ভোটকেন্দ্রে অনুপস্থিত বিরোধী জোটের নির্বাচনী এজেন্ট
2018.12.30
ঢাকা

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ঢাকা ও পার্শ্ববর্তী এলাকার ভোট কেন্দ্রগুলোতে বিরোধী জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের কোনো নির্বাচনী এজেন্ট দেখা যায়নি। এসব কেন্দ্রে অস্বাভাবিক ভোট প্রদান করতেও দেখা গেছে।
কিছু কিছু কেন্দ্রে ভোটারের সংখ্যা কম থাকলেও দুপুরের মধ্যেই ৬৫ থেকে ৮০ ভাগ ভোট দেয়া শেষ হয়েছে বলে জানান কর্মকর্তারা।
কিন্তু সেই তুলনায় ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনে (ইভিএম) ভোট পরিচালনাকারী কেন্দ্রগুলোতে ভোট প্রদানের হার ছিল অনেক কম।
বেলা পৌনে একটায় ঢাকার পার্শ্ববর্তী নারায়ণঞ্জ জেলার রূপগঞ্জ উপজেলার ব্রাহ্মণখালী ইউনিয়নের জনতা উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্রে যান বেনার নিউজের প্রতিনিধি।
এ আসনে নৌকা প্রতীকে লড়ছেন গোলাম দস্তগীর গাজী এমপি। আর বিএনপির প্রার্থী মো. মনিরুজ্জামান।
সেখানে কোনো সাধারণ ভোটারের উপস্থিতি তেমন চোখে পড়েনি। স্কুলের সামনে কিছু স্থানীয় যুবককে আড্ডা দিতে দেখা যায়।
ওই কেন্দ্রের এক নম্বর বুথের ৫৪৫ ভোটারের মধ্যে ৩৬২ টি ভোট পড়ে বলে বেনারকে জানান বুথের পোলিং অফিসার নুরুল ইসলাম। শতকরা হারে এই সংখ্যা ৬৬।
ওই কেন্দ্রের দুই নম্বর বুথের মোট ৪০৩ ভোটের মধ্যে ৩০০ ভোট পড়ে বলে বেনারকে জানান সহকারি প্রিজাইডিং অফিসার কাজী জাহান। শতকরা হারে এই সংখ্যা ৭৪।
তবে চার নম্বর মহিলা বুথে মোট ৫০০ ভোটারের মধ্যে ২৯১টি ভোট পড়ে যা ৫৮ শতাংশের বেশি।
পুরো কেন্দ্রে বিএনপির প্রার্থী মনিরুজ্জামানের ধানের শীষ প্রতীকের কোনো এজেন্ট দেখা যায়নি। ওই কেন্দ্রে নৌকা, গোলাপফুল, সিংহ ও কাস্তে প্রতীকের দুজন করে নির্বাচনী এজেন্ট দেখা যায়।
ওই কেন্দ্রে কোনো ভোটার ছিলেন না। একটি ১২/১৩ বছরের ছেলেকে হাতে ভোটার স্লিপ নিয়ে এক নম্বর বুথে অবস্থান করতে দেখা যায়।
তার সাথে কথা বলতে গেলে প্রিজাইডিং অফিসার ওই বালকসহ কয়েকজনকে বলেন, “সর, এখন সাংবাদিক আইছে।”
এ ব্যাপারে প্রশ্ন করতে প্রিজাইডিং অফিসারের কাছে গেলে তিনি বলেন, “আমার কেন্দ্রে ৩,১০০ ভোটের মধ্যে ২,৪০০ ভোট পড়েছে। সুন্দর ভোট হয়েছে আমার সময় নাই। আপনারা যান।”
তাঁর নাম জানতে চাইলে তিনি বলেন, “আমার নাম নাই।”
ধানের শীষের এজেন্ট নেই কেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, “তারা আসেনি কেন আমি কীভাবে বলব?”
