প্রাণঘাতি ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে সমন্বিত উদ্যোগের অভাব দেখেন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা
2024.12.06
ঢাকা
ঢাকার মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ডেঙ্গু ওয়ার্ডের একটি বিছানায় হাতে স্যালাইন লাগানো অবস্থায় শুয়ে ছিল ছয় বছরের সারা মনি। কেমন আছো জানতে চাইলে চোখের কোণা বেয়ে গড়িয়ে পড়া এক ফোঁটা পানি জানান দেয় শিশুটির কষ্টের কথা।
তখনই পাশ থেকে তার বোন আয়েশা আক্তার বেনারকে জানান, টানা ১০ দিন ধরে জ্বরে ভুগছে পটুয়াখালী থেকে আসা সারা মনি। সাথে অসংখ্যবার বমি, পেট ব্যথা আর মাথা ব্যথায় কাহিল সে।
পাশেই আরেকটি বিছানায় মায়ের গলা ধরে বসে ছিল মিতু আক্তার (৯)। ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে সপ্তাহখানেক ধরে হাসাপাতালের বিছানায় কাতরাচ্ছে মিতু।
রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসাপাতালেও দেখা যায় একই চিত্র। ডেঙ্গু রোগীর চাপ সামলাতে একটি বিছানায় দুইজন শিশুকে রাখা হয়েছে। তবে ঢাকা শুধু নয় সারাদেশের হাসপাতালগুলোতে এখন ডেঙ্গু রোগীদের ভিড়।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, এ বছর ডেঙ্গুতে মৃত্যুর সংখ্যা বৃহস্পতিবার পর্যন্ত ৫১৪।
কিন্তু মশা নিয়ন্ত্রণে এখন পর্যন্ত সরকার কেন্দ্রীয়ভাবে সমন্বিত কোনো পরিকল্পনা নেয়নি। এমনকি ডেঙ্গুর ধরণ বুঝতে প্রয়োজনীয় গবেষণাও হচ্ছে না। এসব কারণে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে সরকার ব্যর্থ হচ্ছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী বেনারকে বলেন, ২০১৯ সালের ডেঙ্গু মহামারির মধ্য দিয়ে বন্য ধরনের এডিস মশা ডেঙ্গুর বাহক হয়ে যায় এবং এটি সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে। এজন্য এডিস মশা নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমটি করতে হবে সারাদেশের জন্য একটি সমন্বিত পরিকল্পনা প্রণয়নের মাধ্যমে। সেটি বাস্তবায়ন করতে হবে রাজধানী থেকে শুরু করে গ্রাম-মহল্লা পর্যন্ত একযোগে।”
“কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত মশা নিয়ন্ত্রণে কেন্দ্রীয়ভাবে কোনো পরিকল্পনা তৈরি করা হয়নি, বাস্তবায়ন তো অনেক দূরের ব্যাপার,” বলেন তিনি।
ডা. লেলিন বলেন, “২০০০ সাল থেকে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব শুরু হয়েছে, এখন পর্যন্ত হাজার হাজার মানুষ মারা গেছে। কিন্তু দুই যুগ পরেও ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে কোনো বিজ্ঞানভিত্তিক সমন্বিত পরিকল্পনা করেনি সরকার।”
“এ ছাড়া ‘ডেঙ্গু’ ভাইরাসের ধরন কতটা পরিবর্তন হচ্ছে, তা নিয়ে বিস্তারিত গবেষণা বাংলাদেশে হয়নি। ফলে যে ভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত হচ্ছি তার ধরন না জানলে এর চিকিৎসা সঠিকভাবে করা যায় না,” বলেন ডা. লেলিন।
উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, “এর আগে ছোটখাটো সমীক্ষা শেষে অনেকে বলেছেন এডিস মশা কামড়ের সময়ে পরিবর্তন এসেছে। এটি এখন দিনে-রাতে সবসময় কামড়ায়। নোংরা পানিতেও জন্ম গ্রহণ করে। এই সমীক্ষাকে গ্রহণ বা বর্জন করার জন্য যে মাপের গবেষণা দরকার ছিল, সেটাও হয়নি।”
