চুয়াডাঙ্গা-নেত্রকোনায় দুই শিশুর মাথা কাটার নেপথ্যে ‘বলাৎকার’
2019.07.26
ঢাকা
পদ্মা সেতুর জন্য মানুষের মাথা লাগবে—এমন গুজব ছড়িয়ে পড়ার পর বাংলাদেশে যে দুই ছেলে শিশুর মাথাবিহীন লাশ উদ্ধার হয়েছে, তারা দুজনেই যৌন নির্যাতনের শিকার বলে জানিয়েছে পুলিশ।
এদের মধ্যে চুয়াডাঙ্গার আলমডাঙ্গা উপজেলায় নিহত মাদ্রাসা ছাত্র আবির হুসাইনকে (১১) হত্যার আগে বলাৎকার করা হয়েছে বলে জানান জেলার পুলিশ সুপার সুপার মাহবুবুর রহমান। শুক্রবার বেনারকে তিনি বলেন, “ময়না তদন্তে দীর্ঘদিন ধরে পাশবিক নির্যাতন করারও প্রমাণ মিলেছে।”
নির্যাতনের এই ঘটনা ধামাচাপা দিতেই আবিরকে হত্যা করা হয়েছে বলে প্রাথমিক ধারণা পুলিশের।
এসপির দাবি, “হত্যার ঘটনাটি সুকৌশলে ভিন্ন খাতে নিতেই তাঁর মাথা কেটে গুম করা হয়। পদ্মা সেতুর জন্য মাথা কেটে নিয়ে যাওয়া হয়েছে বলেও ‘স্যোশাল মিডিয়াতে’ প্রচারণা চালানো হয়েছে।”
এর আগে নেত্রকোনায় ১৮ জুলাই পৌর শহরের কাটলী এলাকায় সাত বছর বয়সী শিশু সজীব মিয়াকে ‘বলাৎকার’ করেন রবিন নামের মাদকাসক্ত এক রিকশাচালক।
পুলিশ সদর দপ্তরের মিডিয়া সেন্টারে বুধবার এক সংবাদ সম্মেলনে পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) মোহাম্মদ জাবেদ পাটোয়ারী বলেন, “সজীব নামে যে শিশুটি মারা গেছে, মৃত্যুর আগে রবিন তাঁকে বলাৎকার করেছিল। সুরহতাল ও ময়নাতদন্তে সেই প্রমাণ পাওয়া গেছে।”
“শিশুটি হয়তো প্রতিরোধ করতে চেয়েছিল, তাই তাঁকে গলা কেটে হত্যা করা হয়েছে। অথবা ঘটনাটি সে তাঁর পরিবারকে জানিয়ে দেবে, সেই চিন্তা থেকেও হত্যা করা হতে পারে,” যোগ করেন পুলিশ প্রধান।
তবে আইন ও সালিশ কেন্দ্রের সাবেক নির্বাহী পরিচালক নূর খান লিটন বেনারকে বলেন, “পুলিশ যা বলছে, সাধারণ মানুষ তা বিশ্বাস করছে, নাকি তারা অন্যকিছু ধারণা করে নিচ্ছে, তা ভেবে দেখার বিষয়। কারণ মানুষ এখন পুলিশের কথা সহজে বিশ্বাস করে না।”
যদিও আন্তর্জাতিক সংস্থা সেভ দ্য চিলন্ড্রেনের শিশু সুরক্ষা বিষয়ক পরিচালক আবদুল্লাহ আল মামুন বেনারকে বলেন, “ময়না তদন্তে যদি বলাৎকারের প্রমাণ পাওয়া যায়, তবে সেটা অবশ্যই হয়েছে।”
নুরানী হাফিজিয়া মাদ্রাসার দ্বিতীয় শ্রেণির ছাত্র আবির গত মঙ্গলবার সন্ধ্যার দিকে নিখোঁজ হয়। পরদিন মাদ্রাসা সংলগ্ন আমবাগানের ভেতর থেকে তাঁর মাথাবিহীন মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। চুয়াডাঙ্গা ও খুলনা ফায়ার সার্ভিসের ডুবুরি দল বৃহস্পতিবার সকালে মাদ্রাসার পাশের একটি পুকুরে বিচ্ছিন্ন মাথাটি খুঁজে পায়।
আর গত সপ্তাহে নেত্রকোনায় সজীবের হত্যাকারী রবিনকে হাতেনাতে ধরে ফেলে স্থানীয়রা। রবিন কাটা মাথা ব্যাগে নিয়ে পালানোর সময় ধরা পড়লে তাকে পিটিয়ে হত্যা করে স্থানীয়রা। ওই দিন বিকেলে নির্মাণাধীন একটি ভবন থেকে শিশুটির বাকি দেহ উদ্ধার করে পুলিশ।
নিপীড়ন আড়ালের হাতিয়ার
শিশু সুরক্ষা ও মানবাধিকার বিশ্লেষকদের মতে, ‘গলা কাটার গুজব’ এখন যৌন ‘নিপীড়ন আড়ালের হাতিয়ার’ হয়ে উঠেছে।
