রাঙ্গামাটিতে অপহৃত ১২ জনের মুক্তি, প্রতিবাদ কর্মসূচিতে বাধা
2018.07.09
ঢাকা
পার্বত্য রাঙ্গামাটি জেলার দুর্গম উপজেলা নানিয়ারচরে চার দিনের ব্যবধানে দুই দফায় ১৮ জন গ্রামবাসী অপহৃত হবার পর মুক্তিপণের বিনিময়ে তাঁদের ১২ জন ফিরে এসেছেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে ঘটনার বর্ণনা দিয়ে মুক্তি পাওয়া একজন বলেন, “ইঞ্জিনচালিত নৌকা থেকে তুলে আমাদের একটি অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে গিয়ে স্বজনদের কাছে একবারের জন্য মোবাইলে কথা বলতে দেওয়া হয় এবং আমাদের প্রত্যেকের কাছে ১৫ থেকে ৩০ হাজার টাকা দাবি করা হয়।”
অপহরণকারীদের হাতে ভারী অস্ত্র থাকলেও তারা আমাদের নির্যাতন করেনি। তবে টাকা ও অপহরণকারীদের বিষয়ে কোনো কিছু প্রকাশ না করার শর্ত দেওয়া হয়,” বলেন তিনি।
এদিকে অপহরণের ঘটনা নিশ্চিত করেনি পুলিশ। অপহৃতদের উদ্ধারের দাবিতে ডাকা সোমবারের মানববন্ধন কর্মসূচি পালনেও বাধা দিয়েছে স্থানীয় প্রশাসন।
গত ৮ জুলাই সকালে স্থানীয় কাপ্তাই হ্রদের হাতিমারা দোর এলাকার একটি টিলার সামনে থকে অস্ত্রের মুখে ট্রলার থামিয়ে ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্টের (ইউপিডিএফ) প্রশাসনিক বিভাগের পরিচালক বকুল চাকমাসহ মোট ১৬ জনকে অপহরণ করা হয়। এর আগে বুধবার (৪ জুলাই) উপজেলা বাজার থেকে অপহৃত হন আরও দুজন।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, রোববার সন্ধ্যা ও রাতে অপহৃত ১৬ জনের মধ্যে ১২ জনকে মুক্তি দেওয়া হয়। মুক্তির বিনিময়ে প্রত্যেকের কাছ থেকে ১৫ থেকে ৩০ হাজার টাকা করে নেওয়া হয়েছে। আর যারা মুক্তিপণ দিতে পারেননি তাঁদের এখনো আটকে রাখা হয়েছে। এরা হলেন বকুল চাকমা (৪২), দেব রঞ্জন চাকমা (৫০), বায়ু ধন চাকমা (৫২), সুনীল কান্তি চাকমা (৫০) সুখেন্তু চাকমা (৫০) ও ত্রিদিব চাকমা (৪৮)।
এ ঘটনার জন্য ইউপিডিএফ পাহাড়ের দুই আঞ্চলিক দল জনসংহতি সমিতি (এমএন লারমা) ও ইউপিডিএফ গণতান্ত্রিককে দায়ী করলেও এ অভিযোগ অস্বীকার করে দল দুটি।
কর্মসূচিতে বাধা
নানিয়ারচর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবদুল লতিফ বেনারকে জানান, প্রতিবাদীরা মঙ্গলবার সকাল-সন্ধ্যা সড়ক ও নৌপথ অবরোধের যে ডাক দিয়েছে, তা অযৌক্তিক। এটা করতে দেওয়া হবে না।
ওসির দাবি, “১৮ জন অপহরণের ঘটনা সম্পূর্ণ মিথ্যা। আমার কাছে কোনো তথ্য নেই। এগুলো সাজানো নাটক।”
রাঙ্গামাটির পুলিশ সুপার (এসপি) মোহাম্মদ আলমগীর কবিরও ঘটনার কোনো সত্যতা পাওয়া যায়নি বলে জানান। অপহরণের খবর পেয়ে রোববার বিকেলেই তিনি নানিয়ারচরে গিয়েছিলেন।
