১১ দিন পর ফিরে এলেন সোহেল তাজের ‘অপহৃত’ ভাগনে
2019.06.20
ঢাকা
‘অপহরণের’ ১১ দিন পর ফিরে পাওয়া গেছে সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী তানজিম আহমেদ সোহেল তাজের ভাগ্নে সৈয়দ ইফতেখার আলম সৌরভকে। গত কয়েকদিন ধরে এই ঘটনার জন্য সরকারি বাহিনীকে দায়ী করে ফেসবুক লাইভে সরকারের বিরুদ্ধে বক্তব্য রেখে আসছিলেন সরকার দলীয় সাবেক এই নেতা।
বৃহস্পতিবার ভোরে হাত-পা ও চোখ বাঁধা অবস্থায় ময়মনসিংহের তারাকান্দা উপজেলার মধুপুরের বটতলা বাজার এলাকার জামিল অটো রাইস মিলের সামনে থেকে সৌরভকে উদ্ধার করা হয় বলে জানান তারাকান্দা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মিজানুর রহমান।
ওসি বেনারকে বলেন, “তাঁকে একটি মাইক্রোবাস থেকে সেখানে নামিয়ে দিয়ে সটকে পড়ে অজ্ঞাত অপহরণকারীরা। খবর পেয়ে সেখান থেকে পুলিশ তাঁকে উদ্ধার করে নিয়ে যায়।”
অন্যান্য অপহরণ ও উদ্ধার ঘটনার মতো এবারেও আইনশৃঙ্খলাকারী বাহিনী বলতে পারেনি, কারা এই অপহরণকারী গোষ্ঠী। তবে অপহৃতের পরিবার এবং সোহেল তাজ একাধিকবার দাবি করেছেন, যে এই অপহরণ সরকারি বাহিনীর কাজ।
বিশিষ্ট মানবাধিকার কর্মী নূর খান লিটন বেনারকে বলেছেন, “একের পর এক অপহরণ রহস্য উদ্ধার না হওয়ায় সমাজে মানুষের মধ্যে গভীর শঙ্কা গেঁথে বসছে। সমাজের মানুষ স্বাভাবিক প্রতিরোধ বা প্রতিবাদ করতে ভয় পাচ্ছে।”
অপহরণে সরকারি বাহিনীর যুক্ততার তথ্য নেই: আইজিপি
এই অপহরণের সাথে সরকারি বাহিনী যুক্ত সোহেল তাজের এমন অভিযোগ অস্বীকার করেছেন পুলিশের মহা পরিদর্শক জাবেদ পাটোয়ারী।
তিনি বেনারকে বলেন “ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের পক্ষ থেকে অনেক অভিযোগই আসতে পারে। কিন্তু আমরা যতক্ষণ অপরাধের বিষয়ে কারও সম্পৃক্ততা না পাই, ততক্ষণ বলতে পারি না যে তিনি অপরাধী। সরকারের কোনও বাহিনী তাঁকে অপহরণ করেছিল, এরকম তথ্য আমরা পাইনি।”
কিন্তু অপহরণকরীদের শনাক্ত করা যাচ্ছে না কেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, “পুলিশ এ বিষয়ে চেষ্টার কার্পণ্য করেনি। আমরা চেষ্টা অব্যাহত রাখব।”
প্রসঙ্গত, গত ৯ জুন চট্টগ্রামের মিমি সুপার মার্কেটের আগোরার সামনে থেকে সৌরভ অপহৃত হন বলে গত শনিবার এক ফেসবুক পোস্টে জানান সোহেল তাজ। প্রেম, বিয়ে ও বিচ্ছেদ বিষয়ে ব্যক্তিগত ঘটনার জের ধরে এই অপহরণের ঘটনা ঘটে বলে পরিবারের পক্ষ থেকে অভিযোগ তোলা হয়।
ভাগ্নেকে অক্ষত ও জীবিত অবস্থায় ফেরত চেয়ে নিখোঁজ সৌরভের মা সৈয়দা ইয়াসমিন আরজুমানকে নিয়ে ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটে এক সংবাদ সম্মেলনও করেন তিনি।
সৌরভ ঢাকার ইনডিপেনডেন্ট বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গ্র্যাজুয়েশন করে একটি বেসরকারি সংস্থার পক্ষে ডকুমেন্টারি ফিল্ম তৈরির কাজ করতেন।
সৌরভ অক্ষত, তবে আতঙ্কগ্রস্ত
ভাগ্নে উদ্ধার হওয়ার পর সোহেল তাজ জানিয়েছেন, “সৌরভ আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়েছে। উদ্ধার হওয়ার সময় তার চোখ বাঁধা ছিল। গায়ে কোনো কাপড় ছিল না, শুধু পায়জামা পরা ছিল। সে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত অবস্থায় ছিল।”
বৃহস্পতিবার বেলা ১১টার দিকে ফেসবুক লাইভে এবং নিজের বাসায় সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলার সময় সোহেল তাজ বলেন, “দেশের আর কোনো মানুষ এই পরিস্থিতির শিকার হোক তা আমরা চাই না।”
ফেসবুক লাইভে তিনি বলেন, ভোর ৫টা ২৭ মিনিটে তাঁর মামাতো বোন তাঁকে ফোন করেন। মামাতো বোন জানান, কিছু মানুষ একটা লোকেশন থেকে তাঁকে (মামাতো বোন) ফোন করেন। ওই লোকেশনের নাম বলবেন না বলে জানান সোহেল তাজ।