শিশু সুরক্ষা বিশ্লেষক আবদুল্লাহ আল মামুন বেনারকে বলেন, “ছেলে শিশু বলাৎকার নতুন কিছু নয়, এটা আছেই। এখন নিজের অপরাধ আড়াল করতে গুজবকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করা হতে পারে।”
তিনি জানান, ২০১৯ সালের প্রথম ছয় মাসে সারা দেশে ৫৩৯ জন শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে, যার মধ্যে ছেলে শিশু পাঁচজন। এর মধ্যে দুজনকে বলাৎকারের পর মেরে ফেলা হয়েছে। একই সময়ে আরো ২৩ মেয়ে শিশুকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়।
মানবাধিকার কর্মী নূর খান লিটন বলেন, “এখন ছেলে শিশুরাও কিন্তু মেয়েদের মতো ঝুঁকির মুখোমুখি। এমনিতেই আমাদের দেশে ছেলে শিশুদের ‘বলাৎকার’ নিয়ে উচ্চবাচ্য হয় না।”
“এমন ঘটনায় গত ১০ বছরে অনেকে গ্রেপ্তার হয়েছে, অথচ একটিও সাজার খবর পাইনি,” যোগ করেন আসকের এই সাবেক নির্বাহী।
প্রশ্নবিদ্ধ শিশু সুরক্ষা বলয়
“একটি শিশু বলাৎকারের শিকার তখনই হচ্ছে, যখন তাঁর সুরক্ষা বলয় দুর্বল, সেটা প্রাতিষ্ঠানিক হোক বা পারিবারিক। এটাকে আরো শক্তিশালী করে তুলতে হবে,” বলেন আবদুল্লাহ আল মামুন।
“গুজবের সুযোগ নিয়ে নিজের অপরাধকে আড়াল করার জন্য যদি কেউ এ ধরনের কাণ্ড ঘটায়, সেক্ষেত্রে রাষ্ট্রের দায়িত্বটা অনেক বেশি। গুজবের কারণে এ জাতীয় অপরাধগুলো যেন অন্য প্রলেপের আড়ালে চলে না যায়, সেদিকে সরকার এবং আইনশৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনীর নজর দিতে হবে,” বেনারকে বলেন তিনি।
মোহতামিমের বক্তব্য অসংলগ্ন
চুয়াডাঙ্গার এসপি জানান, আবির হত্যার ঘটনায় তাঁর মাদ্রাসার পাঁচ শিক্ষককে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আটক করা হয়েছে। এর মধ্যে প্রতিষ্ঠানটির মোহতামিম আবু হানিফকে প্রধান সন্দেভাজন হিসেবে চিহ্নিত করেছেন তারা।
“আমাদের হাতে থাকা তথ্য-প্রমাণ এবং উনার কথাবার্তায় অসংলগ্নতা ছিল। অনেক প্রশ্নেরই কোনো সন্তোষজনক জবাব দিতে পারেননি তিনি,” বেনারকে বলেন তিনি।
এর আগে গত সোমবার একাধিক ধর্ষণ ও বলাৎকারের সুনির্দিষ্ট অভিযোগে রাজধানীর দক্ষিণখান এলাকার একটি মসজিদের ইমাম ইদ্রিস আহম্মেদকে (৪২) গ্রেপ্তার করার কথা জানায় র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব)।
তিনি মসজিদে নামাজ পড়ানোর পাশাপাশি একটি মাদ্রাসায় শিক্ষকতা করতেন।
বিগত বছরগুলোর তুলনায় শিশু ধর্ষণ ও হত্যার ঘটনা মাত্রাতিরিক্ত হারে বেড়েছে উল্লেখ করে নূর খান লিটন বেনারকে বলেন, “মাদ্রাসাগুলোয় ছেলে শিশু বলাৎকারের ঘটনা একটু বেশি ঘটে।”
তবে শিশু সুরক্ষা বিশ্লেষক মামুনের দাবি, “আমাদের দেশে মোট আবাসিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ৮০ শতাংশই যেহেতু মাদ্রাসা, সেহেতু সেখানে এমনটা হওয়ার কথা বেশি জানা যাচ্ছে। কিন্তু শুধু মাদ্রাসা নয়, প্রতিটি আবাসিক শিক্ষালয় ও কর্মস্থলে কমবেশি এমনটা ঘটে।”
তিনি আরও বলেন, “ছেলে শিশু বলাৎকার পরিস্থিতি আসলেই ভয়ঙ্কর। এ ক্ষেত্রে বয়সে ছোট ও দুর্বলেরাই বেশি শিকার হয়।”