করোনাভাইরাস ঠেকাতে চীনা নেতৃত্বে নতুন প্লাটফরমে বাংলাদেশ

জেসমিন পাপড়ি
2021.04.27
ঢাকা
করোনাভাইরাস ঠেকাতে চীনা নেতৃত্বে নতুন প্লাটফরমে বাংলাদেশ ঢাকার বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রে রোগীদের করোনাভাইরাসের টিকা দিচ্ছেন স্বাস্থ্যকর্মীরা। ২৭ এপ্রিল ২০২১।
[ফোকাস বাংলা]

করোনাভাইরাস পরিস্থিতি সামাল দিতে চীনের উদ্যোগে নতুন আঞ্চলিক প্ল্যাটফর্ম ‘ইমারজেন্সি মেডিকেল স্টোরেজ ফ্যাসিলিটি ফর কোভিড ফর সাউথ এশিয়া’-তে যোগ দিতে যাচ্ছে বাংলাদেশ।

মঙ্গলবার চীনের উদ্যোগে ছয় দেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রী পর্যায়ের ভার্চুয়াল বৈঠকে অংশগ্রহণ শেষে সাংবাদিকদের এ কথা জানান পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন। বৈঠকে চীন ও বাংলাদেশ ছাড়া পাকিস্তান, আফগানিস্তান, নেপাল ও শ্রীলঙ্কার পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা অংশ নেন।

করোনাভাইরাসে বিপর্যস্ত ভারতকে ওই সভায় যোগদানের আমন্ত্রণ জানিয়েছিল চীন। তবে পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোমেন বলেন, ভারত সভায় অংশ নেয়নি। 

চীনের আহ্বানে দক্ষিণ এশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের এই সভার পাশাপাশি একই দিন চীনা প্রতিরক্ষামন্ত্রী জেনারেল উয়েই ফেঙ্গহি বাংলাদেশ সফর করেন। 

এসময় চীনের কাছে করোনাভাইরাসের টিকা চেয়েছে বাংলাদেশ। করোনাভাইরাস মোকবেলায় চীনা প্রতিরক্ষামন্ত্রী বাংলাদেশকে সার্বিক সহযোগিতা করতে আগ্রহ প্রকাশ করেন। 

নতুন জোটে যোগ দেওয়ার বিষয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, “চীনের আহ্বানে এই প্ল্যাটফর্মে যোগ দিতে নীতিগতভাবে আমরা সম্মত হয়েছি। মানুষের মঙ্গলের জন্যে যা যা প্রয়োজন সে লক্ষ্যে সব বহুজাতিক উদ্যোগের সঙ্গে থাকবে বাংলাদেশ। একই কারণে গত বছরের মার্চ ভারতের প্রধানমন্ত্রীর আহবানে সার্কের কোভিড-১৯ তহবিলে আমরা শরিক হয়েছিলাম।”

এমন একটি সময়ে চীনের ডাকা এই জোটে বাংলাদেশ যোগ দিতে একমত হয়েছে, যখন ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউট থেকে ত্রিপক্ষীয় চুক্তির আওতায় প্রতিশ্রুত করোনার টিকা পাওয়া যাচ্ছে না। 

সংবাদ সম্মেলনে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. মোমেন জানান, চীন ও দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর সমন্বয়ে কোভিড-১৯ মোকাবেলায় জরুরি চিকিৎসা সামগ্রীর মজুদ গড়ে তোলা হবে, যাতে জরুরি প্রয়োজনে দেশগুলো এ মজুদ থেকে চিকিৎসা সামগ্রী নিতে পারে। 

এ ছাড়া কোভিড–পরবর্তী দারিদ্র্য বিমোচনের জন্য চীনের অভিজ্ঞতার আলোকে একটি কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করা হবে। পাশাপাশি গ্রামীণ জনপদে ব্যবসা বাড়াতে ই-কমার্স সম্প্রসারণের কর্মসূচি নেওয়া হবে, যাতে গ্রামের লোকের ব্যবসাও ভালো থাকে। 

পররাষ্ট্রমন্ত্রী জানান, সমুদ্রের নিকটবর্তী হওয়ায় জরুরি চিকিৎসা সামগ্রীর মজুদ বাংলাদেশে করার প্রস্তাব দেয়া হয়েছে, তবে এখনো স্থান নির্ধারণ হয়নি।

টিকার ব্যাপারে শুরু থেকেই শুধু একটি দেশের ওপর নির্ভরশীল থাকতে না চাওয়ার ফলে ভারতের পাশাপাশি চীন ও রাশিয়ার সাথেও বাংলাদেশ যোগাযোগ করেছিল বলে বেনারকে জানান আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক ড. দেলোয়ার হোসেন। 

