করোনাভাইরাস: লকডাউনের প্রথমদিনে ঢিলেঢালা অবস্থা, সংক্রমণ বাড়ছে
2021.04.05
ঢাকা
আপডেট: ৫ এপ্রিল ২০২১। ইস্টার্ন সময় বিকেল ০৫:৪৫
করোনাভাইরাস সংক্রমণের উর্ধ্বগতি ঠেকাতে দেশে প্রথমবারের মতো এক সপ্তাহের লকডাউন ঘোষণার প্রথম দিন সোমবার ঢিলেঢালা ভাব দেখা গেছে। রাজধানীতে গণপরিবহন না চললেও ব্যক্তিগত পরিবহন ও রিকশার আধিক্য ছিল।
এদিকে লকডাউন নিশ্চিত করাকে কেন্দ্র করে পুলিশের গুলিতে ফরিদপুরের সালথায় সোমবার রাতে অন্তত তিনজন আহত হয়েছেন বলে জানায় বার্তাসংস্থা এএফপি।
পুলিশের বরাত দিয়ে এএফপি জানায়, স্থানীয় প্রশাসন লকডাউন বাস্তবায়ন করতে গেলে ব্যবসায়ী ও জনতা পুলিশের সাথে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েন। এক পর্যায়ে আত্মরক্ষার্থে পুলিশ গুলি চালালে অন্তত তিনজন আহত হন।
সোমবার সরেজমিন ঢাকায় সরকারের দেওয়া বিধিনিষেধ আংশিক মানতে দেখা গেছে লোকজনকে। বেশিরভাগ অফিস খোলা থাকায় কর্মস্থলে আসা–যাওয়ার ক্ষেত্রে ভোগান্তি পোহানোর কথা জানিয়েছেন সাধারণ মানুষ।
লকডাউনে দোকানপাট বন্ধ রাখার সিদ্ধান্তে ঢাকাসহ দেশের কিছু স্থানে ব্যবসায়ীরা বিক্ষোভ করেছেন।
মার্চের শুরু থেকে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা ক্রমাগত বাড়ছে। সোমবার দেশে সাত হাজারের বেশি করোনা রোগী শনাক্ত হয়েছে, রোববারও এই সংখ্যা ছিল প্রায় একইরকম।
সোমবার স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নিয়মিত সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, দেশে গত ২৪ ঘণ্টায় ৭ হাজার ৭৫ জনের করোনা শনাক্ত হয়েছে। আর মারা গেছেন ৫২ জন।
আগের দিন রোববার করোনা শনাক্ত হয়েছিল ৭ হাজার ৮৭ জন, যা দেশে করোনা সংক্রমণ শুরুর পর থেকে এক দিনে ছিল সর্বোচ্চসংখ্যক। ওইদিন করোনার সংক্রমণে ৫৩ জনের মৃত্যু হয়েছিল।
এমন পরিস্থিতিতে স্বাস্থ্য সুরক্ষায় সরকারের দেওয়া নির্দেশনা কঠোরভাবে মেনে চলার আহবান জানিয়েছেন সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের।
লকডাউনের প্রথম দিন সোমবার নিজের সরকারি বাসভবনে এক সংবাদ সম্মেলনে কাদের বলেন, “উদাসীনতা না দেখিয়ে সকলে মাস্ক পরাসহ শতভাগ স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলুন।”
গত বছরের ৮ মার্চ প্রথমবারের মতো বাংলাদেশে করোনাভাইরাস সংক্রমণ শনাক্ত হয়। এরপরই পরিস্থিতি মোকাবিলায় সাধারণ ছুটি ঘোষণা করে সরকার।
গত বছরের ২৬ মার্চ থেকে শুরু হওয়া সেই ছুটি ছিল দীর্ঘ ৬৬ দিন। তবে বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশে এই রোগে আক্রান্ত ও মৃত্যুর হার তুলনামূলক কম থাকায় ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হতে শুরু করে জনজীবন।
