নির্বাচনী সহিংসতা নিহত ১৬
2018.12.30
ঢাকা
দেশের বিভিন্ন স্থানে বিক্ষিপ্ত সহিংসতার মধ্য দিয়ে শেষ হয়েছে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ভোট গ্রহণ। এসব সহিংসতার ঘটনায় এখন পর্যন্ত ১৬ জন নিহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। তবে দেশের অনেক জায়গায় শান্তিপূর্ণ ভোট গ্রহণ হয়েছে বলেও জানা যায়।
রাত ১০টা পর্যন্ত পাওয়া খবরে, সব মিলিয়ে দেশের ১২টি জেলায় সহিংসতায় মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। এর বাইরে আরও অন্তত নয়টি জেলায় সহিংসতায় কমপক্ষে ৩০৪ জন আহত হয়েছেন। আহতদের মধ্যে ৮ জন পুলিশ সদস্য।
এদিকে নির্বাচনকে ‘প্রহসনের নির্বাচন’ আখ্যা দিয়ে নির্দলীয় সরকারের অধীনে পুনঃনির্বাচন দাবি করেছ জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট।
এ ছাড়া ছুরিকাঘাত হয়েছেন ঢাকা-৪ আসনের বিএনপি প্রার্থী সালাহউদ্দিন আহমেদ। দেশের বিভিন্ন এলাকার ভোটকেন্দ্র থেকে তাদের এজেন্টদের বের করে দেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ তুলেছে বিরোধী দলীয় জোট ঐক্যফ্রন্ট।
ফলাফল প্রত্যাখ্যান ঐক্যফ্রন্টের
রোববার রাতে ঢাকায় এক সংবাদ সম্মেলনে ঐক্যফ্রন্টের আহ্বায়ক ড. কামাল হোসেন নির্বাচনের ‘কথিত ফলাফল’ প্রত্যাখানের ঘোষণা দেন।
কামাল হোসেন বলেন, “প্রতি মুহূর্তে দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে ফোন আসছে, আমাদের প্রার্থীর এজেন্টদের বের করে দেওয়া হচ্ছে। কেন্দ্রে যেতে বাধা দেওয়া হচ্ছে। যে সংবাদগুলো পাচ্ছি, তা দুঃখজনক, উদ্বেগজনক।”
“আমরা নির্বাচন কমিশনের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি, অবিলম্বে এ প্রহসনের নির্বাচন বাতিল করা হোক। এ নির্বাচনের কথিত ফলাফল আমরা প্রত্যাখ্যান করছি এবং সেই সঙ্গে নির্দলীয় সরকারের অধীনে পুনঃ নির্বাচন দাবি করছি,” লিখিত বিবৃতিতে বলেন জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের নেতা ড. কামাল হোসেন।
সারা দেশে নিহত ১৬
গাজীপুর
গাজীপুর সদর উপজেলার হরিনাল উচ্চ বিদ্যালয় ভোটকেন্দ্রে বিএনপির নেতাকর্মীদের সঙ্গে সংঘর্ষে নিহত হয়েছেন লিয়াকত হোসেন (৪৪) নামের আওয়ামী লীগের এক কর্মী।
গাজীপুর সদর থানার ওসি সমীর সূত্রধর সাংবাদিকদের জানান, রোববার আলীমুদ্দিন কলেজের সাবেক ভিপি লিয়াকতকে ভোটকেন্দ্রের বাইরে সংঘর্ষের সময় বিএনপির নেতা-কর্মীরা কুপিয়ে আহত করে।
ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে যাওয়ার পথে তিনি মারা যান বলে নিশ্চিত করেছেন লিয়াকতের ভাই।
কক্সবাজার
ভোট দিতে গিয়ে সংঘর্ষের মধ্যে মারা গেছেন কক্সবাজারের পেকুয়ার রাজাখালী উলুদিয়া এলাকায় আবদুল্লাহ আল ফারুক (২৩) নামের এক আওয়ামী লীগ সমর্থক। মাতবরপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে রোববার সকাল সাড়ে ১১টার দিকে ওই সংঘর্ষে সাতজন আহত হয়েছেন।
পেকুয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এবং সহকারী রিটর্নিং কর্মকর্তা মাহবুবুল করিম বেনারকে বলেন, “বিএনপি এবং আওয়ামী লীগ দুপক্ষের সংঘর্ষের মধ্যে পড়ে মারা যায় সে।”
