করোনাভাইরাস: মুমূর্ষু রোগীদের জন্য আইসিইউ বেডের আকাল
2021.04.12
ঢাকা
আপডেট: ১৩ এপ্রিল ২০২১। ইস্টার্ন সময় সকাল ১১:৫০
তিন দিন ধরে অনেক খোঁজাখুঁজির পর ঢাকায় ইশরাত জাহানের (২৮) জন্য হাসপাতালে একটি নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র (আইসিইউ) বেড পাওয়া যায়। কিন্তু ততক্ষণে বেশ দেরি হয়ে গেছে, আইসিইউতে নেবার আগেই মারা যান কিডনি জটিলতাসহ করোনাভাইরাসে আক্রান্ত ইশরাত।
মার্চের শুরু থেকে বাংলাদেশে করোনাভাইরাসের দ্বিতীয় প্রকোপ শুরু হওয়ার পর ইশরাতের মতো বহু মুমূর্ষু রোগী হাসপাতালের আইসিইউ শয্যা পাচ্ছেন না।
গত বছরের ৮ মার্চ দেশে প্রথম করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হওয়ার পর থেকে পর্যাপ্ত আইসিইউ সুবিধার সংকট থাকলেও গত এক বছরে সেই পরিস্থিতির খুব একটা উন্নতি হয়নি বলে জানাচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে, রোববার পর্যন্ত সারাদেশে করোনা রোগীদের জন্য ছিল নির্ধারিত ৬৭২টি আইসিইউ শয্যা, যার মধ্যে ঢাকায় ৩৭৭টি। এগুলোর ভেতর ঢাকায় শূন্য ছিল মাত্র সাতটি, আর সারা দেশে ১৪২টি।
ইশরাতের দুলাভাই আবদুল মান্নান বেনারকে জানান, গত ৭ এপ্রিল সকালে কিডনি জটিলতা নিয়ে ইশরাতকে কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল।
“কোভিড -১৯ রিপোর্ট আসার আগেই চিকিৎসকরা বুঝতে পারেন তাঁকে আইসিইউ-তে নেওয়া জরুরি। কিন্তু ওই হাসপাতালে কোনো আইসিইউ বেড ফাঁকা ছিল না। তখন কর্তৃপক্ষ আমাদের অন্য কোনো হাসপাতালে আইসিইউ বেড খুঁজতে বলেন,” বলেন মান্নান।
তিনি বলেন, “আমাদের পরিবারের সদস্যরা এই শহরে একটি আইসিইউ বেড পাওয়ার জন্য নিজেদের সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছে। কিন্তু ৯ এপ্রিল সন্ধ্যা পর্যন্ত আমরা কোনো বেড খালি পাইনি।”
“এরপর একটি বেসরকারি হাসপাতালে আইসিইউ বেড খালি পেলেও সেখানে নেওয়ার আগেই ইশরাত মারা যান,” বলেন তিনি।
একইভাবে আইসিইউ শয্যার জন্য দীর্ঘ অপেক্ষার পর সোমবার বাংলাদেশ সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেসের (বেসিস) সদস্য মুহাম্মদ আবদুস সালাম খান মারা যান।
“ডিজিটাল বাংলায় সময়মতো আইসিইউ না পাওয়ার কারণে আমার বাবা মারা গেছেন,” সোমবার ফেসবুক পোস্টে ক্ষোভের সঙ্গে লিখেছেন প্রয়াতের শোকার্ত ছেলে খান মুহাম্মদ আনোয়ারুস সালাম।
‘আইসিইউ সংকটের কারণ স্বাস্থ্যসেবায় মনোযোগ না দেওয়া’
“গত বছরের তুলনায় রোগীদের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় আইসিইউ বেডের চাহিদা বেড়েছে,” বলে বেনারকে জানান সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. এ এস এম আলমগীর।
তবে বিশ্লেষকদের মতে, আইসিইউ সংকটের মূল কারণ স্বাস্থ্যসেবায় প্রয়োজনীয় মনোযোগ না দেওয়া।
“স্বাস্থ্যসেবায় প্রয়োজনীয় মনোযোগ না দেওয়ায় আইসিইউয়ের বিরাট সংকট রয়ে গেছে,” সোমবার বেনারকে জানান করোনা মোকাবেলায় গঠিত জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির সদস্য এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) সাবেক উপাচার্য ডা. নজরুল ইসলাম।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে, দেশের ৬৪টি জেলার বেশিরভাগ হাসপাতালেই আইসিইউ বেড নেই।
“দেশে করোনা ভাইরাসের প্রথম ঢেউ আসার পরে কিছু অস্থায়ী আইসিইউ সুবিধা স্থাপন করা হয়েছিল। কিন্তু সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ সেগুলো সরিয়ে নিয়েছে। কারণ, তারা ভেবেছিল দেশে করোনা সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউয়ের আশঙ্কা নেই,” বলেন অধ্যাপক নজরুল ইসলাম।
তিনি বলেন, “এখন তারা আবার অস্থায়ী আইসিইউ স্থাপন শুরু করলেও তা সময়সাপেক্ষ ব্যাপার।”
“দেশে এখন করোনাভাইরাসের দক্ষিণ আফ্রিকার ধরন ছড়িয়ে পড়েছে। এটা আগের চেয়ে বেশি শক্তিশালী। করোনার এই ধরন আরও বেশি লোককে সংক্রামিত করতে সক্ষম যা আইসিইউ বিছানার চাহিদা বাড়ানোর অন্যতম কারণ,” বলেন দেশের অন্যতম এই ভাইরোলজিস্ট।
অধ্যাপক নজরুলের মতে, প্রয়োজনীয় সংখ্যক আইসিইউ স্থাপনে “কর্তৃপক্ষের কিছুটা অবহেলা রয়েছে।”