প্রিসাইডিং অফিসারের কক্ষে অবস্থান করা কুসুম নামের এক আওয়ামী লীগ নেতা বেনারকে বলেন, “ধানের শীষের এজেন্টদের আসতে দেইনি। ওরা কেউ নাই। আসবেও না।”
এরপর ঢাকা-১২ আসনের আওতাধীন নাখালপাড়া হোসেন আলী স্কুল কেন্দ্র পরিদর্শনকালে কেন্দ্রটির তিন নম্বর বুথের ইনচার্জ বেনারকে বলেন, “বেলা দুটার মধ্যে আমার এখানে শতকার ৯০ ভাগ ভোট দেয়া হয়ে গেছে।”
তিনি বলেন, “আমাদের কেন্দ্রে ভোট প্রায় শেষ।”
বেলা ২টা ৪০ মিনিটে সাত নম্বর পুরুষ বুথের ৫০৩ ভোটের মধ্যে ৪৪০টি ভোট পড়েছে বলে বেনারকে জানান সহকারি প্রিজাইডিং অফিসার বজলুর রহমান। এটি প্রায় ৮৮ শতাংশ।
ইভিএমে ভোট প্রদানের হার কম
প্রথমবারে জাতীয় নির্বাচনে সারা দেশের ছয়টি আসনের ৮৪৫টি ভোটকেন্দ্রে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনে (ইভিএম) ভোট নেওয়া হয়।
তবে মেশিনের কারিগরি ত্রুটি, ভোটারের আঙুলের ছাপ না মেলা, দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের মেশিন পরিচালনায় অদক্ষতা, গোপন কক্ষে আগে থেকেই বহিরাগতদের উপস্থিতির মতো ঘটনা ছিল ইভিএমে ভোট নেওয়া সকল আসনেই।
একাদশ সংসদ নির্বাচনে ঢাকা-৬, ঢাকা-১৩, চট্টগ্রাম-৯, রংপুর-৩, খুলনা-২ এবং সাতক্ষীরা-২ আসনে ইভিএমে ভোট হচ্ছে। এসব আসনের আট শতাধিক কেন্দ্রে ভোটারের সংখ্যা ২১ লাখের বেশি। এসব আসনের ১৯টি ভোটকক্ষের ইভিএম মেশিনে বড় ধরনের কারিগরি সমস্যা দেখা দেয় বলে জানান সংশ্লিষ্টরা। ফলে এসব কক্ষে কয়েক ঘণ্টা করে ভোট বন্ধ রাখতে হয়। যে কারণে ভোট না দিয়েই ফিরে যেতে বাধ্য হন অনেকে।
সরেজমিনে ঢাকা-১৩ আসনের দেখা যায়, এখানে ভোট প্রদানের হার অন্যান্য কেন্দ্রের চেয়ে অনেক কম ছিল।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব একাডেমি কেন্দ্রের চার নম্বর মহিলা বুথের মোট ৪৩২টি ভোটের মধ্যে বেলা তিনটা আট মিনিটে ৬২টি ভোট পড়ে বলে বেনারকে জানান সহকারি প্রিজাইডিং অফিসার মুছলেম উদ্দিন। এটি শতকরা ১৪ ভাগ।
বিকাল তিনটা ১০ মিনিটে পাঁচ নম্বর মহিলা বুথের মোট ৪৩২টি ভোটের মধ্যে ভোট পড়ে ৯৫টি। এটি শতকরা ২১ ভাগ।
এক নম্বর বুথের মোট ৪২৯টি ভোটের মধ্যে দুপুর তিনটায় ভোট পড়ে ১৩১টি। এটি মোট ভোটের শতকরা ৩০.৫ ভাগ।
ঢাকা-১৭, ঢাকা-১২, ঢাকা-১৩, ঢাকা-১৫, ঢাকা-১৬ ও নারায়ণগঞ্জ আসনের কোথাও বিএনপিসহ জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের এজেন্ট দেখা যায়নি।
বয়স্করা প্রযুক্তিগত অনভিজ্ঞতার কারণে ইভিএমে বিরক্ত প্রকাশ করলেও উচ্ছ্বাস জানান তরুণরা।
মোহাম্মপুরের চাঁদ কমিউনিটি সেন্টারে ভোট দিয়ে সুরাইয়া সুমি বেনারকে বলেন, “প্রথমবার ভোট দিলাম। সেটাও ইভিএমে। মাত্র দুটো বাটন চেপে মুহূর্তেই ভোট দেয়া শেষ। এটাই ভালো।”
অন্যদিকে ঢাকা-৬ আসনের সুরিটুলা মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভোট দিতে আসা ৭০ বছর বয়স্ক বদির উদ্দীন ইভিএমে ভোট দেওয়াকে ঝামেলা বলে মনে করেন।
নির্বাচনের শুরু থেকেই বিরোধী দলীয় জোট জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট এবং বিএনপির পক্ষ থেকেও কেন্দ্রে তাঁদের নির্বাচনী এজেন্টকে বের করে দেওয়ার অভিযোগ করা হয়।
রোববার ভোটগ্রহণ শেষে রাতে এক সংবাদ সম্মেলনেও ঐক্যফ্রন্টের শীর্ষ নেতা ড. কামাল হোসেন নির্বাচনে কারচুপির অভিযোগ তুলে তা বাতিল করে নির্দলীয় সরকারের অধীনে নতুন নির্বাচনের দাবি জানান।
প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কে এম নূরুল হুদা বলেছেন, ধানের শীষের এজেন্টরা কেন্দ্রে না এলে কী করার আছে? তাঁরা কেন্দ্রে কেন আসেননি বা কেন কোনো এজেন্ট নেই, সেটা প্রার্থীর নির্ধারিত এজেন্টরাই বলতে পারবেন।
গতকাল রোববার রাজধানীর উত্তরার ৫ নম্বর সেক্টরের আইইএস স্কুল কেন্দ্রে ভোট দিতে গিয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে সিইসি এসব কথা বলেন। তিনি আরও বলেন, ধানের শীষের এজেন্টরা কেন আসতে পারেননি, তা তিনি জানেন না। তবে পোলিং এজেন্টদের কেউ আসতে পারছেন না বা তাঁদের আসতে বাধা দেওয়া হচ্ছে—এমন কোনো অভিযোগ তাঁদের কাছে কেউ করেননি।