তিনি বলেন, “তবে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অনুমোদিত টিকার নেওয়ার বাধ্যবাধকতা থাকায় ভারতে উৎপাদিত অক্সফোর্ড অ্যাস্ট্রাজেনেকার উদ্ভাবিত টিকা কোভিশিল্ড নিতে দেশটির সাথে চুক্তি করে বাংলাদেশ।”

“কিন্তু এখন ভারত টিকা দিতে পারছে না। এমন পরিস্থিতিতে চীন বা রাশিয়ার সাথে যে আলোচনা চলছে তা ইতিবাচক,” বলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের এই অধ্যাপক।

তাঁর মতে, “করোনার টিকার বিষয়টি সর্বজনীনভাবে দেখা উচিত। এ বিষয়ে ভারত কিংবা চীন যারাই আঞ্চলিক উদ্যোগ নেবে বাংলাদেশের সেখানেই থাকা উচিত।” 

দুই সপ্তাহের মধ্যে টিকা আসছে না

বৈঠকে করোনার টিকা পাওয়ার বিষয়ে আলোচনা হয়েছে উল্লেখ করে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, দ্রুত ভ্যাকসিন, মেডিক্যাল গ্রেড অক্সিজেন সাপ্লাই নিয়ে আলোচনা হয়েছে। তবে দুই সপ্তাহের মধ্যে কেউ টিকা দিতে পারবে না।

তিনি বলেন, “বাংলাদেশ বৈঠকে জানিয়েছে, আমাদের জরুরি ভিত্তিতে টিকা লাগবে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অনুমোদন নেই এমন কোনো টিকা আনার সুযোগ তৈরি হলে প্রয়োজনে বাংলাদেশ বিশেষ অনুমতির ব্যবস্থা নেবে।” 

ড. মোমেন বলেন, “যুক্তরাষ্ট্র অ্যাস্ট্রাজেনেকার কিছু টিকা বিক্রি করবে। আমরা সেটা আনারও চেষ্টা করব। চুক্তির বাকি টিকা আনতে ভারতের সঙ্গে যোগাযোগ হচ্ছে। অন্য দেশগুলো থেকে টিকা আনার বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী সম্মতি দিয়ে রেখেছেন।” 

উল্লেখ্য, করোনার টিকা উদ্ভাবনের পর চীন টিকার ট্রায়াল পরিচালনা ও সরবরাহের বিষয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে আলোচনা করলেও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অনুমোদন না থাকায় বাংলাদেশ তা গ্রহণ করেনি। 

গত নভেম্বরে ভারত থেকে অক্সফোর্ড অ্যাস্ট্রাজেনেকার তিন কোটি ডোজ টিকা আনতে চুক্তি করে বাংলাদেশ। প্রতি মাসে ৫০ লাখ ডোজ আসার কথা ছিল। কিন্তু অর্থ অগ্রিম পরিশোধের পরও ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউট বাংলাদেশকে ভ্যাকসিন সরবরাহ করতে পারছে না।

ভারত সরকারের ৩৩ লাখ ডোজ উপহারসহ এখন পর্যন্ত এক কোটি ৩ লাখ ডোজ টিকা দেশে এসেছে। এমন পরিস্থিতিতে দেশে টিকার প্রথম ডোজ দেওয়া বন্ধ রয়েছে। দ্বিতীয় ডোজের টিকার ঘাটতি আছে ১০ লাখের বেশি। এমতাবস্থায় টিকা পেতে অন্য দেশগুলোর সঙ্গে দেনদরবার শুরু করেছে বাংলাদেশ। 

রাশিয়ার টিকা ব্যবহারের অনুমোদন

করোনাভাইরাস প্রতিরোধে টিকা পেতে এবার রাশিয়ার উদ্ভাবিত টিকা স্পুটনিক ভি ব্যবহারে জরুরি অনুমতি দিয়েছে বাংলাদেশ। মঙ্গলবার ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মাহবুবুর রহমান এ কথা জানান।

তিনি জানান, মে মাসের মধ্যেই স্পুটনিক ভি’র ৪০ লাখ ডোজ দেশে আসবে। চীনের সিনোফার্ম'র টিকা নিয়েও খুব শিগগির সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।

এদিকে চীন উপহার হিসেবে বাংলাদেশকে সিনোফার্মের তৈরি পাঁচ লাখ ডোজ টিকা দিচ্ছে বলে রোববার সাংবাদিকদের জানান স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক (ডিজি) অধ্যাপক ডা. আবুল বাসার মোহাম্মদ খুরশীদ আলম।

এই টিকা গ্রহণ করার পরে তা কখন, কীভাবে প্রয়োগ করা হবে সে বিষয়ে নীতি-নির্ধারকেরা সিদ্ধান্ত নেবেন বলে জানান তিনি।

এর আগে কোন কোন দেশ থেকে টিকা আনা যায়, সে বিষয়ে মতামত দিতে গত ২০ এপ্রিল প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিবের নেতৃত্বে অনুষ্ঠিত সভায় আট সদস্যের একটি কমিটি করা হয়। 