সম্প্রতি আবারও করোনা সংক্রমণ হার ও মৃত্যুর সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় সোমবার থেকে এক সপ্তাহের জন্য লকডাউন দিয়েছে সরকার। এ বিষয়ে রোববার মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের জারি করা প্রজ্ঞাপনে শর্ত সাপেক্ষে সোমবার সকাল ৬টা থেকে ১১ এপ্রিল রাত ১২টা পর্যন্ত সার্বিক কার্যাবলী ও চলাচলে নিষেধাজ্ঞার কথা বলা হয়েছে।
এতে আরো বলা হয়, এ সময় পণ্য পরিবহন, উৎপাদনব্যবস্থা ও জরুরি সেবা ছাড়া সব ধরনের গণপরিবহন (সড়ক, রেল, নৌ, অভ্যন্তরীণ ফ্লাইট) বন্ধ থাকবে।
জরুরি কাজের জন্য সীমিত পরিসরে অফিস, শিল্প–কারখানা ও নির্মাণ কাজ চালু থাকার কথাও প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে।
করোনাভাইরাসের সংক্রমণ উদ্বেগজনক হারে বাড়তে থাকায় লক ডাউনের সময়সীমা আরো বাড়ানো হবে কি না, সেই সিদ্ধান্ত বৃহস্পতিবার নেওয়া হবে বলে সোমবার মন্ত্রিসভার বৈঠক শেষে সংবাদ সম্মেলনে জানান মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম।
সাধারণ মানুষের ভোগান্তি
সোমবার রাজধানী ঢাকাতে গণপরিবহন চলতে দেখা যায়নি। অল্প কিছু বাস রাস্তায় নামলেও পুলিশ তাদের ফিরিয়ে দেয়। ফলে লকডাউন সত্ত্বেও যাদের অফিস করতে হয়েছে তাঁরা ভোগান্তিতে পড়েন।
রাজধানীর এয়ারপোর্ট এলাকা থেকে মতিঝিল যেতে আড়াইশ থেকে তিনশ টাকা খরচ হয়েছে বলে জানান মো. বদিউজ্জামান নামে একজন ভুক্তভোগী। একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের এই কর্মী বলেন, “লকডাউনে গাড়ি বন্ধ হয়েছে। কিন্তু আমাদের অফিস তো বন্ধ হয়নি। এখন অফিসে যেতে চরম ভোগান্তি হচ্ছে।”
“নিজস্ব যাতায়াতের ব্যবস্থার নির্দেশ দিলেও অফিসগুলো তা মানছে কিনা সেটা দেখার কেউ নেই,” বলেন তিনি।
এদিকে লকডাউনের ঘোষণার পরপরই রোববার হাজারো মানুষ বাসে, লঞ্চে ও ট্রেনে ঢাকা ছাড়ে। প্রচণ্ড ভিড় থাকায় এ সময় সামাজিক দূরত্ব বা স্বাস্থ্যবিধি মানার বিষয়টি উপেক্ষিত হয়।
লঞ্চডুবিতে নিহত ২৯
লক ডাউনের ঘোষণায় যাত্রীর চাপ বেড়ে যাওয়ার পরিস্থিতিতে রোববার নারায়ণগঞ্জে শীতলক্ষ্যা নদীতে যাত্রীবাহী লঞ্চ ডুবির ঘটনা ঘটে। এখন পর্যন্ত ২৯ জনের লাশ উদ্ধার হয়েছে।
সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা-ইউএনও নাহিদা বারিক সাংবাদিকদের জানান, সোমবার দুপুর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ২৪ জনের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। এ ছাড়া রোববার পাঁচজনের লাশ উদ্ধার হয়েছিল।
সোমবার ডুবে যাওয়া জাহাজটি উদ্ধার করা হয়েছে। তবে এখনও সাতজন নিখোঁজ রয়েছেন বলে জানিয়েছে স্থানীয় প্রশাসন।
হাসপাতালে রোগীর চাপ
ঢাকার হাসপাতালগুলোতে করোনা রোগীর সংখ্যা বেড়েই চলেছে। রাজধানীতে করোনা চিকিৎসার জন্য বড়ো ছয়টি হাসপাতালের কোনোটিতেই নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র (আইসিইউ) ফাঁকা নেই বলে সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।
পাশাপাশি হাসপাতালগুলোতে সাধারণ শয্যাও ফাঁকা নেই বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
