পাঁচ দশকেও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন পদ্ধতি প্রতিষ্ঠায় ব্যর্থ বাংলাদেশ

আহম্মদ ফয়েজ
2023.12.15
ঢাকা
পাঁচ দশকেও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন  পদ্ধতি প্রতিষ্ঠায় ব্যর্থ বাংলাদেশ ঢাকার নয়াপল্টন এলাকায় পুলিশের সাথে লাঠিসোঁটা নিয়ে বিএনপি নেতাকর্মীদের সংঘর্ষের একটি দৃশ্য। ২৮ অক্টোবর ২০২৩।
জীবন আহমেদ/বেনারনিউজ

অবিভক্ত পাকিস্তানের শেষ সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল ১৯৭০ সালে।  ওই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়ার পরও ক্ষমতা হস্তান্তর না করায় শুরু হয় অসহযোগ আন্দোলন যা পরবর্তীতে মুক্তিযুদ্ধে রূপ নেয়।  জন্ম নেয় স্বাধীন ভূখণ্ড বাংলাদেশ।

শনিবার ৫৩তম বিজয় দিবস উদযাপন করবে বাংলাদেশ।  এই দীর্ঘ সময়ে বাংলাদেশে নির্বাচনকেন্দ্রিক রাজনৈতিক সংকট চলমান রয়েছে।

তিন সপ্তাহ পর দেশে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।  সরকারের নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে এই নির্বাচন বর্জন করেছে বিএনপি এবং সরকার পতনের একদফা দাবিতে যুগপৎ আন্দোলনে থাকা শরিক দলগুলো।

পশ্চিম পাকিস্তানের বৈষম্য এবং নির্বাচনের ফল ছিনিয়ে নেওয়াই ছিল স্বাধীনতা যুদ্ধের অন্যতম কারণ।  সেখানে বিজয় অর্জনের ৫২ বছর পরেও একটি কার্যকর ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনী ব্যবস্থা দাঁড় করাতে না পারায় বিভিন্ন সময়ে ক্ষমতায় থাকা দলগুলোকে দায়ী করার পাশাপাশি ক্ষোভ ও হতাশা ব্যক্ত করেছেন বীর মুক্তিযোদ্ধা, বুদ্ধিজীবী, রাজনৈতিক নেতা ও বিশ্লেষকরা।

তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠা, বাতিল ও নতুন সংকট

বিশ্লেষকরা বলছেন, বাংলাদেশ রাষ্ট্র হিসেবে আবির্ভূত হওয়ার পর থেকেই যে নির্বাচনগুলো হয়েছে- তার বেশিরভাগই ছিল বিতর্কিত।  বারবার সেনা শাসনের মধ্যে পড়ে পুরো ব্যবস্থাটাই ভঙ্গুর হয়ে পড়ে।

“একটি আপৎকালীন ব্যবস্থা হিসেবে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা চালু করা হলেও পরবর্তীতে বিএনপি ও আওয়ামী লীগের ক্ষমতালিপ্সু মনোভাবের কারণে এই ব্যবস্থাটি বিতর্কের মধ্যে পড়ে,” বেনারকে বলেন বাংলাদেশের প্রবীণ রাজনীতিক ও বীর মুক্তিযোদ্ধা মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম।

অতীতের নির্বাচনগুলো নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করে তিনি আরও বলেন, “তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা আসার পর নানা বিবর্তন ঘটিয়ে বিএনপি চেষ্টা করেছে ক্ষমতাকে আঁকড়ে ধরে রাখতে, কিন্তু পারেনি।  ২০০৮ সালের নির্বাচনে ক্ষমতায় এসে এই ব্যবস্থাকে পুরোপুরি বিলুপ্ত করে আওয়ামী লীগ নির্বাচনী ব্যবস্থা কলঙ্কিত করে।  এখন নিজেদের তত্ত্বাবধানে তৃতীয়বারের মতো ক্ষমতায় যাওয়া সময়ের ব্যাপার মাত্র বলেই মনে হচ্ছে।”