তিনি বলেন, গত বছর প্রতিটি জেলায় আইসিইউ বেড স্থাপনের জন্য প্রধানমন্ত্রী নির্দেশ দিয়েছিলেন, এমনকি হাইকোর্টও এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে নির্দেশনা দিলেও তা কার্যকর হয়নি।
প্রতিটি জেলা হাসপাতালে আইসিইউ স্থাপনে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনার কথা গত বছর জুনে পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নানও সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন।
মহামারি শুরু হবার পর দেশে প্রায় ২০০ আইসিইউ বেড বৃদ্ধি করা হয়েছে জানিয়ে, অধিদপ্তরের পরিচালক (হাসপাতাল) ডা. মো. ফরিদ হোসেন মিয়া বেনারকে বলেন, আগামী দু সপ্তাহের মধ্যে রাজধানীর ডিএনসিসি মার্কেটে দুইশ আইসিইউ বেডসহ একটি নতুন হাসপাতাল উদ্বোধন করা হবে।
এছাড়া “বিশ্বব্যাংক এবং এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের অর্থায়নে জেলা পর্যায়ের হাসপাতালে আইসিইউ স্থাপনের কাজ এখনও চলছে,” জানান তিনি।
একদিনে ৮৩ জনের মৃত্যু
সোমবার দেশে করোনাভাইরাসে মৃত্যুর সংখ্যা নতুন রেকর্ড হয়েছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, গত ২৪ ঘণ্টায় কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত হয়ে ৮৩ জন মারা গেছেন, যা এই যাবত সর্বোচ্চ সংখ্যা।
দেশে এনিয়ে মোট মৃত্যুর সংখ্যা দাঁড়াল নয় হাজার ৮২২ জন।
এছাড়া গত ২৪ ঘণ্টায় সাত হাজার ২০১ জন নতুন কোভিড-১৯ রোগী শনাক্ত হয়েছেন বলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়। সব মিলিয়ে দেশে মোট আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ছয় লাখ ৯১ হাজার ৯৫৭ জন।
এক সপ্তাহের লকডাউন, মসজিদের জন্য নির্দেশনা
দেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে বুধবার থেকে এক সপ্তাহ সব ধরনের অফিস ও পরিবহন চলাচল বন্ধের পাশাপাশি বাজার-মার্কেট, হোটেল-রেস্তোরাঁসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিধিনিষেধ আরোপ করেছে সরকার।
বাংলা নববর্ষ ১৪ এপ্রিল ভোর ৬টা থেকে ২১ এপ্রিল রাত ১২টা পর্যন্ত এসব নিষেধাজ্ঞা কার্যকর হবে বলে সোমবার মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে জারি করা এক প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে।
তবে এই সময়ে স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ করে শিল্প কারখানা চালু রাখার অনুমতি দিয়েছে সরকার।
এই লকডাউন চলাকালে সব ব্যাংক বন্ধ থাকবে বলে সোমবার জানিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। বন্ধ থাকবে শেয়ারবাজার। তবে সার্বক্ষণিক খোলা থাকবে এটিএম, ইন্টারনেট ব্যাংকিংসহ অনলাইন সব সেবা।
এদিন ধর্ম মন্ত্রণালয় থেকে জারি করা এক নির্দেশনায় বলা হয়, মসজিদে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজে সর্বোচ্চ ২০ জন মুসল্লি এবং রমজানে তারাবির নামাজে খতিব, ইমাম, হাফেজ, মুয়াজ্জিন ও খাদিমসহ সর্বোচ্চ ২০ জন মুসল্লি অংশ নিতে পারবেন।
১৪ এপ্রিল থেকে পরবর্তী নির্দেশনা না দেওয়া পর্যন্ত এই নিয়ম বলবৎ থাকবে।
তবে স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক রশীদ–ই–মাহবুব বেনারকে বলেন, অন্তত দুই সপ্তাহের কঠোর লকডাউন থাকা উচিত। না হলে চলমান এই পরিস্থিতি সামাল দেওয়া কঠিন হয়ে যাবে।
তাঁর মতে, “পরিস্থিতি এখনও নিয়ন্ত্রণের বাইরে না, তবে এই অবনতির কারণ ঢিলেঢালা বিধিনিষেধ।”
খালেদা জিয়া করোনা আক্রান্ত
সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন। রোববার এক সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানান দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।
ঢাকার গুলশানে খালেদা জিয়া যে বাড়িতে থাকছেন সেখানে তিনিসহ নয়জন করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন বলে জানা যায়। করোনাভাইরাস মহামারির মধ্যে গত বছরের ২৫ মার্চ এক নির্বাহী আদেশে কারাগার থেকে মুক্ত হওয়ার পরে গুলশানের এই বাসায় অবস্থান করছেন তিনি।
মির্জা ফখরুল জানান, বর্তমানে খালেদা জিয়া তাঁর ব্যক্তিগত চিকিৎসকদের তত্ত্বাবধানে আছেন। তিনি দেশবাসীর কাছে দোয়া চেয়েছেন।
সংশোধনী: মূল প্রতিবেদনে আবদুল মান্নানকে ভুল করে ইশরাতের দেবর হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছিল। ভুলটি সংশোধন করা হলো।