বৈশ্বিক গণতান্ত্রিক সূচকে পিছিয়েছে বাংলাদেশ
2018.01.31
ঢাকা
অর্থনৈতিক উন্নয়নসহ নানা সূচকে উন্নতি হলেও গত এক বছরে গণতান্ত্রিক সূচকে পিছিয়েছে বাংলাদেশ। ২০১৭ সালের ইকোনমিস্ট ইনটেলিজেন্স ইউনিটের (ইআইইউ) বৈশ্বিক গণতন্ত্রের সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান আট ধাপ নেমে গেছে।
উন্নয়ন না গণতন্ত্র আগে—চলমান এই বিতর্কের মধ্য গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে আগের বছরের তুলনায় স্কোর কমেছে বাংলাদেশের। লন্ডনভিত্তিক দ্য ইকোনমিস্ট গ্রুপের গবেষণা ও বিশ্লেষণ বিভাগ ইআইইউ বুধবার সূচকটি প্রকাশ করেছে।
খবরটি এমন একটি সময়ে আসল যখন আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দেশে রাজনৈতিক উত্তেজনা বিরাজ করছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা বলছেন, বিদ্যমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে চলতি বছর গণতান্ত্রিক সূচকে মান আরও কমতে পারে।
আগামী ডিসেম্বরে জাতীয় সংসদ নির্বাচন উপলক্ষে নির্বাচনী প্রচার শুরু করেছে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ। অন্যদিকে আদালতে হাজিরা আর নেতা কর্মীদের আটক ও মামলার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে প্রধান বিরোধী দল বিএনপি।
গত মঙ্গলবার পুলিশের প্রিজন ভ্যান থেকে আসামি ছিনিয়ে নেওয়ার ঘটনায় গত দুই দিনে দলটির প্রায় শতাধিক নেতা-কর্মী গ্রেপ্তার হয়েছেন। জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় দুর্নীতির অভিযোগে খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে আদালত রায় ঘোষণা করবে আগামী ৮ ফেব্রুয়ারি।
গণতান্ত্রিক সূচকে পিছিয়ে কেবলমাত্র অর্থনৈতিক উন্নয়ন দেশের জন্য সুখকর নয় বলে মনে করেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা। তাঁরা বলছেন, অর্থনৈতিক উন্নয়নের পাশাপাশি সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক বিকাশ না হলে কোনো দেশ এগিয়ে যেতে পারে না।
“বাংলাদেশের সংস্কৃতির সঙ্গেও গণতন্ত্র ওতপ্রোতভাবে জড়িত। সেখানে গণতন্ত্রের কমতি বা অবনমন দেশের জন্য মোটেই সুখকর নয়। আন্তর্জাতিক পরিসরেও এক ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়ে,” বেনারকে বলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. ফরিদ উদ্দিন আহমেদ।
গত জাতীয় নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে না হওয়া, রাজনৈতিক দলগুলোর রাজনৈতিক অধিকারে ঘাটতি, সংসদে শক্তিশালী বিরোধী দলের উপস্থিতি না থাকার কারণে গণতান্ত্রিক সূচকে বাংলাদেশ পিছিয়ে পড়ার অন্যতম কারণ বলে মনে করেন এই রাষ্ট্রবিজ্ঞানী।
গণতন্ত্রের প্রতি ক্ষমতাসীনদের ‘কমিটমেন্ট’ না থাকাকেই এই সূচকে দেশের পিছিয়ে পড়ার কারণ বলে মনে করছে দেশের প্রধান বিরোধী দল বিএনপি।
“আওয়ামী লীগ শুধু মুখে গণতন্ত্রের কথা বললেও এর প্রতি তাদের কোনো কমিটমেন্ট নেই। আর তারা (আওয়ামী লীগ) গণতন্ত্রে বিশ্বাসও করে না,” বেনারকে বলেন বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম-মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী আহমেদ।
প্রসঙ্গত, গবেষণার ক্ষেত্রে ইকোনমিস্ট মূলত পাঁচটি মানদণ্ড অনুসরণ করেছে। এগুলো হলো; নির্বাচনগুলো অবাধ ও সুষ্ঠু হয়েছে কিনা, সরকারে ভারসাম্য রয়েছে কিনা, রাজনীতিতে জনগণকে যুক্ত করা হয় কিনা, সরকারের প্রতি জনগণের সমর্থন আছে কিনা এবং তাঁদের (জনগণের) মত প্রকাশের স্বাধীনতা রয়েছে কিনা।
বাংলাদেশের অবস্থান কোথায়
ইআইইউ’র বৈশ্বিক গণতন্ত্রের সূচকে ২০১৬ সালে ১০ এর মধ্যে ৫ দশমিক ৭৩ স্কোর নিয়ে বাংলাদেশের অবস্থান ৮৪তম। তবে ২০১৭ সালে ৫ দশমিক ৪৩ স্কোর নিয়ে বাংলাদেশের অবস্থান নেমে এসেছে ৯২–এ।
এবারও ১৬৭টি দেশ নিয়ে তৈরি সূচকটির তালিকার শীর্ষস্থান ধরে রেখেছে নরওয়ে। আর সূচকের সর্বনিম্নে অবস্থান করছে উত্তর কোরিয়া, দেশটির স্কোর মাত্র ১ দশমিক ০৮।
