো এবং অকারণে বাইরে বের হবার মতো স্বাস্থ্যঝুঁকি সকলকে এড়িয়ে চলারও পরামর্শ দেন তিনি।
শেখ হাসিনা বলেন, “আমরা করোনাভাইরাসকে নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করছি। তবে, এটি করার জন্য সাধারণ মানুষের সহায়তা প্রয়োজন।”
হঠাৎ করোনাভাইরাসের উচ্চ সংক্রমণ হারের ব্যাপারে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বৃহস্পতিবার সাংবাদিকদের বলেন, “আমরা আসলে বেশি আত্মবিশ্বাসী হয়ে গিয়েছিলাম। ভেবেছিলাম আমাদের দেশ থেকে করোনা চলে গেছে। আবার দেশে টিকাদান কর্মসূচি শুরু হওয়ার পর দেশের মানুষ স্বাস্থ্যবিধি মানার বিষয়ে আরও উদাসীন হয়ে পড়েছেন।”
তিনি বলেন, “এই আত্মবিশ্বাসের কারণে সাম্প্রতিক মাসগুলোতে বিয়ে, জন্মদিন, পিকনিক পার্টি, সামাজিক অনুষ্ঠানের হিড়িক লেগে গেছে। এই অতি আত্মবিশ্বাসের ফলাফল হলো, করোনাভাইরাস সংক্রমণের বিস্তার।”
“আমরা একটি বিপর্যস্ত পরিস্থিতির দিকে যাচ্ছি,” উল্লেখ করে স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, “এখনই এই সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। না হলে আমাদের সামনে আরও খারাপ পরিস্থিতি অপেক্ষা করছে।”
সংক্রমণ বৃদ্ধি পাওয়ায় নানা উদ্যোগ
গণপরিবহণে অর্ধেক যাত্রী নিয়ে চলাচল এবং বাণিজ্যিকভাবে পরিচালিত উবার, পাঠাও এবং অন্যান্য মোটরসাইকেল সেবা বন্ধ করেছে সরকার। এর প্রতিবাদে মোটরসাইকেল চালকেরা বৃহস্পতিবার রাজধানীর বিভিন্ন ব্যস্ত সড়ক অবরোধ করে প্রতিবাদ জানিয়েছেন।
এদিকে কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতসহ জেলার সব বিনোদনকেন্দ্র ১৪ এপ্রিল পর্যন্ত বন্ধ ঘোষণা করেছে কক্সবাজার জেলা প্রশাসন। বৃহস্পতিবার রাতে জেলা প্রশাসনের এক বৈঠকে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
তবে এই পরিস্থিতির মধ্যেও দেশের মেডিকেল কলেজগুলোর প্রথম বর্ষের ভর্তি পরীক্ষা শুক্রবার অনুষ্ঠিত হচ্ছে। এ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের অনেকেই ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন।