করোনা সংক্রমণ রোধে শিথিল লকডাউন: চলছে গণপরিবহন, খুলবে দোকানপাট

জেসমিন পাপড়ি
2021.04.08
ঢাকা
করোনা সংক্রমণ রোধে শিথিল লকডাউন: চলছে গণপরিবহন, খুলবে দোকানপাট করোনা আক্রান্ত পরিবার সদস্যকে বাড়িতে দেবার জন্য ঢাকার মগবাজারে অক্সিজেন সিলিন্ডার নিয়ে যাচ্ছেন এক ব্যক্তি। ৮ এপ্রিল ২০২১।
[ফোকাস বাংলা]

করোনাভাইরাস সংক্রমণের ঊর্ধ্বগতি ঠেকাতে এক সপ্তাহের লকডাউন ঘোষণার চারদিনের মাথায় ব্যবসায়ীদের দাবির মুখে দোকানপাট খুলে দেবার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। তবে এ সময় স্বাস্থ্যবিধি মানা না হলে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে জানানো হয়েছে বৃহস্পতিবার জারি করা এক প্রজ্ঞাপনে। 

সরকারের এই ঘোষণার দিনই দেশে করোনাভাইরাসে মৃত্যুর সংখ্যায় নতুন রেকর্ড হয়েছে। বৃহস্পতিবার প্রকাশিত সরকারি তথ্য অনুযায়ী গত ২৪ ঘণ্টায় ৭৪ জনের মৃত্যু হয়েছে, যা এখন পর্যন্ত বাংলাদেশে করোনাভাইরাসে এক দিনে মৃত্যুর সর্বোচ্চ সংখ্যা। 

একই সময়ে নতুন করে আক্রান্ত হয়েছেন ৬ হাজার ৪৫৮ জন। 

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে, এখন পর্যন্ত দেশে করোনাভাইরাসে মোট মৃত্যু ঘটেছে নয় হাজার ৫২১ জনের, আক্রান্ত হয়েছেন ৬ লাখ ৬৬ হাজার ১৩২ জন। 

করোনা সংক্রমণ ও মৃত্যুর হার বেড়ে যাওয়ায় সোমবার থেকে এক সপ্তাহের জন্য লকডাউন ঘোষণা করে সরকার। তবে লকডাউনের সিদ্ধান্ত ঘোষণার পর থেকে গত কয়েকদিন ধরে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ব্যবসায়ীরা বিক্ষোভ করে আসছেন। 

“আসন্ন পহেলা বৈশাখ, রমজান ও ঈদুল ফিতরের সময় সবচেয়ে বেশি কেনাবেচা হয়। এসময় দোকান বন্ধ রাখলে আমরা মারাত্মক ক্ষতির মুখে পড়ব,” বেনারকে বলেন ঢাকা নিউ মার্কেটের ব্যবসায়ী কামাল হোসেন। 

তিনি বলেন, “গত বছর দোকান পাট বন্ধ রাখার যে ক্ষতি, সেটাই এখনো পুষিয়ে উঠতে পারিনি। এই অবস্থায় লক ডাউনের মধ্যে নির্দিষ্ট সময় দোকান খোলা রাখার এই সিদ্ধান্তকে আমরা স্বাগত জানাই।” 

এর আগে লক ডাউনের মধ্যে স্বাস্থ্যবিধি মেনে ঢাকা, চট্টগ্রামসহ দেশের সব সিটি করপোরেশন এলাকায় গণপরিবহন চলাচলের অনুমতি দেয় সরকার। 

স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করোনাভাইরাসের এই ঊর্ধ্বগতির মধ্যে কঠোর স্বাস্থ্যবিধি না মানা হলে সামনে আরো ভয়াবহ পরিস্থিতি আসবে, যা সামাল দেওয়া কঠিন হবে। 

দেশে মহামারি নিয়ন্ত্রণে সরকার যথাযথ উদ্যোগ নিতে পারছে না বলে মনে করেন করোনা মোকাবেলায় বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের সমন্বয়ে গঠিত জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির সদস্যরাও। 

এই কমিটির সদস্য এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) সাবেক উপাচার্য ডা. নজরুল ইসলাম বেনারকে বলেন, “লকডাউন দিয়ে আবার তা ধীরে ধীরে শিথিল করা হচ্ছে। তার মানে সরকার সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছে।” 

লকডাউন দেওয়া বা শিথিল করার বিষয়ে জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির সাথে আলোচনা করা হয়নি উল্লেখ করে তিনি বলেন, “করোনা নিয়ন্ত্রণে আমাদের সবকিছু ছিল। শুধু পরিকল্পনা ও ব্যবস্থাপনার অভাবে পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার নিতে যাচ্ছে।” 

তিনি বলেন, “যদি আমরা শুরু থেকেই মাস্ক পরা, সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা ও হাত ধোয়া নিশ্চিত করতে পারতাম, তাহলে গণপরিবহনে বা শপিং মলে এভাবে আলাদা ইন্টারভেনশনের দরকার হতো না।” 

গত বছরের ৮ মার্চ বাংলাদেশে প্রথম করোনাভাইরাস শনাক্ত হয়। এর দশ দিন পরে এই রোগে দেশে প্রথম মৃত্যুর ঘটনা ঘটে। এরপরই পরিস্থিতি মোকাবেলায় ২৬ মার্চ থেকে সাধারণ ছুটি ঘোষণা করে সরকার। সেই ছুটি ছিল দীর্ঘ ৬৬ দিন। 

বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশে মহামারিতে আক্রান্ত ও মৃত্যুর হার তুলনামূলক কম থাকায় ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হতে শুরু করে জনজীবন। তবে চলতি বছরের মার্চের শুরু থেকে আবারও সংক্রমণ ও মৃত্যু বাড়তে থাকে। 

Lo_01.jpeg
করোনা সংক্রমণ ঠেকাতে সরকার ঘোষিত এক সপ্তার লকডাউনের চতুর্থ দিনে ঢাকার মতিঝিল বাণিজ্যিক এলাকা। ব্যক্তিগত গাড়ির সাথে চলছে গণপরিবহনও। ৮ এপ্রিল ২০২১।

মৃত্যু বেড়েছে চিকিৎসার অভাবে 

দেশে করোনাভাইরাসে মৃত্যুর সংখ্যা এখন ১০ হাজারের কাছাকাছি। ডা. নজরুল ইসলামের মতে, “মৃত্যুর হার বেড়েছে চিকিৎসার অভাবে। আমরা হাতে একটা বছর সময় পেয়েছিলাম, কিন্তু চিকিৎসায় ব্যবস্থায় মনোযোগ দেওয়া হয়নি।” 

প্রতিটি জেলায় আইসিইউ'র ব্যবস্থা করা হবে—গত জুন মাসে সরকারের এমন ঘোষণার কথা উল্লেখ করে নজরুল ইসলাম বলেন, “মাত্র ২৮টি জেলায় আইসিইউ'র ব্যবস্থা হয়েছে, ৩৬ জেলায় হয়নি। সেন্ট্রাল অক্সিজেন সাপ্লাইয়ে ৭৯টি প্রজেক্ট নেওয়া হয়েছিল, ২৯টাতে কাজ হয়েছে ৫০টিতে হয়নি।” 

এদিকে করোনাভাইরাসের তিনটি ধরনের (ভেরিয়েন্ট) মধ্যে দক্ষিণ আফ্রিকার ধরনটিই বেশি সংক্রামক এবং তা হঠাৎ করে বাংলাদেশে বেশি ছড়াচ্ছে বলে জানা গেছে সাম্প্রতিক এক গবেষণায়। 

বুধবার প্রকাশিত আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশ (আইসিডিডিআরবি), সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর) এবং স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের যৌথ গবেষণায় এ তথ্য উঠে আসে। 

এতে বলা হয়, গত ১৮ থেকে ২৪ মার্চ ৫৭ জন রোগীর নমুনা নিয়ে তা বিশ্লেষণ করে ৪৬ জনের শরীরে দক্ষিণ আফ্রিকার ধরন পাওয়া যায়, যা গবেষণায় মোট শনাক্তের ৮১ শতাংশ। 

করোনার টিকা দ্বিতীয় ডোজ শুরু

বৃহস্পতিবার সারা দেশে কোভিড-১৯ টিকার দ্বিতীয় ডোজ দেওয়া শুরু হয়েছে। প্রথম দিনে ৮১ হাজার ৩২৩ জন টিকার দ্বিতীয় ডোজ নিয়েছেন বলে সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। 

গত ৭ ফেব্রুয়ারি থেকে সারা দেশে করোনাভাইরাসের টিকা দেওয়া শুরু হয়। তার দুই মাস পরে শুরু হলো দ্বিতীয় ডোজ টিকা। বাংলাদেশে দেওয়া হচ্ছে অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা কোভিশিল্ড। প্রথমবার নেবার চার থেকে বারো সপ্তার মধ্যে এই টিকার দ্বিতীয় ডোজ টিকা নিতে হয়। 

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে, এই পর্যন্ত প্রায় ৫৫ লাখ ৬৯ হাজার জন টিকার প্রথম ডোজ নিয়েছেন। তাঁদেরই এখন দ্বিতীয় ডোজ দেওয়া শুরু হয়েছে। এর পাশাপাশি নিবন্ধিতদের প্রথম ডোজের টিকাও দেওয়া হবে। 

এদিকে বাংলাদেশে টিকার চালান আসা নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে। ভারতে উৎপাদিত অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার কোভিশিল্ড টিকা জানুয়ারি থেকে পরবর্তী ৬ মাসে ৫০ লাখ করে মোট ৩ কোটি ডোজ আসার কথা ছিল। 

জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি মিলে এসেছে ৭০ লাখ ডোজ, মার্চে কোনো টিকা আসেনি। 

মার্চের টিকার চালানের বিষয়ে ভারতের উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান সেরাম ইন্সটিটিউটের সাথে আলোচনা চলছে বলে বেনারকে জানান স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (পরিকল্পনা ও উন্নয়ন) অধ্যাপক ডা. মীরজাদী সেব্রিনা ফ্রোরা।

তিনি বলেন, “আশা করছি খুব শিগগিরই পরবর্তী চালানের টিকা আসার তারিখ জানা যাবে।” 

এর বাইরে ভারত থেকে উপহার হিসেবে ৩৩ লাখ ডোজ টিকা পেয়েছে বাংলাদেশ। এর মধ্যে জানুয়ারিতে ২০ লাখ ডোজ, মার্চে স্বাধীনতা দিবসে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশ সফরের সময় ১২ লাখ ডোজ এবং বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে এক লাখ ডোজ টিকা উপহার দেন সফররত ভারতীয় সেনাপ্রধান জেনারেল মনোজ মুকুন্দ নরভানে। 

সব মিলিয়ে দেশে এ পর্যন্ত টিকা এসেছে এক কোটি তিন লাখ ডোজ। 

যুক্তরাষ্ট্রের জনস হপকিনস বিশ্ববিদ্যালয়ের হিসাবে, এ পর্যন্ত সারা বিশ্বে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন ১৩ কোটি ৩৬ লাখের বেশি মানুষ, মারা গেছেন ২৮ লাখ ৯৪ হাজারের বেশি।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।