নরসিংদী
নরসিংদী জেলার শিবপুরের কুন্দারপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ভোটকেন্দ্রে নৌকা প্রতীকের এজেন্ট মিলন মিয়া (৫৫) নামের একজন নিহত হয়েছেন বলে বেনারকে নিশ্চিত করেছেন নরসিংদীর অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মোহাম্মদ শফিউর রহমান।
আওয়ামী লীগের নৌকা প্রতীকের প্রার্থী জহিরুল হক ভূঁইয়া ও আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী ও স্বতন্ত্র প্রার্থী সিরাজুল ইসলাম মোল্লার সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষের এক পর্যায়ে মিলন মিয়াকে ওই কেন্দ্রেই কুপিয়ে হত্যা করা হয়।
বগুড়া
বগুড়ার কাহালুতে একটি ভোটকেন্দ্রের সামনে সংঘর্ষে নিহত হয়েছেন আজিজুল নামের এক যুবলীগ নেতা। তিনি পায়কর ইউনিয়নের ৩ নম্বর ওয়ার্ড যুবলীগের সহসভাপতি।
রোববার বেলা ১১টার দিকে কাহালুর বাগুইল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ভোটকেন্দ্রের সামনে বিএনপি ও আওয়ামী লীগের কর্মীদের মধ্যে সংঘর্ষে আজিজুল হক ও নাজমুল হককে পিটিয়ে আহত করা হয় বলে জানান কাহালু থানার ওসি শওকত কবীর।
তিনি জানান, স্থানীয় টিএমএসএস মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়ার পথে আজিজুল মারা যান। নাজমুল হুদা হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন।
রাঙ্গামাটি
রাঙ্গামাটির কাউখালী উপজেলার ঘাগড়ায় আওয়ামী লীগ ও বিএনপির সমর্থকদের সংঘর্ষে বাসের উদ্দিন (৩৬) নামে একজন নিহত হয়েছেন। তিনি ইউনিয়ন যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক। রোববার সকাল সাতটার দিকে ঘাগড়া ইউনিয়নের কাসখালী এলাকায় দুই দলের মধ্যে এই সংঘর্ষ হয়। এ ঘটনায় ১৫ জন আহত হন।
বিষয়টি নিশ্চিত করে রাঙ্গামাটির পুলিশ সুপার আলমগীর কবির বেনারকে বলেন, ওই ঘটনায় জড়িত থাকার দায়ে দুজন বিএনপি কর্মীকে আটক করা হয়েছে।”
কুমিল্লা
সকাল সাড়ে ১০টার দিকে কুমিল্লার চান্দিনা উপজেলার পশ্চিম বেলাস্বর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ভোটকেন্দ্রে পুলিশের গুলিতে মজিবুর রহমান (৩৮) নামের এক ব্যক্তি নিহত হয়েছেন। এ সময় গুলিবিদ্ধ হন মিজানুর রহমান নামের আরেক ব্যক্তি।
মজিবুর রহমানের স্ত্রী শাহনাজ আকতার সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমরা সকালে ভোট দিতে গিয়েছিলাম। এ সময় অতর্কিতভাবে একদল সন্ত্রাসী এসে ভোটকেন্দ্র থেকে ব্যালট পেপার নিয়ে যায়। তখন ধানের শীষ ও নৌকা প্রার্থীর অনুসারীদের মধ্যে পাল্টাপাল্টি ধাওয়া ও সংঘর্ষের ঘটনা ঘটলে পুলিশ গুলি ছোড়ে। এ সময় মজিবুর রহমান ও মিজানুর রহমান গুলিবিদ্ধ হন।”
হাসপাতালে আনার পর কর্তব্যরত চিকিৎসক মজিবুর রহমানকে মৃত ঘোষণা করেন। আর মিজানুরকে কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়।
এছাড়া রোববার সকালে কুমিল্লা-১০ আসনে (নাঙ্গলকোট) বাচ্চু মিয়া (৪৮) নামে এক বিএনপি কর্মীকে পিটিয়ে হত্যার ঘটনা ঘটেছে।
