ভোটারদের প্রশ্ন, ‘একতরফা’ নির্বাচনে ভোট দিয়ে লাভ কী?

বেনারনিউজ স্টাফ
2023.12.29
ওয়াশিংটন
ভোটারদের প্রশ্ন, ‘একতরফা’ নির্বাচনে ভোট দিয়ে লাভ কী? ঢাকায় রাস্তায় প্রার্থীদের পোস্টার ঝুলছে। ২৬ ডিসেম্বর, ২০২৩
মুনির উজ জামান/এএফপি

এক সপ্তাহ পর অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে বাংলাদেশের দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। ভোটারদের প্রশ্ন, ‘একতরফা’ নির্বাচনে ভোট দিয়ে লাভ কী?

তারা আরও বলছেন, বিরোধীদের নির্বাচন বয়কট করার কারণে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের বিজয় নিশ্চিত হয়ে আছে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, আরেকটি নির্বাচনী আনুষ্ঠানিকতার মধ্য দিয়ে শেখ হাসিনার ‘কর্তৃত্ববাদী’ শাসন মজবুত হতে যাচ্ছে।

দক্ষিণ এশিয়ার এই দেশের ১৭ কোটি মানুষের সামনে বিকল্প না থাকায় আগামী ৭ জানুয়ারি ভোটারদের শেখ হাসিনাকেই আবার নির্বাচিত করতে হবে।  অর্থাৎ টানা চতুর্থবারের মতো প্রধানমন্ত্রী হতে যাচ্ছেন ৭৬ বছর বয়সী নেত্রী শেখ হাসিনা।

আওয়ামী লীগ নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার দাবি প্রত্যাখ্যান করায় বিএনপিসহ বেশ কিছু ছোট দল এবার নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে না।

রাজনৈতিক বিশ্লেষক, সরকারের সমালোচক ও স্বাধীন পর্যবেক্ষকরা বলছেন,  বিএনপিবিহীন এই নির্বাচনও আরেকটি  একতরফা নির্বাচন হতে যাচ্ছে।

নির্বাচন পর্যবেক্ষণ সংস্থা জানিপপের প্রধান অধ্যাপক নাজমুল আহসান কলিমুল্লাহ বেনারকে বলেন, “শেষ পরিণতিতে এই নির্বাচন শেখ হাসিনাকে নিরঙ্কুশ ক্ষমতার অধিকারী করবে। গণতান্ত্রিক ভারসাম্য এবং ক্ষমতা পৃথকীকরণের নীতি ভেঙে পড়বে।”

গত ১৪ বছর ক্ষমতায় থেকে শেখ হাসিনা এশিয়ার অন্যতম সফল অর্থনীতির নেতৃত্ব দিয়েছেন, যাতে মূল অবদান রেখেছে দেশের বিকাশমান পোশাক শিল্প; যেখানে প্রায় ৮০ শতাংশ নারী শ্রমিক নিয়োজিত।  এছাড়া প্রবাসী আয় ছিল অর্থনীতির অন্যতম চালিকাশক্তি।

BD-pic-2.jpg
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে একটি নতুন টার্মিনালের উদ্বোধন করেন। অক্টোবর ৭, ২০২৩। (বেনারনিউজ)

বিশ্লেষকদের মতে, এই সময়ে একাধারে তিনি বিরোধী দল ও সুশীল সমাজকে দমন করেছেন।  পাশাপাশি আইন প্রয়োগকারী সংস্থা ও বিচার বিভাগ থেকে শুরু করে নির্বাচন কমিশন পর্যন্ত রাষ্ট্রযন্ত্রের সব কিছুর ওপর তাঁর নিয়ন্ত্রণ সুসংহত করেছেন।

হিউম্যান রাইটস ওয়াচসহ স্থানীয় এবং আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো হাসিনার শাসনামলে নির্বিচারে গ্রেপ্তার, গুম, নির্যাতন, বিচারবহির্ভূত হত্যা এবং ব্যাপক দমন-পীড়নের চিত্র তুলে ধরে বিস্তারিত প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে।

গত ২৮ অক্টোবর বিএনপির মহাসমাবেশ আয়োজনকে কেন্দ্র করে সহিংস ঘটনার পর থেকে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ শীর্ষস্থানীয় নেতাদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে।  দলটির পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে, সরকার পতনের দাবিতে ডাকা হরতাল, অবরোধ ও অসহযোগ আন্দোলন কর্মসূচি থেকে হাজারো বিরোধী নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

BD-pic-3.JPG
নয়া পল্টনে কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে বিএনপির মহাসমাবেশ। ২৮ অক্টোবর, ২০২৩। (বেনারনিউজ)

পুলিশ ও বিএনপির তরফ থেকে পাওয়া তথ্যমতে, ২৮ অক্টোবরের নিহত দুইজনসহ ওই দিনের পর থেকে রাজনৈতিক সহিংসতায় কমপক্ষে ৩০ জনের মৃত্যু হয়েছে, যাদের মধ্যে ছয়জন মারা গেছেন কারাগারে।

বিএনপির ভাষ্য অনুযায়ী, বিরোধী দলের সদস্যদের বিরুদ্ধে ৪০ লাখ ফৌজদারি মামলা রয়েছে।  মৃত ব্যক্তি, কারাবন্দি ও নির্বাসিত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধেও ‘গায়েবি মামলা’ দেওয়া হয়েছে।

এদিকে গত বৃহস্পতিবার ঢাকার একটি আদালত এক যুগ আগের একটি নাশকতার মামলায় বিএনপির দুই প্রাক্তন মন্ত্রীসহ আট নেতাকে কারাদণ্ড দিয়েছেন।

