করোনার টিকাদান কর্মসূচি কিছুটা অনিশ্চয়তায়, বিকল্প খুঁজছে সরকার
2021.04.14
ঢাকা
করোনাভাইরাস সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউয়ে উদ্বেগজনক উর্ধ্বগতির মধ্যে কিছুটা অনিশ্চয়তার মুখে পড়তে যাচ্ছে বাংলাদেশে টিকাদান কর্মসূচি। প্রয়োজনীয় সংখ্যক টিকা না পাওয়ায় সরকার এখন বিকল্প বাজার খুঁজছে বলে জানিয়েছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী।
এর মধ্যেই দেশে করোনাভাইরাস সংক্রমণে বুধবার একদিনে সর্বোচ্চ ৯৬ জনের মৃত্যুর খবর জানিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।
বুধবার বাংলা নববর্ষ ১৪২৮ এর প্রথম দিন, পহেলা বৈশাখ। এ দিন থেকেই বাংলাদেশে শুরু হয়েছে রোজা।
এদিকে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে বুধবার থেকে শুরু হয়েছে আট দিনের কঠোর লকডাউন। বাতিল করা হয়েছে দেশের ঐতিহ্যবাহী পহেলা বৈশাখের শোভাযাত্রা, রমনা বটমূলে ছায়ানটের বর্ষবরণ অনুষ্ঠান।
পহেলা বৈশাখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কেবল একটি প্রতীকী শোভাযাত্রা হয়েছে।
লকডাউনের কারণে রমজান ঘিরে চিরায়ত ব্যস্ততা, ইফতার কেনাবেচা, তারাবি নামাজসহ নানা আনুষ্ঠানিকতা চলছে সীমিত পরিসরে। মসজিদে সর্বোচ্চ ২০ জনের বেশি নামাজ আদায় না করতে নির্দেশনা জারি করেছে ইসলামিক ফাউন্ডেশন।
টিকার বিকল্প উৎস খুঁজছে সরকার
সরকারের সাথে চুক্তি অনুযায়ী বাংলাদেশের বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালসের মাধ্যমে ভারতের সেরাম ইন্সটিটিউট “প্রতিমাসে ৫০ লাখ ডোজ” করোনাভাইরাসের টিকা দেবার কথা ছিল বলে বুধবার বেনারকে জানান স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক।
চুক্তি অনুযায়ী জানুয়ারি থেকে জুনের মধ্যে মোট তিন কোটি ডোজ টিকা পাওয়ার কথা জানিয়ে তিনি বলেন, “সেরাম আমাদের জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি মাসে ৭০ লাখ টিকা দিয়েছে।”
“মার্চ মাসে সেরাম আমাদের কোনো টিকা পাঠায়নি। এপ্রিলের চালান ঘিরেও অনিশ্চয়তা আছে,” বলেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী।
মে মাস নাগাদ জাতিসংঘের কোভ্যাক্স কর্মসূচির আওতায় বাংলাদেশ টিকা পাবার আশা করলেও সেরাম কোভ্যাক্সকে টিকা সরবরাহ না করায় আপাতত তাও অনিশ্চিত জানিয়ে তিনি বলেন, “সেরাম কোভ্যাক্সকে টিকা দিলে তবে আমরা সেই টিকা পাব।”
তবে চুক্তি মোতাবেক সেরাম ইন্সটিটিউট টিকা সরবরাহ করবে আশা করে স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, “বিকল্প হিসাবে আমরা চীনের সিনোফার্ম এবং রাশিয়ার স্পুটনিকের কাছ থেকে টিকা সংগ্রহের আলোচনা শুরু করেছি। দেখা যাক কী হয়!”