হামলাকারীরা ছাত্রলীগের নেতাকর্মী বলে স্থানীয় বিএনপির অভিযোগ।
ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করে নাঙ্গলকোট থানা পুলিশের ওসি নজরুল ইসলাম সাংবাদিকদের জানান, “হামলাকারীদের শনাক্ত করা যায়নি। ঘটনাস্থলে পুলিশ পাঠানো হয়েছে।”
চট্টগ্রাম
নির্বাচনী সংঘর্ষে চট্টগ্রামে তিনজনের নিহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে।
রোববার সকাল ১০টার দিকে পটিয়ার পশ্চিম মালিয়ারা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্র দখল নিয়ে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে সংঘর্ষে নিহত হন আবু সাদেক (১৮)। তিনি বিএনপির সমর্থক ছিলেন বলে জানা গেছে।
চট্টগ্রাম জেলা পুলিশের পটিয়া সার্কেলের সহকারী পুলিশ সুপার জসিম উদ্দিন খান বেনারকে বলেন, বিএনপি ও আওয়ামী লীগের দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষে আবু সাদেক নিহত হন।”
এর আগে চট্টগ্রাম-১২ আসনের পটিয়া উপজেলার কুসুমপুর ইউনিয়নে গুরনখাইন এলাকায় শনিবার রাত নয়টার দিকে বিএনপি জামায়াত কর্মীদের অতর্কিত হামলায় দ্বীন মোহাম্মদ (৩৫) নামে এক যুবলীগ কর্মী নিহত হন বলে জানান ওই থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) নিয়ামত উল্লাহ।
এছাড়া চট্টগ্রাম জেলার বাঁশখালি উপজেলার কাছারিয়া এলাকায় বিএনপি-জামাত সমর্থকদের হামলায় শনিবার রাত দুইটার দিকে আহমদ কবীর (৪৮) নিহত হন বলে বেনারকে জানিয়েছেন বাঁশখালি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আব্দুস সালাম।
রাজশাহী
আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি’র নেতা-কর্মীদের মধ্যে সংঘর্ষে রাজশাহী-৩ আসনের মোহনপুরের পাকুড়িয়া হাইস্কুল কেন্দ্রের সামনে মেরাজউদ্দিন (২২) নামে এক যুবক নিহত হয়েছেন বলে নিশ্চিত করেছেন রাজশাহী জেলা অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আব্দুর রাজ্জাক খান।
নির্বাচনী সহিংসতায় রাজশাহী-১ (তানোর-গোদাগাড়ী) আসনের তানোর উপজেলায় নিহত হয়েছেন মোদাচ্ছের আলী (৪৫) নামে একজন।
রোববার দুপুর ১২টার দিকে পাঁচন্দর ইউনিয়নের মোহাম্মদপুর উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্রে এ ঘটনা ঘটে। তিনি ওই ইউনিয়নের ৮নং ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ছিলেন।
জামায়াত-বিএনপির নেতাকর্মীদের হামলায় তিনি নিহত হন বলে সাংবাদিকদের জানান জেলা পুলিশের মুখপাত্র সহকারী পুলিশ সুপার আবদুর রাজ্জাক খান।
দিনাজপুর
এছাড়াও দিনাজপুরে সহগ্রাম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রের সামনে দুপুর ১২টার দিকে দুই গ্রুপের কর্মীদের মধ্যে ধাওয়া পাল্টা ধাওয়ায় কিনা মোহাম্মদ (৬৫) নামে একজনের মৃত্যু হয়েছে।
বিরল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) গোলাম রসুল জানান, “ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার ঘটনায় সম্ভবত হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে তিনি মারা গেছেন।”
ব্রাহ্মণবাড়িয়া
