দুই বাংলাতেই করোনায় মৃতের সংখ্যা ১০ হাজার ছাড়িয়ে গেছে
2021.04.15
ঢাকা ও কলকাতা
বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গ—দুই বাংলাতেই করোনাভাইরাসে মৃতের সংখ্যা দশ হাজার ছাড়িয়ে গেছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে, বৃহস্পতিবার পর্যন্ত বাংলাদেশে মৃতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১০ হাজার ৮১। অন্যদিকে পশ্চিমবঙ্গ স্বাস্থ্য দপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, রাজ্যে বুধবার পর্যন্ত করোনাভাইরাসে মোট মৃতের সংখ্যা ১০ হাজার ৪৫৮ জন।
বাংলাদেশ করোনাভাইরাসের দ্বিতীয় ঢেউ সামাল দিতে বুধবার থেকে শুরু হয়েছে আট দিনের কঠোর বিধিনিষেধ। প্রথম দিনের তুলনায় বিধিনিষেধের ক্ষেত্রে দ্বিতীয় দিনে বেশি কঠোর হতে দেখা গেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীকে।
রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় রাস্তায় বের হওয়া মানুষ জিজ্ঞাসাবাদের মুখোমুখি হয়েছেন।
প্রথম দিনে জরুরি সেবার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের হয়রানির ঘটনায় সমালোচনার মুখে পড়ে পুলিশের কার্যক্রম। এরই প্রেক্ষিতে বৃহস্পতিবার পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি (মিডিয়া) সোহেল রানা গণমাধ্যমকে জানান, চিকিৎসক, নার্স, মেডিকেল স্টাফ, সাংবাদিক, ব্যাংকারসহ ১৮ ধরনের ব্যক্তিদের চলাচলের ক্ষেত্রে মুভমেন্ট পাসের প্রয়োজন পড়বে না।
সরকার ও জনগণের ‘সম্মিলিত ব্যর্থতা’
বাংলাদেশে করোনাভাইরাসে আক্রান্তদের একাংশ মারা যাচ্ছেন বাড়িতে বা হাসপাতালে আনার পথে।
গত বছরের মে মাসের ১৫ তারিখ থেকে থেকে হাসপাতালের বাইরে করোনাভাইরাসে মৃতদের সংখ্যা প্রকাশ করছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।
সেই তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায় এখন পর্যন্ত হাসপাতালের বাইরে মারা গেছেন প্রায় ৮০০ জন, যা এই রোগে মোট মৃত্যুর প্রায় আট শতাংশ।
সরকারি কর্মকর্তাদের মতে, অনেক ক্ষেত্রেই আক্রান্ত ব্যক্তিরা প্রাথমিকভাবে শারীরিক অবস্থার অবনতি বুঝে উঠতে না পারাই হাসপাতালের বাইরে মৃত্যুর অন্যতম কারণ।
রোগীকে হাসপাতালে নিয়ে আসতে দেরি করা, অথবা রোগীর “অক্সিজেন লেভেল কমে যাওয়ার বিষয়টি” বুঝে উঠতে না পারাও হাসপাতালের বাইরে মৃত্যুর কারণ বলে বেনারকে জানান স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মুখপাত্র ডা. মো. রোবেদ আমিন।
হাসপাতালে করোনা রোগীদের আইসিউ শয্যা সংকটের বিষয়ে ভুক্তভোগীদের অভিযোগ সম্পর্কে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে চিকিৎসা সংক্রান্ত এসব সীমাবদ্ধতার কথা স্বীকার করে তিনি বলেন, “সীমাবদ্ধতা আছে এটা সত্য। কিন্তু রোগী যদি সঠিক সময়ে হাসপাতালে আসতে পারেন তাহলে চিকিৎসা না পেয়ে মারা যাবার ঘটনা ঘটে না।”
গত কয়েক সপ্তায় যারা হাসপাতালের বাইরে মারা গেছেন তাঁদের বেশিরভাগই ফেব্রুয়ারির শেষ অথবা মার্চের শুরুর দিকে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছিলেন বলে মনে করেন সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) উপদেষ্টা ডা. মুশতাক হোসেন।
তিনি বলেন, সেই সময় “দেশে করোনা আর নেই বা উপসর্গকে মৌসুমি জ্বর হিসেবে দেখেছেন অনেকেই।”
মহামারি প্রতিরোধের ক্ষেত্রে সরকার ও জনগণের একটি ‘সম্মিলিত ব্যর্থতা’ রয়েছে মন্তব্য করে ডা. মুশতাক বলেন, “সরকার যে প্রস্তুতি নিয়েছে তা যেমন পর্যাপ্ত নয়, তেমনি মানুষের মধ্যেও স্বাস্থ্যবিধি মানার ক্ষেত্রে ব্যাপক অবহেলা ছিল।”
“এই সামগ্রিক অবহেলাই আমাদের বিপদের দিকে ঠেলে দিয়েছে। এখন প্রতিরোধের মাধ্যমে সংক্রমণ কমানো ছাড়া কোনো বিকল্প নেই,” যোগ করেন তিনি।
পশ্চিমবঙ্গ নির্বাচনে টিকাদান ‘বাধাপ্রাপ্ত’
ভারতে দ্রুতগতিতে বাড়ছে করোনা সংক্রমণ, পাশাপাশি কয়েকটি রাজ্যে চলছে বিধানসভা নির্বাচনও। এর মধ্যে পশ্চিমবঙ্গে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হচ্ছে আট দফায়, যার ভেতর এখন পর্যন্ত শেষ হয়েছে চার দফার ভোট।