এই জরিপ বলছে, এবার সারা বিশ্বের সার্বিক গণতান্ত্রিক পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। ২০১৬ সালে ১০ স্কোরের মধ্যে সারা বিশ্বের গড় অর্জন যেখানে ৫ দশমিক ৫২ ছিল, এবার সার্বিক গড় ৫ দশমিক ৪৮ তে নেমেছে।
সাতটি মহাদেশের মধ্যে সার্বিক সূচকে এশিয়া মহাদেশও রয়েছে সর্বনিম্ন অবস্থানে। ১০ পয়েন্টের মধ্যে এশিয়ার গড় অর্জন ৫ দশমিক ৬৩।
রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক দিলারা চৌধুরী বেনারকে বলেন, “সরকারের জবাবদিহি থাকা গণতন্ত্রের অন্যতম মাপকাঠি। যা আমাদের সরকারের একেবারেই নেই। ফলে চারদিকে দুর্নীতির ছড়াছড়ি। প্রতিষ্ঠানগুলো কাজ করছে না। মানবাধিকারো লঙ্ঘিত হচ্ছে। জাতীয় সংসদ প্রায় অকার্যকর।”
তাঁর মতে, “অর্থনৈতিক উন্নয়নের সঙ্গে গণতন্ত্রের সম্পর্ক রয়েছে। কারণ গণতন্ত্র না থাকলে উন্নয়ন টেকসই হয় না।”
উল্লেখ্য, বর্তমান সরকার মুখে গণতন্ত্রের চেয়ে উন্নয়নের ওপর গুরুত্ব দেওয়ার কথা বলছে। পদ্মা সেতু, রামপাল বিদ্যুত কেন্দ্রসহ বড় বড় উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। রাজনীতিতে এবং সুশীল সমাজের মধ্যে এখনকার বিতর্ক হচ্ছে—আগে উন্নয়ন না গণতন্ত্র।
চট্রগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের লোক প্রশাসন বিভাগের অধ্যাপক নিজামউদ্দিন আহমেদ বেনারকে বলেন, সরকারের নীতি হচ্ছে—উন্নয়ন আগে, গণতন্ত্র পরে। সেই নীতির সঙ্গে এই গবেষণা প্রতিবেদন মিলে যায়।
তাঁর মতে, গণতন্ত্র সূচকে বাংলাদেশের অবনতি হওয়াটা খুব স্বাভাবিক। সামগ্রিকভাবে যে পরিস্থিতি বিরাজ করছে তাতে কোনোভাবেই গণতেন্ত্রর সূচকে বাংলাদেশের ভালো অবস্থানে থাকার কথা নয়।
ধরপাকড়ের মুখে বিএনপি
গত মঙ্গলবার মিছিল থেকে পুলিশের ওপর হামলা, ভাঙচুর ও প্রিজন ভ্যানের তালা ভেঙে দুই কর্মীকে ছিনিয়ে নেওয়ার পর থেকে ব্যাপক ধরপাকড়ের মুখে পড়েছে বিএনপি নেতাকর্মীরা।
ওই ঘটনায় করা পৃথক তিন মামলায় দলটির ৫৪জন নেতা-কর্মীর বিভিন্ন মেয়াদে রিমান্ড মঞ্জুর করেছে আদালত।
মঙ্গলবার হাই কোর্টের সামনে বিএনপির মিছিল থেকে পুলিশের ওপর হামলার অভিযোগ ওঠে। এসময় প্রিজন ভ্যানের তালা ভেঙে আটক দুই কর্মীকে ছিনিয়ে নেয় তারা।
এতে পুলিশের রমনা বিভাগের অতিরিক্ত উপকমিশনার (এডিসি) আশরাফুল আজিমসহ কয়েকজন পুলিশ সদস্য আহত হন। ওই ঘটনায় পুলিশ বাদী হয়ে দণ্ডবিধি ও বিশেষ ক্ষমতা আইনে মামলা করে।
পুলিশের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে বুধবার আসামিদের রিমান্ড মঞ্জুর করেন ঢাকার মহানগর হাকিম মাহমুদুল হাসান। অপর এক মামলায় বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতারও রিমান্ড হয়েছে। শাহবাগ থানায় দায়ের করা পৃথক দুই মামলায় দুদিন করে ১৮ জনকে এবং রমনা থানায় করা মামলায় ৩৫ জনকে দুদিন করে রিমান্ড দেওয়া হয়েছে।
একই আদালত মঙ্গলবার রাতে আটক বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায়ের জামিন আবেদন নামঞ্জুর করে রমনা থানার মামলায় তাঁকে কারাগারে পাঠিয়েছে। আরেক বিএনপি নেতা তরিকুল ইসলামের ছেলে অনিন্দ্য ইসলামকেও তিন দিনের রিমান্ড দেওয়া হয়েছে।
এ ছাড়া গত নভেম্বর মাসে করা অপর মামলায় বিএনপি নেতা আনিসুর রহমানকে তিন দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছে আদালত।
শুনানিতে বিএনপির আইন সম্পাদক ও দলটির নেতাকর্মীদের আইনজীবী সানাউল্লাহ মিয়া আদালতকে বলেন, বিএনপি নেতা-কর্মীরা পুলিশের ওপর হামলা চালিয়েছে এমন অভিযোগ সত্যি নয়। পুলিশই নিজের লোক দিয়ে হামলার ঘটনা ঘটিয়েছে।
তবে আসামিরা পুলিশকে লক্ষ্য করে পুলিশকে হত্যার উদ্দেশ্যেই ইটপাটকেল ছুড়ে আক্রমণ ও নাশকতা করেছে বলে আদালতকে জানান রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী সাজ্জাদুল হক।