সহযোগীদের সঙ্গে লোহার খাঁচায় দাঁড়ালেন ড. ইউনূস, বিচার শুরু
2024.06.12
ঢাকা

শ্রম আইন লঙ্ঘনের অভিযোগে ছয় মাস দণ্ডিত হওয়ার পর এবার নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বিরুদ্ধে মানি লন্ডারিং আইনে দায়ের মামলার বিচার শুরু হয়েছে।
মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন ও দণ্ডবিধির দুটি ধারা লঙ্ঘনের অভিযোগে দুর্নীতি দমন কমিশনের দায়ের করা মামলায় বুধবার ঢাকার বিশেষ জজ আদালত-৪ অভিযোগপত্র গ্রহণ করে।
এর মধ্য দিয়ে ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও তাঁর ১৩ সহযোগীর বিরুদ্ধে বিচার শুরু হলো।
দুদক আইনজীবী মোশারফ হোসেন কাজল বেনারকে এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
তিনি বলেন, আগামী ১৫ জুলাই থেকে এই মামলায় সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হবে।
অভিযোগ প্রমাণিত হলে ড. ইউনূস ও অন্য আসামিদের সর্বোচ্চ ১২ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড হতে পারে।
ড. ইউনূসের আইনজীবী ব্যারিস্টার আব্দুল্লাহ আল মামুন বেনারকে বলেন, তাঁর মক্কেলের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ ‘সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন’ এবং ‘রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত’।
অনেক হয়রানির মধ্যে আছি: ড. ইউনূস
আদালতে থেকে বেরিয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে ড. ইউনূস বলেন, “অনেক হয়রানির মধ্যে আছি।”
তিনি বলেন, “আজকে সারাক্ষণ খাঁচার মধ্যে ছিলাম আমরা সবাই মিলে। যদিও আমাকে বলা হয়েছিল যে, আপনি (বাইরে) থাকেন। আমি বললাম, সবাই যাচ্ছে, আমিও সঙ্গে থাকি।”
ড. ইউনূস বলেন, “আমি আগেও প্রশ্নটা তুলেছি, আবারও সবার জন্য তুলছি। এটা কি ন্যায্য হলো নাকি? আমার বিষয় না, যে কোনো আসামি; যার বিরুদ্ধে একটা মামলা করতে যাচ্ছে, তাকে খাঁচায় নিয়ে যাওয়া। আমি যতটুকু জানি, যত দিন আসামি অপরাধী প্রমাণিত না হচ্ছে, তত দিন তিনি নির্দোষ-নিরপরাধ।”
“একজন নিরপরাধ নাগরিককে একটা লোহার খাঁচার ভেতরে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে আদালতে শুনানি চলাকালে, এটা আমার কাছে অত্যন্ত অপমানজনক, অত্যন্ত গর্হিত কাজ বলে মনে হয়েছে। এটা আমার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে না—সেটা বিষয় না, কারও ক্ষেত্রেই যেন প্রযোজ্য না হয়,” বলেন তিনি।
এ ব্যাপারে আওয়াজ তোলার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, “বিষয়টা পর্যালোচনা করা হোক। একটা সভ্য দেশে কেন এ রকম হতে যাবে! কেন একজন নাগরিককে খাঁচার ভেতরে পশুর মতো দাঁড়িয়ে থাকতে হবে আদালতে শুনানিকালে। যেখানে এখনো বিচার শুরুই হয়নি, যেখানে অপরাধী সাব্যস্ত হওয়ার কোনো সুযোগই হয়নি।”
ড. ইউনূস আরও বলেন, “যারা আইনজ্ঞ আছেন, বিচার ব্যবস্থার সঙ্গে জড়িত আছেন, তারা পর্যালোচনা করে দেখুন।”
গণমাধ্যমকর্মীদের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “মানি লন্ডারিং, আত্মসাৎ, প্রতারণা এই শব্দগুলোর সঙ্গে আমার কিছু আছে আমি তো জানি না! এটা আমি শিখি নাই কোনো দিন, কোনো দিন করি নাই। হঠাৎ করে প্রকাণ্ড রকমের শব্দগুলো আমার ওপর আরোপ করা হচ্ছে। ”
তিনি বলেন, “আমরা সারা জীবন তো মানুষের সেবাতেই কাটিয়েছি। অর্থ আত্মসাৎ করার জন্য তো আমরা আসিনি। নিজেদের অর্থ ব্যয় করে আমরা এসেছি। এটাই আমাদের ইতিহাস। কাজেই এখানে কেন হচ্ছে এটাই হলো হয়রানি। এটা আমাদের বোধের মধ্যে আসছে না, কেন এই হয়রানির মধ্যে আমরা থাকতে যাব।”
তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ উল্লেখ করে ড. ইউনূস আরও বলেন, “একটা হলো যে, আমি রক্তচোষা, একটা হলো আমি সুদখোর, একটা হলো যে আমি দেশের শত্রু, আমি পদ্মা সেতুর অর্থ আটকে দিয়েছি, আমি চারদিকে ষড়যন্ত্র করে বেড়াই—এগুলো হলো হয়রানি। এই যে কথার কথা বলেই যাচ্ছে, বলেই যাচ্ছে।
“আমাকে জোর করে গ্রামীণ ব্যাংক থেকে বের করে দেওয়া হলো। এ রকম প্রতি বছর নতুন নতুন কাহিনী রচনা হলো। এগুলো তো চলছেই, ক্রমাগতভাবে চলছে। এটাই হয়রানি।”
এ প্রসঙ্গে মতামত জানতে চাইলে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক মিজানুর রহমান বেনারকে বলেন, “আসামিদের লোহার খাঁচায় আটকে রাখা মোটেই শোভন না। ওনারা তো আর দাগী-দুর্ধর্ষ আসামি নন!”