রাজধানীর কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালের পরিসংখ্যান কর্মকর্তা সালেহ আহমদ বেনারকে বলেন, “এই হাসপাতালে করোনার রোগীদের জন্য ২৭৫টি শয্যা থাকলেও সোমবার পর্যন্ত চারশোর বেশি রোগী ভর্তি রয়েছে। প্রতিদিনই চাপ বাড়ছে।”
দোকান খোলা রাখতে বিক্ষোভ
লকডাউনের বিরোধিতা করে এবং স্বাস্থ্যবিধি মেনে নির্দিষ্ট সময়ে দোকান খুলে দেওয়ার দাবি জানিয়ে বিভিন্ন স্থানে বিক্ষোভ করেছেন ব্যবসায়ী ও কর্মচারীরা।
সাতদিনের লকডাউনে শপিং মলসহ অন্যান্য দোকান বন্ধ থাকার নির্দেশনা দেয় সরকার। তবে কাঁচাবাজার এবং নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি সকাল আটটা থেকে বিকেল চারটা পর্যন্ত খোলা জায়গায় স্বাস্থ্যবিধি মেনে কেনাবেচা করা যাবে। ব্যাংকিং ব্যবস্থা সীমিত পরিসরে চালু থাকবে।
রাজধানীর কোতোয়ালি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মিজানুর রহমান সাংবাদিকদের বলেন, সোমবার বেলা সাড়ে ১১টার দিকে পুরান ঢাকার ইসলামপুর-পাটুয়াটুলী প্রধান সড়কে শতাধিক দোকানের ব্যবসায়ী ও কর্মচারীরা সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ শুরু করেন।”
“তবে পুলিশ তাদের বুঝিয়ে সেখান থেকে সরিয়ে দিতে সক্ষম হয়। তাঁরা সরকারি নির্দেশনা মেনে চলবেন বলে জানান,” বলেন তিনি।
সরকারি নির্দেশনা অনুযায়ী সীমিত আকারে সকাল ১০টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত ব্যাংক খোলা ছিল। তবে বেশিরভাগ ব্যাংকে গ্রাহকের উপস্থিত তুলনামূলক কম দেখা যায়। ব্যাংকের সময়ের সঙ্গে মিল রেখে খোলা ছিল শেয়ারবাজারও।
করোনার মধ্যেও চলছে বইমেলা
করোনার সংক্রমণ ঠেকাতে লকডাউনের মধ্যেও সময়সীমা কমিয়ে অমর একুশে গ্রন্থমেলা চালু রাখা হয়েছে। রোববার সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের এ সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত প্রতিদিন বেলা ১২টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত অমর একুশে বইমেলার কার্যক্রম চলবে।
তবে মেলায় পাঠক-দর্শনার্থীর দেখা মিলছে না বলে জানিয়েছেন বিক্রেতারা। পার্ল পাবলিকেশন্সের বিক্রয়কর্মী মুনতাসির ফাহাদ বেনারকে বলেন, “বিক্রি হয়নি বললেই চলে।”
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অনেকেই লকডাউনের সময় বইমেলা চালু রাখার সমালোচনা করছেন।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে, এ পর্যন্ত বাংলাদেশে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন ছয় লাখ, ৪৪ হাজার ৪৩৯ জন, মৃত্যু হয়েছে নয় হাজার ৩১৮ জনের।
যুক্তরাষ্ট্রের জনস হপকিনস বিশ্ববিদ্যালয়ের হিসাবে, এ পর্যন্ত সারা বিশ্বে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন ১৩ কোটি ১৫ লাখ ৭০ হাজারের বেশি মানুষ, মারা গেছেন ২৮ লাখ ৫৬ হাজারের বেশি।