জানুয়ারির শেষ দিকে বেক্সিমকোর মাধ্যমে ভারতের সেরাম ইন্সটিটিউটে উৎপাদিত অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্র্যাজেনেকার ৫০ লাখ ডোজ টিকার প্রথম চালান বাংলাদেশে আসে, পরের মাসে আসে আরো ২০ লাখ।
এর বাইরে ভারত থেকে উপহার হিসেবে মোট ৩৩ লাখ ডোজ টিকা পেয়েছে বাংলাদেশ।
“সব মিলিয়ে আমরা এক কোটি তিন লাখ ডোজ টিকা পেয়েছি,” বেনারকে বলেন সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের জ্যেষ্ঠ বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা এএসএম আলমগীর।
“এর মধ্যে প্রায় ৫৭ লাখ মানুষ প্রথম ডোজ টিকা নিয়েছেন। আরও সাত লাখ ৩৩ হাজারের বেশি মানুষ দ্বিতীয় ডোজের টিকা নিয়েছেন,” জানিয়ে তিনি বলেন, “আশা রাখি এই ৫৭ লাখ মানুষকে টিকা দেয়ার আগেই সেরাম থেকে টিকা পেয়ে যাব।”
এখন পর্যন্ত প্রথম ডোজ নেয়া ৫৭ লাখ মানুষের প্রত্যেকে দুটি করে ডোজ নিয়ে কোর্স পূর্ণ করতে কমপক্ষে এক কোটি ১৪ লাখ ডোজ টিকা প্রয়োজন জানিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল ইউনিভার্সিটির ভাইরোলজি বিভাগের সাবেক প্রধান ডা. নজরুল ইসলাম বেনারকে বলেন, “সেই পরিমাণ টিকা আমাদের হাতে নেই।”
“আমার মনে হয় আমরা টিকা নিয়ে অনিশ্চয়তায় পড়তে যাচ্ছি,” জানিয়ে তিনি বলেন, “যদি প্রতিটি মানুষকে দুটি ডোজ দেয়া না যায়, সেক্ষেত্রে যাঁরা একটি ডোজ টিকা নিয়েছেন তাঁদের কোনো লাভ হবে না।”
“আবার যাঁরা অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্র্যাজেনেকার এক ডোজ নিয়েছেন তাঁদের অন্য কোনো কোম্পানির টিকা দেয়া যাবে না। সব মিলিয়ে মনে হচ্ছে, যদি সেরাম ইন্সটিটিউট অচিরেই টিকা সরবরাহ না করে সেক্ষেত্রে আমাদের টিকাদান কর্মসূচি বাধাগ্রস্ত হতে পারে,” বলেন অধ্যাপক নজরুল।
তাঁর মতে, “সরকারের উচিত ভারত সরকারের সাথে আলোচনার মাধ্যমে চুক্তি অনুযায়ী টিকা যেন বাংলাদেশে আসে সেই ব্যবস্থা করা।”
“সরকার চীনের সিনোফার্ম এবং রাশিয়ার স্পুটনিক টিকা কেনার যে উদ্যোগ নিয়েছে সেটিকে আমরা স্বাগত জানাই,” বলেন তিনি।
এদিকে সবার জন্য টিকা পাওয়া নিশ্চিত করতে সরকার কাজ করছে বলে বুধবার এক সংবাদ সম্মেলনে জানান স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা।
তিনি বলেন, দেশের ২০ শতাংশ মানুষের জন্য টিকা পেতে জাতিসংঘের আওতায় কোভ্যাক্সের সাথে বাংলাদেশের একটি চুক্তি রয়েছে।
এ ছাড়া করোনাভাইরাসের টিকার জন্য বিশ্বব্যাংক ৫০০ মিলিয়ন ডলার সহায়তা করছে জানিয়ে তিনি বলেন, এশিয়ান উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) সাথে ৯৪০ মিলিয়ন ডলারের একটি প্রকল্পের কাজ চলমান রয়েছে।
শুধু অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকার ওপর নির্ভর না করে অন্যান্য টিকা প্রস্তুতকারী দেশ থেকেও বাংলাদেশ টিকা আমদানির চেষ্টা চালাচ্ছে বলে জানান ডা. ফ্লোরা।
সপ্তাহজুড়ে লকডাউন শুরু
করোনাভাইরাসের সংক্রমণ অস্বাভাবিক বেড়ে যাওয়ার প্রেক্ষাপটে ১৪ এপ্রিল থেকে ২১ এপ্রিল পর্যন্ত আট দিনের লকডাউন ঘোষণা করে সরকার। লকডাউনের প্রথম দিন বুধবার সকল ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকলেও বেশ কিছু শর্তে খোলা ছিল শিল্প প্রতিষ্ঠান।
