বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গে ঘূর্ণিঝড় ‘ইয়াস’ আতঙ্ক, আঘাত করতে পারে বুধবার

কামরান রেজা চৌধুরী ও যাজ্ঞসেনী চক্রবর্তী
2021.05.24
ঢাকা ও কলকাতা
বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গে ঘূর্ণিঝড় ‘ইয়াস’ আতঙ্ক, আঘাত করতে পারে বুধবার বঙ্গোপসাগরে জলোচ্ছ্বাসের কারণে নোয়াখালীর হাতিয়ার জনবসতি প্লাবিত হওয়ার উপক্রম। প্রায় সব ঘূর্ণিঝড়েই কমবেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় এই দ্বীপটি। ২৪ মে ২০২১।
[ফোকাস বাংলা]

করোনাভাইরাস মহামারির মধ্যে বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গে শুরু হয়েছে ঘূর্ণিঝড় ‘ইয়াস’ আতঙ্ক। মহামারিকালে এই অঞ্চলে এটি দ্বিতীয় ঘূর্ণিঝড়। গত বছরের মে মাসে ঘূর্ণিঝড় আম্পানে বাংলাদেশে অন্তত ২৫ ও পশ্চিমবঙ্গে ৮৫ জনের বেশি মানুষ প্রাণ হারিয়েছিলেন।

তবে ইয়াসের ক্ষয়ক্ষতি মোকাবেলায় ব্যাপক প্রস্তুতি নিয়েছে দুই বাংলার সরকার। 

আবহাওয়া পূর্বাভাস অনুযায়ী, ২৬ মে বুধবার দুপুর নাগাদ বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট অতি শক্তিশালী এই ঘূর্ণিঝড় ভারতের উত্তর ওড়িশার বালাসোর এবং পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলার সাগর দ্বীপ এলাকায় আঘাত হানতে পারে। একই দিনে এটি আঘাত আনতে পারে বাংলাদেশ উপকূলেও। 

ঘূর্ণিঝড়ের ক্ষয়ক্ষতি থেকে উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষ এবং বঙ্গোপসাগরের দ্বীপ ভাসানচর ও কক্সবাজারে অবস্থানরত রোহিঙ্গাদের রক্ষা করতে ১২ হাজার ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত রেখেছে সরকার। 

আম্পানের অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে ইয়াস মোকাবেলায় ব্যাপক প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে বলে বেনারকে জানান দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ সচিব মো. মোহসিন।

কারণ সাইক্লোনটির গতিপথ ভারতের দিকে হলেও সেটি যে কোনো মুহূর্তে দিক পরিবর্তন করে বাংলাদেশ উপকূলে আঘাত করলে যাতে ক্ষয়ক্ষতি কম হয়, সে দিকেই জোর দিচ্ছেন কর্মকর্তারা। 

ঠিক এক বছর আগে বঙ্গোপসাগরে সৃষ্টি হয়ে বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গে আঘাত করে আম্পান। সরকারি তথ্য অনুযায়ী, এতে বাংলাদেশে কমপক্ষে ২৫ জন ও পশ্চিমবঙ্গে অন্তত ৮৬ জন মানুষ প্রাণ হারান। 

ভাসানচরে রোহিঙ্গারা আতঙ্কে

গত বছর ঘূর্ণিঝড় আম্পানের সময় নোয়াখালীর হাতিয়া উপজেলার দ্বীপ ভাসানচরে ছিলেন মাত্র ৩০০ জনের মতো রোহিঙ্গা। অবৈধভাবে মালয়েশিয়া যাবার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে ফিরে আসার পর সমুদ্র থেকে উদ্ধার করে তাঁদের সেখানে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। 

এরপর গত ডিসেম্বর থেকে কক্সবাজারে শরণার্থী শিবিরগুলো থেকে প্রায় ১৯ হাজার রোহিঙ্গাকে ভাসানচরে স্থানান্তর করে সরকার। 

জাতিসংঘ শরণার্থী সংস্থার (ইউএনএইচসিআর) মতে, ভাসানচর দুর্যোগপ্রবণ দ্বীপ। সেখানে জলোচ্ছ্বাসের ঝুঁকি অনেক বেশি। গত মার্চের মাঝামাঝি জাতিসংঘের প্রতিনিধিরা দ্বীপটি পরিদর্শন করে এলেও সেখানে রোহিঙ্গা স্থানান্তরের বিষয়ে এখনো কোনো মতামত দেননি। 

এদিকে ঘূর্ণিঝড় ‘ইয়াস’এর আতঙ্কে রয়েছেন বলে বেনারকে জানিয়েছেন  ভাসানচরে থাকা রোহিঙ্গারা।

“শুনছি ঘূর্ণিঝড় আসছে, এ কারণে সবাই খুব ভয়ের মধ্যে আছি,” বেনারকে বলেন ভাসানচরে বসবাসকারী রোহিঙ্গা শরণার্থী লালু বেগম।

“সাগর খুব উত্তাল দেখা যাচ্ছে। ঘূর্ণিঝড় নিয়ে সবাই চিন্তিত,” বেনারকে বলেন ওই দ্বীপের অন্য শরণার্থী মো. হাছন।

তবে দুর্যোগ সচিব মো. মোহসিন জানান, এখন পর্যন্ত থাকা তথ্যমতে, আশা করা যাচ্ছে বাংলাদেশে জলোচ্ছ্বাস ছাড়া বড়ো কিছু হয়ত হবে না। 

তবু আঘাতের সম্ভাবনা মাথায় রেখে সকল উপকূলীয় জেলায় ১২ হাজারের অধিক ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত রাখা হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, “ভাসানচরে অবস্থানকারী রোহিঙ্গারা আরো বেশি নিরাপদ।”

