লকডাউন অগ্রাহ্য করে দেশের বিভিন্ন স্থানে বিক্ষোভ
2021.04.06
ঢাকা
করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঊর্ধ্বগামী হওয়ার প্রেক্ষিতে সরকার ঘোষিত লকডাউন অগ্রাহ্য করে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলা-উপজেলায় মঙ্গলবারও বিক্ষোভ করেছেন সাধারণ ব্যবসায়ী ও কর্মচারীরা।
লকডাউনের প্রথম দিনে সোমবার কিছু এলাকায় বিক্ষোভ এবং একজনের মৃত্যু হলেও মঙ্গলবার তা দেশের বিভিন্নস্থানে ছড়িয়ে পড়ে, শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত অন্তত ২০টি স্থানে বিক্ষোভ হয়েছে।
“এসব বিক্ষোভ ওই সব এলাকায় সংক্রমণের ঝুঁকি বাড়িয়ে দিয়েছে,” বেনারকে বলেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ড. রুহুল ফুরকান সিদ্দিক।
সরকারি হিসেবে, গত ২৪ ঘণ্টায় করোনায় দেশে ৬৬ জনের মৃত্যু হয়েছে, সাত হাজার ২১৩ জন নতুনভাবে শনাক্ত হয়েছেন।
গত ২৪ ঘণ্টায় পরীক্ষা করা নমুনার বিপরীতে রোগী শনাক্তের হার ছিল ২১ শতাংশের বেশি। এই তথ্য উল্লেখ করে তিনি বলেন, “আমাদের সংক্রমণের হার পাঁচের নিচে নেমে এসেছিল, সেটা এখন ২১ ছাড়িয়েছে। গত টানা তিনদিন আক্রান্তের সংখ্যা সাত হাজার পার হয়েছে। ক্রমান্বয়ে মৃতের সংখ্যা বাড়ছে।”
“অবস্থাটা খুবই নাজুক এবং ভয়াবহ। পরিস্থিতিটা আস্তে আস্তে খারাপের দিকেই যাচ্ছে,” ড. রুহুল ফুরকান সিদ্দিক।
“এখন সরকারি নির্দেশনা মেনে না চললে আগামীতে করোনা সংক্রমণ ও মৃত্যু উভয়ই নিয়ন্ত্রণহীন হতে পারে,” বলে মঙ্গলবার ঢাকায় সাংবাদিকদের জানান স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রী জাহিদ মালেক।
“যখন লকডাউন তুলে নেওয়ার প্রয়োজন হবে সরকার সঠিক সময়েই সেই সিদ্ধান্ত নেবে,” বলেন মন্ত্রী।
সালথায় নিহত একজন
করোনা মোকাবেলায় বিধিনিষেধ কার্যকর করাকে কেন্দ্র করে সোমবার ফরিদপুরের সালথায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে স্থানীয়দের সংঘর্ষে রামকান্তপুর ইউনিয়নের মো. জুবায়ের হোসেন (২২) নামের এক মাদ্রাসা ছাত্র নিহত হন বলে জানায় বার্তাসংস্থা এএফপিসহ বিভিন্ন গণমাধ্যম।
ওই ঘটনায় র্যাব ও পুলিশের আট সদস্য আহত হয়েছেন বলে সাংবাদিকদের জানিয়েছেন ফরিদপুরের পুলিশ সুপার আলিমুজ্জামান।
এ ছাড়া হামলার অংশ নেয়া অনেকে গুলিবিদ্ধ ও আহত হয়েছেন, যাদের পরিচয় এখন পর্যন্ত জানা যায়নি।
ওই ঘটনায় জড়িত তিনজনকে আটক করা হয়েছে বলে সাংবাদিকদের জানান সালথা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. আসিকুজ্জামান।
পুলিশের ভাষ্য অনুযায়ী, এলাকায় লকডাউন নিশ্চিত করাকে কেন্দ্র করে সোমবার সন্ধ্যা ৭টা থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত সালথায় স্থানীয়রা ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালান। পুলিশ ও আনসার সদস্যরা শটগানের ৫৮৮টি গুলি ও ৩২টি কাঁদানে গ্যাসের শেল ছুড়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনেন।
এ সময় উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) কার্যালয় ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়। তাঁর বাসভবন ও উপজেলা চেয়ারম্যানের বাসভবনেও ভাংচুর করা হয়েছে। দুটি সরকারি গাড়ি ও দুটি মোটরসাইকেল পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে।
লকডাউনের দ্বিতীয় দিনেও বিক্ষোভ
লকডাউনের দ্বিতীয় দিনে ঢাকাসহ দেশের অন্তত ১৩টি জেলার ২০টি এলাকায় বিক্ষোভ করছেন বিভিন্ন এলাকার ব্যবসায়ী ও দোকানীরা।
সাভারে ঢাকা-আরিচা মহাসড়ক এবং নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জের শিমরাইল এলাকায় ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কসহ বিভিন্ন এলাকায় সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেছেন দোকানিরা।
এ ব্যাপারে বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির সভাপতি মো. হেলাল উদ্দিন বেনারকে বলেন, “কবে থেকে স্বল্প পরিসরে হলেও দোকান ও বিপণি বিতানগুলো খুলে দেওয়া হবে, সরকারের পক্ষ থেকে সেটুকু অন্তত বলা উচিত ছিল। তাহলে বিক্ষোভকারীরা ঘরে ফিরে যেত। কিন্তু এখন তারা কবে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বা দোকান খুলতে পারবে তা নিয়ে অনিশ্চয়তার মধ্যে আছে।”
তিনি বলেন, “আমরা সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ করছি। সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা চেষ্টা করছেন একটি পথ বের করার, যাতে স্বাস্থ্যবিধি মেনে সব কিছু খোলা রাখা যায়।”
এর আগে গত বছর প্রথম দফায় সাধারণ ছুটি ঘোষণা করে সব কিছু ৬৬ দিন বন্ধ রাখায় সারাদেশের দোকান মালিকদের প্রতিদিন গড়ে প্রায় ১১ শ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে বলে জানান তিনি।
বাংলাদেশ রেস্তোরাঁ মালিক সমিতির সাংগঠনিক সম্পাদক সৈয়দ মোহাম্মদ আন্দালিব বেনারকে বলেন, “এই মুহূর্তে লকডাউন না দিলে আমাদের দেশে আক্রান্তের সংখ্যা আরো বেড়ে যাবে। সেদিক থেকে এটা সঠিক সিদ্ধান্ত।”
“কিন্তু কোভিড থেকে রক্ষা পেতে গিয়ে মানুষ যদি না খেয়ে মারা যায়, সেটিও ঠিক হবে না। আমাদের সঠিক একটা সমাধানের পথ খুঁজে বের করতে হবে,” বলেন তিনি।
প্রথম দফা সরকারি ছুটিতে ৩০-৩৫ ভাগ হোটেল–রেস্তোঁরা মালিক দেউলিয়া হয়ে গেছে উল্লেখ করে তিনি জানান, যারা টিকে আছেন, তারাও কেউ গত বারের সেই ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে পারেননি। এই অবস্থায় আবার লকডাউন তাদের মহাঝুঁকির মুখে ফেলেছে।
“এরপরও সারাদেশে যে বিক্ষোভ-প্রতিরোধ গড়ে উঠেছে, সেখানে কিন্তু মালিকরা নেই। এটা মূলত শ্রমিকরা করছেন। মালিকরা তাদের আটকাতেও পারছি না। কারণ তাদের দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে,” বলেন তিনি।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর বরাত দিয়ে দোকান মালিক সমিতির দেওয়া হিসাব অনুযায়ী, দেশে ১৫ জনের কম কর্মচারী থাকা পাইকারি ও খুচরা বিক্রেতা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা প্রায় ৫৪ লাখ। এসব প্রতিষ্ঠানে কর্মরত রয়েছেন ৯৭ লখের বেশি মানুষ।
দেশে নিবন্ধিত-অনিবন্ধিত ৬০-৭০ হাজার রেস্তোরাঁ বা খাবারের দোকানে কর্মরত ৩০ লক্ষাধিক মালিক-শ্রমিকের পরিবারের প্রায় সোয়া এক কোটি মানুষ এই প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর প্রত্যক্ষভাবে নির্ভরশীল বলে জানান রেস্তোরা মালিক সমিতির নেতা আন্দালিব।
“তাছাড়া যাদের কাছ থেকে আমরা কাঁচামাল সংগ্রহ করি, যারা মাছ, মাংস, দুধ- উৎপাদন বা বিক্রি করে, তাদের সংখ্যাও মোটেই কম নয়,” বলেন তিনি।
আন্তর্জাতিক খাদ্যনীতি ও গবেষণা ইন্সটিটিউটের গবেষণা বিশ্লেষক নাহিয়ান বিন খালেদ বেনারকে বলেন, “শহরাঞ্চলের নিম্ন আয়ের জনগোষ্ঠী যে ভীষণ ঝুঁকিতে সেটা ২০২০ সালের জরিপগুলোতেই স্পষ্ট হয়েছে। দিনভিত্তিক আয়ের কর্মচারী এবং অতি ক্ষুদ্র খুচরা ব্যবসায়ীরাও এর বাইরে নন। পূর্ব ঘোষণা ছাড়াই লকডাউন মূলত তাঁদের মধ্যে ক্ষোভের সঞ্চার করেছে।”
“তাঁদের ভয়, লকডাউন কোনো কারণে প্রলম্বিত হলে রমজান ও ঈদুল ফিতরের আয় থেকে তাঁরা বঞ্চিত হবেন। বহু ব্যবসায়ীর বছরের সিংহভাগ লাভ আসে এই সময়ে,” বলেন তিনি।
শহরে গণপরিবহন চলবে
বুধবার থেকে ঢাকা, চট্টগ্রামসহ দেশের সব সিটি করপোরেশন এলাকায় স্বাস্থ্যবিধি মেনে সকাল ছয়টা থেকে সন্ধ্যা ছয়টা পর্যন্ত বাস-মিনিবাস চলবে বলে মঙ্গলবার বিকেলে এক ব্রিফিংএ জানান সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের।
তবে এসব পরিবহনে অর্ধেক আসন ফাঁকা রাখতে হবে এবং ভাড়া নির্ধারিত হারের চেয়ে ৬০ শতাংশ বেশি থাকবে বলে জানান তিনি।
লকডাউন পরিস্থিতিতে সরকারি-বেসরকারিসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কর্মরত ও জনসাধারণের যাতায়াতে দুর্ভোগের বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে সরকার গণপরিবহনে চলাচলের বিষয়টি শর্ত প্রতিপালন সাপেক্ষে পুনর্বিবেচনা করে অনুমোদন দিয়েছে বলে জানান মন্ত্রী।