প্রতিরক্ষা খাতে সহযোগিতার আশ্বাস চীনের

সংবাদ সংস্থা বাসস জানায়, বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনীর উন্নয়নে কৌশলগত সহযোগিতা অব্যাহত রাখার আশ্বাস দিয়েছে চীন। পাশাপাশি কোভিড-১৯ মহামারি মোকাবেলায় বাংলাদেশকে সার্বিক সহযোগিতার আগ্রহ প্রকাশ করেছে দেশটি। 

মঙ্গলবার বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎকালে এ কথা জানান সফররত চীনের প্রতিরক্ষা মন্ত্রী জেনারেল উয়েই ফেঙ্গহি।

চীনের প্রতিরক্ষামন্ত্রী জানান, চীন ও বাংলাদেশের মধ্যে সামরিক সহযোগিতা ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ ছাড়া রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধানেও চীন কাজ করে যাচ্ছে।

কয়েক ঘণ্টার এই সফরে বাংলাদেশের সেনাপ্রধান জেনারেল আজিজ আহমেদের সাথেও সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন চীনের প্রতিরক্ষামন্ত্রী।

এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর (আইএসপিআর) জানিয়েছে, চীনের প্রতিরক্ষা মন্ত্রী প্রতিরক্ষা সহযোগিতা, যৌথ প্রশিক্ষণ কার্যক্রম, প্রতিরক্ষা সক্ষমতা বৃদ্ধি ইত্যাদি ক্ষেত্রে বাংলাদেশ-চীন সহযোগিতা বৃদ্ধির ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন। চলমান কোভিড-১৯ মহামারি নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর সাথে চীনের অভিজ্ঞতা বিনিময় ও সহায়তার প্রস্তাবও করেন তিনি।

বাংলাদেশ সেনাবাহিনী প্রধানও দুই দেশের পারস্পরিক সম্পর্কোন্নয়ন, সামরিক প্রশিক্ষণ বিনিময়, সশস্ত্র বাহিনী পর্যায়ে নিয়মিত মত বিনিময় অব্যাহত রাখার প্রত্যয় ব্যক্ত করেন।

বিশ্লেষকেরা বলছেন, বাংলাদেশে সামরিক ও প্রতিরক্ষা সরঞ্জামের বেশির ভাগই চীন থেকে আসে। এ সম্পর্ক আরো জোরালো করার আগ্রহ আছে চীনের।

অধ্যাপক ড. দেলোয়ার হোসেন বলছিলেন, “চীনের সাথে আমাদের প্রতিরক্ষা সম্পর্ক অনেক শক্তিশালী। একমাত্র চীনের সাথেই আমাদের দ্বিপাক্ষিক প্রতিরক্ষা চুক্তি রয়েছে।”

তিনি বলেন, “চীনের প্রতিরক্ষামন্ত্রীর এই সংক্ষিপ্ত সফরে খুব বেশি আলোচনা বা সিদ্ধান্ত গ্রহণের সুযোগ না থাকলেও দুই দেশের প্রতিরক্ষা সম্পর্ককে আরো বেশি উষ্ণ বা শক্তিশালী করার ইঙ্গিত বহন করে।”

ভারতের সেনা প্রধান জেনারেল মনোজ মুকুন্দ নরভানের ঢাকা সফরের দুই সপ্তাহের মাথায় জেনারেল উয়েই ফেঙ্গহির ঢাকা সফর দুদেশের প্রতিরক্ষা খাতে ভিন্ন মাত্রা প্রতিষ্ঠার প্রতিফলন বলে মনে করেন এই আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক।

এর আগে ২০১৬ সালে চীন থেকে দুটি সাবমেরিন বা ডুবোজাহাজ কেনে বাংলাদেশ। ‘নবযাত্রা’ ও ‘জয়যাত্রা’ নামের এই সাবমেরিন রাখতে চীনের সহায়তায় কক্সবাজার জেলার কুতুবদিয়ার পেকুয়াতে সামরিক ডুবোজাহাজ ঘাঁটিও নির্মাণ করছে বাংলাদেশ, যা নির্মাণ করতে ব্যয় হবে এক হাজার কোটি টাকার বেশি। এটিই হবে দেশের প্রথম সামরিক ডুবোজাহাজ ঘাঁটি। 

চীনের প্রতিরক্ষামন্ত্রীর গত বছর নভেম্বরে নেপাল ও বাংলাদেশ সফরের কথা ছিল। সে সময় তিনি নেপাল সফর করলেও বাংলাদেশ সফর স্থগিত হয়। সেই স্থগিত হওয়া সফরই অনুষ্ঠিত হলো। 

ঢাকা থেকে জেনারেল উয়েই ফেঙ্গহি তিন দিনের সফরে শ্রীলঙ্কা গেছেন। 

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।