নির্বাচনী সহিংসতায় ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর উপজেলার রাজঘর গ্রামে ইসরাইল মিয়া (২০) নামের একজন মারা যাওয়ার খবর নিশ্চিত করেছেন ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক শওকত হোসেন।
জানা যায়, রোববার বেলা ১১টার দিকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৩ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী ওবায়দুল মুক্তাদির উপজেলার নাটাই উত্তর ইউনিয়নের রাজঘর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে ভোট দিতে গেলে বিএনপি ও আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। এসময় পুলিশ গুলি ছোড়ে। পরে ঘটনাস্থল থেকে গুলিবিদ্ধ ইসরাইলকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নেওয়া হয়।
সুনামগঞ্জ
শনিবার দিবাগত রাতে সুনামগঞ্জের ধর্মপাশা উপজেলার জয়শ্রী ইউনিয়নের মহিষপুর গ্রামে বিএনপি কর্মীর আঘাতে সাইফুল ইসলাম (৪০) নামের এক আওয়ামী লীগ কর্মী নিহত হন।
লক্ষ্মীপুর
এদিন মধ্যরাতে লক্ষ্মীপুরে বড়ালিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের কেন্দ্রের বাইরে দু'পক্ষের গোলাগুলির পর ডোবা থেকে এক অজ্ঞাত ব্যক্তির লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা নিহত যুবককে ছাত্রলীগ কর্মী বলে দাবি করেছেন।
ধানের শীষের প্রার্থীর ওপর হামলার অভিযোগ
ভোটের দিন সকালে ঢাকা-৪ আসনে ধানের শীষের প্রার্থী সালাহউদ্দিন আহমদের ওপর হামলা হয়েছে বলে অভিযোগ করেছে তার পরিবার। যদিও ঘটনাটি ‘সাজানো’ দাবি পুলিশর।
সালাহউদ্দিনের ছেলে রবীন সাংবাদিকদের জানান, সকাল সোয়া নয়টার পরে তার বাবা শ্যামপুর সরকারি মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজে ভোট দিতে গেলে তার ওপর হামলা হয়। তার বাবার পিঠে ও পেটে কোপ লেগেছে।”
এ ঘটনায় আরও ১৫-১৬ জন আহত হয়েছে বলে জানান তিনি।
তবে কদমতলী থানার ওসি আবদুল জলিল বেনারকে বলেন, নির্বাচন কেন্দ্রে বিএনপি প্রার্থী সালাহউদ্দিনের সাথে কিছুই হয়নি। বরং উনি এসে পুলিশ এবং প্রিজাইডিং অফিসারের সাথে খারাপ ব্যবহার করেছেন। আমি বুঝতে পারছি না তাকে হামলার ঘটনা কখন ঘটল “
শান্তিপূর্ণ ভোট হচ্ছে: সিইসি
বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছাড়া সারা দেশে শান্তিপূর্ণভাবে ভোট হচ্ছে বলে জানিয়েছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কে এম নূরুল হুদা।
রোববার সকালে রাজধানীর উত্তরার একটি কেন্দ্রে ভোট দেওয়ার পর সাংবাদিকদের তিনি বলেন, “চট্টগ্রাম, নোয়াখালীসহ বিভিন্ন স্থানে ছোটখাটো বিচ্ছিন্ন ঘটনার কথা আমি শুনেছি। ঘটনাগুলো ঢাকায় বসে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। তবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে এ বিষয়ে স্পষ্ট নির্দেশনা দেওয়া আছে, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেলে, সংশ্লিষ্ট কেন্দ্রে ভোট বন্ধ থাকবে।”
বিভিন্ন কেন্দ্রে বিএনপির এজেন্ট না থাকার কারণ জানতে চাইলে নূরুল হুদা বলেন, “এজেন্ট যদি কেন্দ্রে না আসে, সে ক্ষেত্রে আমরা কী করতে পারি?”