ডা. লেলিন বলেন, ঢাকার কিছু জায়গার উপর সমীক্ষা করে সারাদেশের জন্য ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম করা যায় না। দেশের বিভিন্ন এলাকায় পরীক্ষা ও গবেষণা করতে হবে। মশার ওষুধ বাংলাদেশে কেনো অকার্যকর তার কারণ অনুমান করা হলেও সুনির্দিষ্টভাবে বের করা যায়নি।
স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের পরিকল্পনা, পরিবীক্ষণ, মূল্যায়ন ও পরিদর্শন অনুবিভাগের মহাপরিচালক মাহমুদুল হাসান বেনারকে বলেন, ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে একটি জাতীয় কমিটি রয়েছে। এই কমিটির পরামর্শে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে ব্যবস্থা নেওয়া হয়। তা ছাড়া বছরজুড়ে মশর নিধনে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।
ডেঙ্গুর সঙ্গে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব
সাধারণত অক্টোবর থেকে ডেঙ্গুর প্রকোপ কমতে শুরু করে, এবার নভেম্বর-ডিসেম্বরেও উল্লেখযোগ্যসংখ্যক মানুষ ডেঙ্গুতে মারা গেছেন।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, একদিকে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বৃষ্টির মৌসুম দীর্ঘ হওয়ায় ডেঙ্গু পরিস্থিতি নির্দিষ্ট মৌসুমের পরিবর্তে বছরজুড়ে বিস্তৃত হয়েছে। তবে এ বিষয়ে কোনও গবেষণা পাওয়া যায়নি।
চিকিৱসক ও বিশেষজ্ঞদের এই আলোচনা প্রসঙ্গে সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) উপদেষ্টা এবং সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. মো. মুশতাক হোসেন বেনারকে বলেন, সাধারণত এপ্রিল থেকে সেপ্টেম্বর মাসে বাংলাদেশে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব ঘটলেও ডিসেম্বরে এসেও এর সংক্রমণ কমছে না। এর প্রধান কারণ হচ্ছে জলবায়ু পরিবর্তন ও অনিয়মিত বৃষ্টিপাত।
“এখন বছরজুড়ে বৃষ্টি হয়। বৃষ্টি কমে যাওয়ার পরেও মশা এবং ভাইরাসের জীবনচক্র আরও এক থেকে দুই মাস থাকে। এই বৃষ্টির পানি জমে থাকা খানাখন্দ মশার প্রজননে খুবই উপযোগী। ফলে ডেঙ্গুর প্রকোপ দীর্ঘায়িত হচ্ছে,” জানান তিনি।
সচেতন হলেও মানুষের অংশগ্রহণ কম
ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের (ডিএনসিসি) প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ইমরুল কায়েস বেনারকে বলেন, সরকারের নানা উদ্যোগে সাধারণ মানুষ এখন ডেঙ্গুর বিষয়ে যথেষ্ট সচেতন হয়েছে, তবে তাদের অংশগ্রহণ কম।
তিনি বলেন, যেখানে সেখানে ফেলা প্লাস্টিকের এক চামচ পানি জমলে সেখান থেকে ডেঙ্গু মশা হতে পারে-এটা মানুষ এখন জানে। কিন্তু সচেতন হয়ে প্লাস্টিক সঠিক জায়গায় ফেলছে না। আর সিটি কর্পোরেশন তো মানুষের বাসায় গিয়ে মশা মারতে পারবে না।
ইমরুল কায়েস বলেন, জনগণ মশা মারার ওষুধ চাচ্ছে। তাদের চাহিদা অনুযায়ী, প্রয়োজনের চেয়ে বেশিবার দেওয়া হচ্ছে। এতে ক্ষতি হচ্ছে বুঝতে পারলেও মশা কমাতে বারবার দেওয়া হচ্ছে।