“কারণ, সেখানে আমরা কমপক্ষে ১১০টি আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত রেখেছি। প্রতিটি আশ্রয়কেন্দ্রের ধারণ ক্ষমতা এক হাজার ২০০ জন।” 

ঘূর্ণিঝড় ইয়াসে ভাসানচরে বেশি ক্ষয়ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা নেই জানিয়ে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিষয়ক বিশেষজ্ঞ আব্দুল লতিফ খান বেনারকে বলেন, “কারণ পূর্ণিমার মধ্যেও যে উচ্চতায় জলোচ্ছ্বাস হয় ভাসানচরকে রক্ষা করতে তার চেয়েও বেশি উচ্চতায় বাঁধ নির্মাণ করা হয়েছে।” 

আতঙ্ক রোহিঙ্গা শিবিরেও 

বন্যা, পাহাড় ধসের কারণে সব সময়ই আতঙ্কে থাকতে হয় কক্সবাজারের উখিয়া-টেকনাফে বসবাস করে প্রায় ১১ লাখ রোহিঙ্গার। ঘূর্ণিঝড় ইয়াস’র আতঙ্কও কাজ করছে তাঁদের ভেতর।

“বেশিরভাগ রোহিঙ্গা পাহাড়ি এলাকায় বসবাস করে, তাই ঘূর্ণিঝড়ের আভাস পেলেই আতঙ্কিত হয়,” বেনারকে বলেন উখিয়ার কুতুপালং এর রোহিঙ্গা নেতা মো. নূর। 

তবে রোহিঙ্গা শিবিরে ঘূর্ণিঝড় মোকাবেলায় সব ধরনের প্রস্তুতি রয়েছে বলে বেনারকে জানান কক্সবাজার অতিরিক্ত শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার শামসু দ্দৌজা নয়ন। 

তিনি বলেন, “যদিও এদিকে ঘূর্ণিঝড়ের আঘাত হানার সম্ভাবনা কম, তবুও আমরা সব ধরনের প্রস্তুতি রেখেছি।”

শিবিরের সকল কার্যালয়, মসজিদ, মাদ্রাসা, লার্নিং সেন্টার, দেশি–বিদেশি সংস্থার ভবনসহ ভালো ভালো স্থাপনাগুলোকে আশ্রয় শিবির হিসাবে ব্যবহার করা হবে বলে জানান শামসু দ্দৌজা। 

রাজ্যবাসীকে সতর্ক করলেন মমতা

ঘূর্ণিঝড় ইয়াস মোকাবেলায় সামাজিক মাধ্যমে সরাসরি সম্প্রচারিত এক সাংবাদিক বৈঠকে সোমবার রাজ্যবাসীকে সতর্ক থাকার পরামর্শ দিয়েছন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। 

তিনি জানান, রাজ্যের উপকূলবর্তী এলাকায় বসবাসকারী মানুষদের নিরাপদে সরিয়ে নেওয়ার প্রক্রিয়া চলছে এবং মৎস্যজীবীদের আগামী দুই দিন সমুদ্রে যেতে নিষেধ করা হয়েছে। 

মঙ্গলবার থেকে রাজ্যে ২৪ ঘণ্টার দুর্যোগ কন্ট্রোল রুম খোলা হচ্ছে, এবং তিনি নিজে মঙ্গল ও বুধবার কন্ট্রোল রুমে থাকবেন বলেও জানান মমতা। 

নয়া দিল্লিতে ভারতীয় আবহাওয়া বিভাগের সদর দপ্তর থেকে এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, ২৪ মে দুপুর ২.৩০ নাগাদ পূর্ব-মধ্য বঙ্গোপসাগরের ওপর পশ্চিমবঙ্গের উপকূলে দিঘা শহরের ৫৮০ কিমি দক্ষিণ-দক্ষিণ পূর্বে অবস্থান করছিল ইয়াস। এর বর্তমান গতিবেগ ঘণ্টায় প্রায় ৭ কিমি। 

আগামী ১২ ঘণ্টায় আরও শক্তিশালী হয়ে পরবর্তী ২৪ ঘণ্টায় ইয়াস অতি শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড়ের আকার নেবে বলে জানিয়েছে আবহাওয়া বিভাগ। 

এতে বলা হয়, ঘূর্ণিঝড়টি ২৬ মে দুপুর বারোটা নাগাদ উত্তর ওড়িশার বালাসোর এবং পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলার সাগর দ্বীপের মাঝামাঝি এলাকায় আঘাত করতে পারে। 

ওই সময় বাতাসের গতিবেগ ১৫৫ থেকে ১৮৫ কিমি ও যা সন্ধ্যা ছটার পর কমে ১০৫ থেকে ১২৫ কিমি হতে পারে বলে জানানো হয় বিজ্ঞপ্তিতে। 

ইয়াস মোকাবেলায় “আমরা মোট ৫১টি ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট টিম গঠন করেছি, চার হাজার সাইক্লোন সেন্টার তৈরি করেছি,” জানিয়ে মমতা বলেন, ১০ লাখ মানুষকে সরানোর লক্ষ্যমাত্রা নিয়েই এগোচ্ছে প্রশাসন।  

রাজ্যের স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ দপ্তরের তথ্যমতে সোমবার পশ্চিমবঙ্গে নতুন করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন ১৭ হাজার ৮৮৩ জন। এখন পর্যন্ত রাজ্যে মোট মৃতের সংখ্যা ১৪ হাজার ৫০০ ছাড়িয়ে গেছে। 

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে, এ পর্যন্ত বাংলাদেশে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন সাত লাখ, ৯০ হাজার ৫২১ জন, মৃত্যু হয়েছে ১২ হাজার ৪০১ জনের। 

প্রতিবেদনে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন কক্সবাজার থেকে সুনীল বড়ুয়া।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।