লকডাউন কার্যকর করতে পুলিশের পক্ষ থেকে অতি প্রয়োজন ছাড়া সকলকে ঘরে থাকতে নির্দেশ দেয়া হয়। রাজধানী ঢাকার প্রায় সকল রাস্তায় ছিল পুলিশে তল্লাশি। ফলে লকডাউনের প্রথমদিন ঢাকা ছিল অনেকটাই জনমানবশূন্য।
তবে অতি জরুরি সেবা প্রদানকারীদের অনেকে পড়েছেন পুলিশি জরিমানার মুখে।
বাংলাদেশ ডক্টরস ফাউন্ডেশনের ফেসবুক পেজে হয়রানির কথা লিখেছেন ডা. কৃষ্ণা হালদার।
“গত রাতে কুয়েত মৈত্রী সরকারি হাসপাতালে আমার নাইট শিফটে ডিউটি ছিল। সকালে আমার প্রাইভেট কার পিক আপ করার সময় কাওরান বাজার সিগন্যালে ড্রাইভার আমার আইডি কার্ড দেখানোর পরও পুলিশ মামলা করেছে,” অভিযোগ করেন ডা. কৃষ্ণা।
হয়রানির মুখে পড়েছেন স্কয়ার হাসপাতালের চিকিৎসক নাজমুল ইসলামও। তাঁকে জরিমানা করা হয়েছিল। যদিও বুধবার রাতে পুলিশের পক্ষ থেকে তাঁকে জরিমানার টাকা ফিরিয়ে দেওয়ার আশ্বাস দেওয়া হয়েছে।
হয়রানির এসব অভিযোগ সম্পর্কে বেনারের পক্ষ থেকে জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর পুলিশের মুখপাত্র ইফতেখারুল ইসলাম কোনো মন্তব্য করেননি।
গণমাধ্যমের ওপর ক্ষোভ
করোনা পরিস্থিতিতে স্বাস্থ্য ব্যবস্থার সমালোচনা করায় গণমাধ্যম এবং জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের ওপর ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক আবুল বাসার মোহাম্মদ খুরশিদ আলম।
বুধবার এক অনলাইন সংবাদ সম্মেলনের প্রায় পুরোটা জুড়ে তিনি তাঁদের ওপর ক্ষোভ প্রকাশ করেন।
“কিছু কিছু পত্রপত্রিকা এমনভাবে সমালোচনা করছেন যেটা আমাদের মনোবলকে ভেঙে দিচ্ছে,” উল্লেখ করে তিনি বলেন, “আপনারা গঠনমূলক সমালোচনা করবেন, আমাদেরকে পথ দেখাবেন, আমরা আমাদের শুদ্ধ করব। বিরূপ সমালোচনা করলে আমাদের মনোবল ভেঙে যাবে।”
এক দিনে মারা গেলেন ৯৬ জন
গত বছরের ৮ মার্চ বাংলাদেশে প্রথম করোনাভাইরাস সংক্রমণ ধরা পড়ে। ১৮ মার্চ এই ভাইরাসে প্রথম রোগী মারা যান।
এই প্রেক্ষাপটে গত বছর ২৬ মার্চ থেকে ৩১ মে পর্যন্ত লকডাউনের আদলে সাধারণ ছুটি ঘোষণা করে সরকার। পরে অর্থনীতি খুলে দেয়া হলে জুন-জুলাই মাসে প্রথম ঢেউয়ে সর্বোচ্চ সংখ্যক রোগী সংক্রমিত হন।
চলতি বছরের জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি সংক্রমণ অনেক নিচে নেমে আসলেও মার্চ থেকে বাংলাদেশে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ শুরু হয়।
বুধবার দেশে পাঁচ হাজার ১৮৫ জন নতুন করে করোনায় সংক্রমিত হয়েছেন ও এই রোগে ৯৬ জন মারা গেছেন বলে জানিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। সব মিলিয়ে বাংলাদেশে এ পর্যন্ত সাত লাখ তিন হাজার ১৭০ জন করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। মারা গেছেন নয় হাজার ৯৮৭ জন।
যুক্তরাষ্ট্রের জনস হপকিনস বিশ্ববিদ্যালয়ের হিসাবে, এ পর্যন্ত সারা বিশ্বে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন ১৩ কোটি ৭৮ লাখ ৪৭ হাজারের বেশি মানুষ, মারা গেছেন ২৯ লাখ ৩৫ হাজারের বেশি।