অন্যদিকে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. ফজলে শামসুল কবির বেনারকে বলেন, “মানুষ অনেক সচেতন হয়েছে। তবে আরো সচেতন হতে হবে এবং বাড়িঘর ও এর আশপাশের পরিবেশ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে। সবার অংশগ্রহণ ছাড়া ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়।“
সঠিক তথ্য নেই
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ করতে সঠিক তথ্য থাকা জরুরি। কিন্তু এ বিষয়ে সরকারের সঠিক ও পর্যাপ্ত ডাটা নেই।
ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ইমরুল কায়েস
বলেন, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে ডেঙ্গুর যে পরিসংখ্যান প্রতিদিন দেয়, সেখানে ঢাকার বাইরে থেকে আসা রোগী রয়েছেন। ফলে অ্যাকশন প্ল্যান করার সময় সমস্যা তৈরি হয়। গুরুত্ব যেখানে দেওয়ার কথা সেখানে দেওয়া হয় না। এজন্য সঠিক তথ্য খুব দরকার।
উত্তর সিটির প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা শামসুল কবির বলেন, বড় বড় হাসপাতালগুলোর বেশিরভাগ এই সিটি কর্পোরেশনের অধীনে। ফলে বিভিন্ন জায়গা থেকে রোগীরা আসে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর হাসপাতালের পরিসংখ্যান দিয়ে দেখাচ্ছে দক্ষিণ সিটিতে ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা বেশি। বাস্তবতা হচ্ছে এ অঞ্চলে আক্রান্ত মাত্র ৫ শতাংশ।
উদ্যোগ কেবল ঢাকাকেন্দ্রিক
সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ, ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে সরকারের উদ্যোগগুলো বেশিরভাগই ঢাকাকেন্দ্রিক। ঢাকার বাইরের শহরগুলোতে পরিকল্পনা থেকে শুরু করে জনবলেরও ঘাটতি রয়েছে। মশা নিয়ন্ত্রণে উদ্যোগ নেই গ্রাম পর্যায়ে।
নাটোরের বাগাতিপাড়া উপজেলার বাসিন্দা আসিফ মাহমুদ বেনারকে বলেন, অক্টোবর মাসে বৃষ্টির পর থেকে ভীষণ মশা বেড়েছে। নানা বয়সী মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হচ্ছেন। কিন্তু মশা নিধনে কোনো রাসায়নিক ছিটাতে কাউকে দেখিনি।“
ইমরুল কায়েস বলেন, “ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশন অন্যান্য শহর বা সিটি কর্পোরেশনের তুলনায় প্রচুর কাজ করে। কিন্তু ঢাকার বাইরে অন্যান্য সিটি কর্পোরেশন বা পৌরসভায় অনেক ঘাটতি আছে।
ডেঙ্গুতে মৃত্যু এ বছর ৫০০ ছাড়িয়েছে
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, বৃহস্পতিবার সকাল আটটা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে দেশে ৫ জনের মৃত্যু হয়েছে। এই সময়ে আরও ৬২৯ জন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। চলতি বছর এখন পর্যন্ত ডেঙ্গুতে মারা গেছেন ৫১৪জন। মোট আক্রান্ত হয়েছেন ৯৪ হাজার ৩১৪ জন।
সরকারি তথ্য অনুযায়ী, এ বছর ডেঙ্গুতে মৃত্যু গত বছরের তুলনায় এখন পর্যন্ত কম। গত বছর ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে মারা যান ১ হাজার ৭০৫ জন।
২০০০ সালে বাংলাদেশে ডেঙ্গু রোগের প্রাদুর্ভাব ব্যাপকভাবে শুরু হয়। ওই বছর থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত দুই লাখ ৪৪ হাজার মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হওয়ার পাশাপাশি মারা যান ৮৫৩ জন।