তিনি বলেন, “আমার মনে হয়, আদালতের উচিত ছিল বিষয়টির ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করে ড. ইউনূসকে সেখান থেকে বের করে আনা। কারণ এই ধরনের কাজের মাধ্যমে বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থা সম্পর্কে দেশের বাইরে কোনো ভালো বার্তা যায় না।”
মানি লন্ডারিং হয়েছে: দুদক
দুর্নীতি দমন কমিশনের আইনজীবী মোশারফ হোসেন কাজল বুধবার বেনারকে বলেন, “আদালত রেকর্ড ও আইনের ধারা দেখে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, এখানে মানি লন্ডারিং হয়েছে। সেই কারণে আজকে ড. ইউনূসসহ অন্যদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেছেন।”
তিনি বলেন, “গ্রামীণ টেলিকম লভ্যাংশের শতকরা পাঁচ শতাংশ শ্রমিকদের ভাগ দিতে চায়নি। আদালতের হস্তক্ষেপে দিতে রাজি হয়েছে। শ্রমিকদের জন্য নির্ধারিত লভ্যাংশের টাকার পরিমাণ ছিল ৪৩৭ কোটি টাকা। এই টাকা থেকে (প্রায়) ২৬ কোটি টাকা শ্রমিক কল্যাণ ইউনিয়নকে দেওয়া হয়েছে, এই টাকা এক হিসাব থেকে আরেকটি হিসাবে হস্তান্তর করা হয়েছে। এটি দণ্ডবিধি এবং মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনে অপরাধ।”
ড. ইউনূস গ্রামীণ টেলিকমের প্রধান। তাঁর নির্দেশ অথবা সম্মতি ছাড়া কি টাকা দেওয়া হয়েছে? টাকা তিনি কেন, কোথায়, কোন উদ্দেশ্যে দিয়েছেন সেটি বিবেচ্য বিষয় নয়। মূল বিষয় হলো, টাকা হস্তান্তর করা হয়েছে—সেটিই অপরাধ,” যোগ করেন তিনি।
কাজল বলেন, “ড. ইউনূসসহ ১৪ জনের বিরুদ্ধে দণ্ডবিধির ৪০৯ ধারা এবং মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনে মামলা হয়েছে। এই অপরাধের কারণে তাঁদের সর্বোচ্চ ১২ বছর পর্যন্ত সাজা হতে পারে।”
‘কোথায় মানি লন্ডারিং হয়েছে?’
ড. ইউনূসের আইনজীবী ব্যারিস্টার আব্দুল্লাহ আল মামুন বেনারকে বলেন, “যে অভিযোগ আনা হয়েছে সেটি সম্পূর্ণ মিথ্যা এবং রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। ড. ইউনূসসহ সবাইকে হয়রানি করতেই এই মামলা।”
তিনি বলেন, “মানি লন্ডারিং মানে অর্থ আত্মসাৎ। ড. ইউনূস কি টাকা আত্মসাৎ করেছেন? শ্রমিকদের প্রদেয় ৪৩৭ কোটি টাকার লভ্যাংশের মধ্যে প্রায় ২৬ কোটি টাকা একটি ব্যাংক হিসাব থেকে আরেকটি ব্যাংক হিসাবে হস্তান্তরিত হয়েছে। ওই টাকা শ্রমিকদের লিখিত সম্মতিক্রমে শ্রমিকদের আইনজীবীদের ফি হিসেবে দেওয়া হয়েছে। তাহলে আমার মক্কেল আত্মসাৎ করলেন কোথায়?”
মামুন বলেন, “গ্রামীণ টেলিকম তো টাকা দিয়েছে! শ্রমিকদের লভ্যাংশের টাকা থেকে কোনো টাকা ড. ইউনূস কিংবা গ্রামীণ টেলিকমের অন্য কোনো ব্যক্তির হিসাবে যায়নি। শ্রমিকদের সম্মতিতে লভ্যাংশের টাকা তাদের আইনজীবীদের ফি হিসাবে হস্তান্তরিত হয়েছে। এখানে ড. ইউনূস অথবা গ্রামীণ টেলিকমের কেউ আর্থিকভাবে লাভবান হননি।”