সাবেক নির্বাচন কমিশনার ও নির্বাচন বিষয়ক গবেষক সাখাওয়াত হোসেন বেনারকে বলেন, “বাংলাদেশের ইতিহাসে এখন পর্যন্ত ১১টি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে।  এর মধ্যে ২০০৮ সালের গ্রহণযোগ্য নির্বাচনটি সর্বশেষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হয়েছে।”

তিনি বলেন, “এর বাইরেও তিনটি নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে হয়েছে, সেগুলো নিয়ে বিতর্ক কম।  অন্য সব নির্বাচন নিয়েই দেশে-বিদেশে কম-বেশি বিতর্ক রয়েছে।”

২০১৪ সালের সাধারণ নির্বাচনে ১৫৪ জন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী হয়েছেন।  ২০১৮ সালের নির্বাচন প্রসঙ্গে তৎকালীন নির্বাচন কমিশনের লোকজনই বলেছেন, অনেক জায়গায় রাতে ভোট হয়েছে।

৫২ বছরেও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন ব্যবস্থা না থাকা হতাশা

“এটা খুবই পীড়াদায়ক ব্যাপার যে, একটি স্বাধীন দেশের নির্বাচন ব্যবস্থা এতোগুলো বছর পরও শুধুমাত্র শাসক গোষ্ঠীর লুটপাটের মনোভাবের কারণে গ্রহণযোগ্য অবস্থায় আনা গেল না,” বেনারকে বলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী।

অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম বলেন, “ক্ষমতার দ্বন্দ্বের কারণে সরকারি ও বিরোধী দল সাম্রাজ্যবাদের কৃপা লাভে সচেষ্ট এবং এ দুই দলের বিপরীতে কোনো ভালো বিকল্প না পেয়ে জনগণ তাদেরকে পর্যায়ক্রমে ভোট দিয়ে এসেছে।  কিন্তু লাভের লাভ কিছুই হয়নি।”

প্রখ্যাত প্রাবন্ধিক ও রাষ্ট্রচিন্তাবিদ আবুল কাসেম ফজলুল হক বেনারকে বলেন, “নির্বাচন সম্পর্কে সব রকম অবিশ্বাস-সন্দেহ আশির দশক থেকেই প্রবলভাবে শুরু হয়েছে।  কিন্তু এতটা খারাপ অবস্থা অতীতে ছিল না।  এ থেকে প্রমাণিত হয়, আমরা ক্রমান্বয়ে খারাপের দিকে যাচ্ছি।”

তিনি মনে করেন, যেহেতু আওয়ামী লীগ ও বিএনপি পালাক্রমে ক্ষমতায় বসেছে, সেহেতু এই দায় তাদেরই।

আবুল কাসেমের এই মতকে যৌক্তিক মনে করেন যশোর এলাকার বীর মুক্তিযোদ্ধা গাজী আব্দুল হামিদ।

বেনারের সঙ্গে আলাপকালে তিনি বলেন, “যারাই ক্ষমতায় এসেছে, তারাই নিজেদের ভাগ-বাটোয়ারা নিয়ে ব্যস্ত ছিল।  অথচ দেশের রাজনীতির মূল সংকটের জন্য নির্বাচন ব্যবস্থাটাই গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

“একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে এটা খুবই কষ্টের এবং একইসঙ্গে ক্ষোভের—একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন ব্যবস্থা আমরা দাঁড় করাতে পারিনি,” বলেন তিনি।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও বীর মুক্তিযোদ্ধা শাজাহান খান বেনারকে বলেন, “এটা সত্য যে নির্বাচন ব্যবস্থা নিয়ে আমাদের এখানে এখনো আলোচনা রয়েছে।  এই অবস্থার পরিবর্তন ঘটিয়ে একটি শক্তিশালী ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে গণতান্ত্রিকভাবে লড়াই সংগ্রাম করে যাচ্ছে আওয়ামী লীগ।”

তিনি দাবি করেন, “গত দুটি নির্বাচনের মতো এবারও নির্বাচন হচ্ছে এবং এর মাধ্যমে নির্বাচন ব্যবস্থা একটি স্থায়ী রূপের দিকে যাচ্ছে।”

বিএনপিসহ অন্যান্য বিরোধী দলের নির্বাচন বয়কট প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “বিএনপি কোনো গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল নয়।  তারা কী করল না করল এতে দেশের মানুষের কিছুই আসে যায় না।”