এদিকে অপহরণের ঘটনার জন্য ইউপিডিএফ ও পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির (জেএসএস) সংস্কারপন্থী গ্রুপ ‘ইউপিডিএফ-গণতান্ত্রিক’ ও ‘জেএসএস-এমএন লারমা’ সমন্বিত সন্ত্রাসী গোষ্ঠী ‘নব্য মুখোশ বাহিনী’-কে দায়ী করে বিবৃতি দিয়েছে ইউপিডিএফ’র মূলধারার নেতারা।
একই সঙ্গে প্রতিবাদ কর্মসূচি ঘোষণা করে নানিয়ারচর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান জ্যোতি লাল চাকমার নেতৃত্বে গড়ে ওঠা নব্য মুখোশ বাহিনী প্রতিরোধ কমিটি।
ইউপিডিএফ’র মূলধারা সমর্থিত এই কমিটির অভিযোগ, অপহরণকারীরা নানিয়ারচর সদরে প্রশাসনের নাকের ডগায় অবস্থান করলেও তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না।
রাষ্ট্রীয় বাহিনীর মদদে গত নভেম্বর থেকে এই ‘নব্য মুখোশ বাহিনী’ সক্রিয় রয়েছে দাবি করে মাইকেল চাকমা বলেন, “প্রশাসন তাদের রক্ষা করতে তৎপর। তারা সাধারণত থানা, সেনাক্যাম্পের আশপাশেই থাকে। যে কারণে তাদের বিরুদ্ধে মামলা বা অভিযোগ করতে যেতে ভয় পায় স্থানীয়রা।”
তবে এসপি আলমগীর বলেন, “এটা সত্য নয়। চাইলে তারা কুরিয়ার বা মেইল করেও অভিযোগ পাঠাতে পারে। প্রয়োজনে রাঙ্গামাটি শহরে এসে সরাসরি আমার কাছেও অভিযোগ করা যায়।”
“সাধারণত পার্বত্য এলাকার মানুষ আসলে পুলিশের কাছে আসতে চায় না। তারা মামলা করে না, তদন্তেও তাদের সহায়তা পাওয়া যায় না । এ ব্যাপারে তাদের সচেতন করার চেষ্টা চলছে,” যোগ করেন এই পুলিশ কর্মকর্তা।
নেপথ্যে নির্বাচন
এসপি আলমগীর জানান, নানিয়ারচর কেন্দ্রিক সব অরাজকতার নেপথ্যে রয়েছে আগামী ২৫ জুলাই অনুষ্ঠিতব্য নানিয়ারচর উপজেলা পরিষদের উপনির্বাচন এবং আগামী ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিতব্য জাতীয় নির্বাচন।
তিনি বলেন, “এটা আসলে তাদের ‘ইলেকশন স্ট্র্যাটেজি’; আর কিছু না। এর মাধ্যমে তারা নির্বাচনগুলোয় প্রভাব বিস্তার করার চেষ্টা করবে।”
এর আগে গত ৩ মে এই উপজেলার নির্বাচিত চেয়ারম্যান, জেএসএস-এমএন লারমা গ্রুপের নেতা অ্যাডভোকেট শক্তিমান চাকমাকে প্রকাশ্যে গুলি করে হত্যা করা হয়।
পরদিন ৪ মে তার দাহক্রিয়ায় যাওয়ার পথে ইউপিডিএফ-গণতান্ত্রিকের প্রধান তপন জ্যোতি চাকমা ওরফে বর্মাসহ পাঁচজন একইভাবে নিহত হন।
এই দুটি ঘটনা স্মরণ করিয়ে দিয়ে এসপি বেনারকে বলেন, “শক্তিমান বা তপন প্রার্থী না হলেও জাতীয় নির্বাচন প্রভাব ফেলতে সক্ষম ছিলেন।”