 ‘একদলীয় শাসন ব্যবস্থা’

১৯৭১ সালে স্বাধীন বাংলাদেশের জন্মের পর থেকে এ পর্যন্ত ১১টি সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে।  এর মধ্যে চারটি নির্বাচন নিয়ে তুলনামূলক কম বিতর্ক রয়েছে, যার সবগুলোই নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থায় অনুষ্ঠিত হয়েছিল।  আওয়ামী লীগ ২০১১ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে।

সুষ্ঠু নির্বাচন নিয়ে প্রশ্ন তুলে বিএনপি ও তার মিত্ররা ২০১৪ সালের নির্বাচন বর্জন করে।  ২০১৮ সালে বিএনপি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করলেও ক্ষমতাসীন দলের বিরুদ্ধে ব্যাপক কারচুপির অভিযোগ ওঠে।  ওই নির্বাচনে আওয়ামী ৯৫ শতাংশের বেশি সংসদীয় আসন পায়।

সাম্প্রতিক মাসগুলোতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং অন্যান্য পশ্চিমা দেশগুলো বাংলাদেশে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের আহ্বান জানিয়ে আসছে।  গত মে মাসে ওয়াশিংটন ঘোষণা দেয়, বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক নির্বাচন ব্যবস্থাকে বাধাগ্রস্ত করলে দায়ী ব্যক্তিদের ওপর ভিসা নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হবে।

তারপরও পর্যবেক্ষকরা মনে করছেন, নির্বাচন প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক হবে বলে আশা করা যাচ্ছে না।

“এর পরিণতি হলো আমরা একদলীয় রাজনৈতিক ব্যবস্থা দেখতে যাচ্ছি,” বেনারকে বলেন রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক নিজাম উদ্দিন আহমেদ।

আওয়ামী লীগ বলেছে, তার দলের লোকজন ‘ডামি প্রার্থী’ হিসেবে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করলে বাধা দেওয়া হবে না।  ফলে সরকারি দলের নেতাদের বিরুদ্ধে ক্ষমতাসীন দলের লোকই ‘স্বতন্ত্র প্রার্থী’ হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন।

সরকার কিছু ছোট ও নতুন দলকে উৎসাহ দিলেও ভোটার উপস্থিতি কম হওয়ার আশঙ্কা থেকেই যাচ্ছে।

“সংসদে বিরোধী দল সরকারের অনুকূলে থাকলেও জাতীয় পার্টি  ৩০০ আসনের মধ্যে এক ডজনের বেশি আসন পাবে বলে আশা করা যায় না,” বলেন অধ্যাপক কলিমুল্লাহ।

তিনি বলেন, “আমাদের ওয়েস্টমিনস্টার পদ্ধতির শাসন ব্যবস্থা রয়েছে।  তবে পরবর্তী সংসদ চীনা কমিউনিস্ট পার্টির মতো নির্বাচিত এমপিদের নিয়ে গঠিত হবে।  সে দেশে পার্টির সদস্যদের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে দেওয়া হয়,” বলেন তিনি।

‘মানুষ পরিবর্তন চায়’

নির্বাচন কমিশনের তথ্য অনুসারে, এবার নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে ২৮টি দল।  নিবন্ধিত মোট ভোটার প্রায় ১২ কোটি। নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নামা এক হাজার ৮৯৫ জন প্রার্থীর মধ্যে নারীর সংখ্যা প্রায় পাঁচ শতাংশ।

অনেক ভোটারের জন্য জীবনযাত্রার ব্যয় নির্বাহ মূল উদ্বেগের বিষয়।  বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাব অনুযায়ী গত অক্টোবরে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ১২ দশমিক ৫৬ শতাংশ রেকর্ড করেছে, যা গত এক দশকের মধ্যে ছিল সর্বোচ্চ। 

বিএনপি তাদের সাম্প্রতিক সমাবেশগুলোতে সরকারের সমালোচনায় বিদ্যুৎ ঘাটতি, জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি এবং ব্যাপক দুর্নীতির অভিযোগ তোলে।  অন্যদিকে ন্যায্য মজুরির দাবিতে পোশাক শ্রমিকদের অসন্তোষের জেরে সাম্প্রতিক মাসগুলোতে ঢাকা ও পার্শ্ববর্তী জেলাগুলোতে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড আশানুরূপ হয়নি।

BD-pic-4.JPG
মিরপুরে আন্দোলনরত গার্মেন্টস কর্মীদের দিকে টিয়ারগ্যাস ছুড়ছে পুলিশ। নভেম্বর ২, ২০২৩। ( বেনারনিউজ)

দিনাজপুর-৬ আসনের বাসিন্দা মতিউর রহমান বেনারকে বলেন, নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় তাঁর পরিবার সংকটে আছে।

তিনি বলেন, “স্থানীয় সংসদ সদস্য গরিব মানুষের কষ্টের কথা সংসদে বলেন না।  মানুষ পরিবর্তন চায়।  তবে আগামী সপ্তাহের নির্বাচন একতরফা হওয়ায় পরিবর্তন অধরা থেকে যাবে মনে করা হচ্ছে।”

পটুয়াখালী-২ আসনের বাসিন্দা  আব্দুল মান্নান বলেন, “ভোটকেন্দ্রে গিয়ে লাভ কী? আমি যাই বা না যাই, আওয়ামী লীগের প্রার্থী জয়ী হবে।  আমার পরিবারের কেউ ভোট কেন্দ্রে যাবে না।”

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।