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ও বীর মুক্তিযোদ্ধা নজরুল ইসলাম খান বেনারকে বলেন, “নির্বাচন ব্যবস্থাকে একটি গ্রহণযোগ্য অবস্থায় নিয়ে যেতে সব বিরোধী দলের দাবির মুখে বিএনপি ১৯৯৬ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা চালু হয়।  সেটি বাতিল করে আওয়ামী লীগ পুরো নির্বাচন ব্যবস্থাকে নিজেদের তালাবন্দি করেছে।”

তিনি আরও বলেন, “গত দুটি নির্বাচন করে আওয়ামী লীগ নির্বাচনকে কফিনে ঢুকিয়েছে। আর এবার নির্বাচন করে সেই কফিনে শেষ পেরেকটি ঠুকে দেওয়ার কাজ করছে।”

নজরুল ইসলাম বলেন, “শুধুমাত্র শান্তিপূর্ণ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন চাওয়ার ‘অপরাধে’ হাজার হাজার বিএনপি নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার করে জেলে পাঠিয়েছে আওয়ামী লীগ। বিপুল সংখ্যক নেতা-কর্মী নির্বাচনের দাবি তুলে প্রাণ হারিয়েছেন।

“আমাদের কর্মীদের এভাবে জেলে রেখে, রণাঙ্গনের বীর মুক্তিযোদ্ধা ও বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ অনেককে জেলে রেখে বিজয় দিবস উদযাপন মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার চেতনা পরিপন্থি,” মনে করেন নজরুল।

নির্বাচন বিষয়ক গবেষক নেসার আমিনের লেখা ‘বাংলাদেশের নির্বাচনি ব্যবস্থা ও ফলাফল’ বইয়ে বলা হয়েছে, সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনীর মাধ্যমে চালু হয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা।  ২০১১ সালের ১০ মে সুপ্রিম কোর্ট এক সংক্ষিপ্ত রায়ে শর্ত সাপেক্ষে তা বাতিলের রায় দেয়।

তাতে আদালত ত্রয়োদশ সংশোধনীকে সংবিধানের মূল চেতনার সঙ্গে সাংঘর্ষিক উল্লেখ করে বলেন, শান্তি-শৃঙ্খলা ও ধারাবাহিকতা রক্ষার স্বার্থে আগামী দুটি সাধারণ নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে করা যেতে পারে।

একইসঙ্গে বিচার বিভাগকে এর সঙ্গে না জড়ানোর পক্ষে মত দেয়।  যদিও সংক্ষিপ্ত রায়ের ১৬ মাস পর আদালত তার পূর্ণাঙ্গ রায়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার রাখার ব্যাপারে সংসদের অনুমতির শর্ত জুড়ে দেয়, যা ছিল সংক্ষিপ্ত রায়ের সঙ্গে সাংঘর্ষিক।

এই ধারাবাহিকতায় রাজনৈতিক ঐকমত্য ছাড়াই সংসদে পঞ্চদশ সংশোধনী পাসের মাধ্যমে ২০১১ সালের ৩০ জুন সংবিধান থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার।  

‍“এরপর তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার অধীনে নির্বাচনের পরিবর্তে দলীয় সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হয় বিতর্কিত দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন,” উল্লেখ রয়েছে বাংলাদেশের নির্বাচনি ব্যবস্থা ও ফলাফল বইতে।

বিরোধী দল না থাকায় আগামী ৭ জুন অনুষ্ঠেয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগ টানা চতুর্থবারের মতো ক্ষমতায় আসবে, এটা অনেকটাই নিশ্চিত হয়ে গেছে।

“স্বাধীনতা অর্জনের ৫২ বছর পার হয়েছে, তবুও আমরা একটি সবার কাছে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন ব্যবস্থা দাঁড় করাতে পারিনি; এটা চরম হতাশার।  রাজনীতি হয়ে গেছে লুটপাটের মাধ্যম, তাই লুটপাটকে টিকিয়ে রাখতে ক্ষমতা ছাড়ার ঝুঁকি কেউ নিতে চায় না,” বলেন প্রবীণ বাম নেতা মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম।

 

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।