সূচি অনুযায়ী বাকি চার দফার ভোট হবে চলতি মাসের ১৭, ২২, ২৬ ও ২৯ তারিখ। নির্বাচনের ফলাফল প্রকাশিত হবে ২ মে।
নির্বাচনে নির্ধারিত করোনা বিধি সঠিকভাবে পালন নিশ্চিত করতে শুক্রবার কলকাতায় একটি সর্বদলীয় বৈঠকের আহ্বান জানিয়েছে নির্বাচন কমিশন।
তবে রাজ্যের সরকারি কর্মীদের নির্বাচনী দায়িত্বে নিয়োজিত করার ফলে করোনাভাইরাসের টিকাদান প্রক্রিয়া বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছে বলে অভিযোগ করেছে কিছু মহল।
রাজ্যে “ভ্যাকসিনের অভাব নেই, কিন্তু প্রশাসনিক দক্ষতার অভাবে সেগুলি ঠিকঠাকভাবে দেওয়া যাচ্ছে না,” বেনারকে বলেন ‘ডক্টরস ফর পেশেন্টস’ নামক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার প্রতিষ্ঠাতা ডা. শারদ্বত মুখোপাধ্যায়।
“রাজ্য সরকার আপাতত নির্বাচন নিয়ে ব্যস্ত, সরকারি কর্মচারীরাও বিভিন্ন জায়গায় নির্বাচনী ডিউটিতে নিযুক্ত, সুতরাং স্বাভাবিকভাবেই ভ্যাকসিনেশন প্রক্রিয়া ব্যাহত হচ্ছে,” বলেন তিনি।
এর আগে ১৩ এপ্রিল এক নির্বাচনী জনসভায় রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় দাবি করেন ‘‘টাকা নিয়ে বসে আছি, কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকার টিকা দিচ্ছে না।’’
ডা. মুখোপাধ্যায়ের মতে, কেন্দ্রের বিজেপি সরকার দেশের সব রাজ্যেই করোনা টিকা সরবরাহ করছে, ফলে সেগুলি কীভাবে ব্যবহার করা হবে, তার দায় রাজ্য সরকারের নেওয়া উচিত।
সরকারিভাবে এখন পর্যন্ত রাজ্যে টিকার অভাব সংক্রান্ত কোনো ঘোষণা করা না হলেও গত কয়েকদিনে কলকাতার কয়েকটি বেসরকারি হাসপাতালে ভ্যাকসিনের অভাবে টিকাকরণ বন্ধ থাকার নোটিশ জারি করা হয়েছে।
দিল্লির জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার অফ সোশ্যাল মেডিসিন অ্যান্ড কমিউনিটি হেলথ-এর প্রাক্তন অধ্যাপক মোহন রাও এর মতে ভারতে “টিকা নিয়ে ভীষণভাবে রাজনীতি চলছে।”
“তথ্য ঘাঁটলেই দেখা যাচ্ছে, অধিকাংশ অ-বিজেপি রাজ্যেই টিকা সরবরাহে যথেষ্ট ঘাটতি রয়েছে। এমন নয় যে যেসব এলাকায় আক্রান্তের সংখ্যা বেশি, সেখানে টিকা পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে,” বেনারকে বলেন এই জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ।
আরেক জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ রবি দুগগলের মতে ভারতে প্রস্তুত টিকা দেশের বাইরে রপ্তানি করার কারণেও টিকাদান কর্মসূচি ব্যাহত হতে পারে।
তিনি বলেন, “ভারতীয় সংসদের রাজ্যসভায় স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী অশ্বিনীকুমার চৌবে যে তথ্য পেশ করেছেন, তার থেকে জানা যাচ্ছে যে ১৬ জানুয়ারি টিকাকরণ প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার পর থেকে ৫ দশমিক ৮৫ কোটিরও বেশি ভারতে প্রস্তুত ভ্যাক্সিন রপ্তানি করেছে কেন্দ্রীয় সরকার, যার ফলে ব্যাহত হতে পারে দেশের টিকাকরণ প্রক্রিয়া।”
ভারতের অন্যতম টিকা প্রস্তুতকারক সংস্থা সেরাম ইন্সটিটিউটের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হলেও তা সম্ভব হয়নি। বেনারনিউজ এ বিষয়ে বুধবার মেইল পাঠালেও বৃহস্পতিবার পর্যন্ত জবাব আসেনি।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে, বাংলাদেশে এ পর্যন্ত করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন সাত লাখ সাত হাজার ৩৬২ জন। বুধবার পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গে মোট আক্রান্তের সংখ্যা ছয় লাখ ৩০ হাজার বলে জানায় রাজ্যের স্বাস্থ্য দপ্তর।
যুক্তরাষ্ট্রের জনস হপকিনস বিশ্ববিদ্যালয়ের হিসাবে, এ পর্যন্ত সারা বিশ্বে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন ১৩ কোটি ৮৬ লাখ ৩৪ হাজারের বেশি মানুষ, মারা গেছেন ২৯ লাখ ৭৮ হাজারের বেশি।
ভারতে এ পর্যন্ত আক্রান্ত হয়েছেন এক কোটি, ৪০ লাখ ৭৪ হাজারের বেশি, মারা গেছেন এক লাখ ৭৩ হাজারের বেশি মানুষ।