“এর আগে তারা বহুবার নানিয়ারচরের ৩২ হাজার ভোট ও বাঘাইছড়ির ২৬ হাজার ভোট নিয়ন্ত্রণ করেছেন বলে আমাদের কাছে রিপোর্ট আছে,” বলেন তিনি।
এদিকে আসন্ন নির্বাচনে জেএসএস আর ইউপিডিএফ সংস্কারপন্থীরা তাদের সমর্থিত প্রার্থীকে নির্বাচনে বিজয়ী করতে প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করছে উল্লেখ করে মাইকেল চাকমা বলেন, “তারা হুমকি দিয়েছে, আরও লোকজনকে অপহরণ করবে।”
“অপহৃত ১৮ জনের মধ্যে বকুল ছাড়া কেউ রাজনীতির সাথে জড়িত না হলেও বিভিন্ন গ্রামের প্রধান ও মুরুব্বি। তাদের প্রত্যেকের ভোটে প্রভাব ফেলার ক্ষমতা রয়েছে,” বলেও মাইকেল দাবি করেন।
তবে ওসি লতিফ বলেন, “এ জাতীয় অপহরণের ঘটনাগুলো আসলে বানোয়াট। প্রায় প্রতিদিন একজন - দুইজন অপহরণ হয়েছে, এমন রব উঠিয়ে পাহাড়ের আঞ্চলিক রাজনৈতিক দলগুলো এক ধরনের ত্রাস সৃষ্টি করে রাখে।”
“তিন মাসে আগেও একবার শোনা গিয়েছিল, ২০ জন অপহরণ হয়েছে। পরে দেখা গেছে অপহৃত সবাই যার যার বাড়িতেই আছে,” বলেন তিনি।
নির্বাচনী পরিস্থিতি সুষ্ঠু রাখতে স্থানীয় প্রশাসন ইতিমধ্যে ‘বাড়তি ব্যবস্থা’ নিয়েছে জানিয়ে এসপি বলেন, “নির্বাচনের আগে বিভিন্ন এলাকায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অস্থায়ী ক্যাম্প হবে।” এ ব্যাপারে ওসির বক্তব্য, “নির্বাচনের ব্যাপারে আমরা সর্বোচ্চ সতর্ক থাকব।”
চাঁদাবাজিতে প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা
অপহৃত গ্রাম প্রধান ও মুরব্বিদের কাছে ইউপিডিএফ-গণতান্ত্রিক ও জেএসএস-এমএন লারমা গ্রুপ চাঁদাও দাবি করেছিল বলে মাইকেল অভিযোগ করেন।
তিনি বলেন, “প্রতি বাড়ি থেকে পাঁচ শ থেকে এক হাজার টাকা হারে প্রতি গ্রাম থেকে ১০ হাজার থেকে এক লাখ টাকা অবধি চাঁদা ধরেছে তারা।”
এসপি আলমগীর এবং ওসি লতিফ পাহাড়িদের প্রধান চারটি রাজনৈতিক গ্রুপের এই চাঁদাবাজির সত্যতা স্বীকার করেন।
এসপির অভিমত, “পার্বত্য এলাকার চারটি আঞ্চলিক রাজনৈতিক গ্রুপ মূলত এই চাঁদাবাজিতে প্রভাব বিস্তারের চেষ্টায় নিজেদের মধ্যে সংঘর্ষে লিপ্ত।”
ওসি বলেন, “তারা বাঙালিদের সাথে মেশে না। দেশের সার্বভৌমত্ব, সরকার, আইনকানুন—কিছুই মানে না।”
বাঙালিদের সংগঠন পার্বত্য নাগরিক পরিষদের চেয়ারম্যান ও পার্বত্য বাঙালি ছাত্র পরিষদ'র উপদেষ্টা কমিটির সভাপতি আলকাছ আল মামুন ভূঁইয়া বেনারকে বলেন, “পার্বত্য চট্টগ্রামের সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো বছরে প্রায় চার শ’কোটি টাকার চাঁদাবাজি করে থাকে।”
প্রতিবেদনে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন ঢাকা থেকে জেসমিন পাপড়ি