তিনি জানান, ফোনে তাঁর বোনকে জানানো হয়, একটা ছেলেকে ছন্নছাড়া অবস্থায় কিছু মানুষ গাড়ি থেকে ফেলে দিয়েছে। পরে ওই লোকেরা ছেলেটিকে তাঁদের কর্মস্থলে নিয়ে গেছেন।
সোহেল তাজ বলেন, “সৌরভকে উদ্ধারের পরে ময়মনসিংহের পুলিশ সুপার তাকে বাসায় নিয়ে গোসলের ব্যবস্থা করেন এবং কিছু খাবার দেন। উদ্ধারের পর সৌরভ বুঝেই উঠতে পারেনি সে কোথায় আছে।”
আতঙ্কগ্রস্ত সৌরভকে এত দিন কোথায় আটকে রাখা হয়েছিল সে বিষয়ে সে কিছু বলতে চাইছে না।
সোহেল তাজ বলেন, “সে মানসিকভাবে একেবারেই বিপর্যস্ত। এখন তাকে চাপমুক্ত রাখতে চাই। আমরা তাকে একটু স্বস্তিতে রাখতে চাই।”
“সৌরভ আভাসে ইঙ্গিতে কিছুটা জানিয়েছে, সে কী পরিস্থিতিতে ছিল। তবে এখন তার ওপর কোনো চাপ দেয়া যাবে না। আমরা তার অপেক্ষায় আছি,” বলেনি তিনি।
এদিকে ফিরে আসার পর সৌরভ বিভিন্নজনকে গণমাধ্যমে ধন্যবাদ জানিয়েছেন বলে এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে দৈনিক ইত্তেফাক।
"যারা যারা আমার জন্য দোয়া করেছেন, যারা আমার জন্য কষ্ট করেছেন, সবাইকে আমি থ্যাংক ইউ বলতে চাই। আমার মামা, আমার পরিবার আর আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যারা কষ্ট করেছে আমার জন্য, সবাইকে থ্যাংক ইউ। আপনাদের সবাইকে ধন্যবাদ," বলেন সৌরভ।
পুলিশের ভাষ্য
বৃহস্পতিবার সকালে এক প্রেস ব্রিফিংয়ে ময়মনসিংহের পুলিশ সুপার শাহ আবিদ হোসেন জানান, “কে বা কারা ভোরে সৌরভকে মধুপুর এলাকার জামিল অটো রাইস মিলের সামনের রাস্তায় রেখে যায়।”
এরপর সৌরভ ওই মিলে গিয়ে নিজের পরিচয় দিলে মিলের ম্যানেজার সমীর সৌরভের পরিবারকে খবর দেন। পরে পরিবারের পক্ষ থেকে চট্টগ্রামের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে অবহিত করা হয়।
পুলিশ সুপার বলেন, “ভোর ৫টা ২০ মিনিটে চট্টগ্রাম অ্যান্টি-টেররিজম ইউনিটের ডিসি আমাকে (ময়মনসিংহের পুলিশ সুপার) ফোন করে জানান- তারাকান্দা উপজেলার বটতলা মধুপুর এলাকার জামিল অটো রাইস মিলের সামনে সৌরভকে পাওয়া গেছে। তিনি রাইস মিলে একটি চেয়ারে বসাছিলেন।”
“খবর পেয়ে তারাকান্দা থানার পুলিশসহ তিনি নিজে গিয়ে সৌরভকে উদ্ধার করে ময়মনসিংহে নিয়ে আসেন। পরে তাঁর পরিবারের সঙ্গে কথা বলে পুলিশ পাহারায় বনানীতে তার পরিবারের কাছে পাঠানো হয়। সৌরভের শারীরিক অবস্থা ভালো এবং তিনি সুস্থ আছেন।”
পুলিশ সুপার জানান, “এ মুহূর্তে সৌরভের সঙ্গে কথা বলার মতো পরিস্থিতি হয়নি। তাকে নির্যাতন করা হয়েছে কিনা- এ ব্যাপারে সৌরভ কিছু বলেননি। বলেছে পরে কথা বলবে।”
আবিদ হোসেন বলেন, “১১ দিন তিনি কোথায় কীভাবে ছিলেন সেসব কিছুই বলতে পারেননি। শুধু বলেছেন তাঁকে আটক রাখা হয়েছিল।”
গভীর উদ্বেগ
বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমেদের পরিবারের ঘনিষ্ঠ একজন সদস্যকে এভাবে অপহরণ করা এবং অপহরণকারীদের শনাক্ত করতে সরকারের ব্যর্থতায় জনমনে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়েছে।
সামাজিক মাধ্যমে চলছে আলোচনা–সমালোচনা। প্রায় সবাই এই পরিস্থিতিকে ভীতিকর হিসেবে বর্ণনা করেছেন।
মানবাধিকার কর্মী নূর খান লিটন বেনারকে বলেছেন, “এসব ঘটনার পর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নিরুত্তাপ রেসপন্সে নানা ধরনের শঙ্কা তৈরি হচ্ছে। প্রশ্ন উঠছে, রাষ্ট্রীয় বাহিনীর কিছু কর্মকর্তা বা সদস্য ব্যক্তিস্বার্থে এই ঘটনাগুলো ঘটাচ্ছে কিনা?”
তিনি বলেন, “যারা এসব ঘটনা ঘটাচ্ছে তারা কখনো কখনো পুরো রাষ্ট্রশক্তিকে চ্যালেঞ্জে ফেলে দেয় এবং সবার জন্য বিব্রতকর অবস্থা তৈরি করে। ঘটনা পরম্পরা তদন্তে পুলিশের ব্যর্থতায় এটা বোঝা যায় এই অপহরণকারী গোষ্ঠী খুবই ক্ষমতাধর।”