সরকারি দলের নির্বাচনী প্রচার শুরু, বিরোধীরা চাপের মুখে
2018.01.30
ঢাকা
আসন্ন একাদশ জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে আনুষ্ঠানিকভাবে নির্বাচনী প্রচারণা শুরু করেছে বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ। মঙ্গলবার সিলেটে হজরত শাহজালালের মাজার জিয়ারতের মধ্য নিয়ে আবারও ক্ষমতায় আসতে নৌকা প্রতীকে ভোট চান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
তবে ক্ষমতাসীনরা প্রচারণা শুরু করলেও তাঁদের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী দল বিএনপি নেতা কর্মীদের দিন কাটছে মামলা-মোকদ্দমা ঠেকাতেই। মঙ্গলবার প্রধানমন্ত্রী যখন সিলেটে ভোট চাইছিলেন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া তখন দুর্নীতির এক মামলায় আদালতে হাজিরা দেন।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা বলছেন, এই অসম পরিস্থিতি গণতন্ত্রের জন্য মোটেই সুখকর নয়। সুষ্ঠু গণতন্ত্রের জন্য ক্ষমতাসীন এবং বিরোধী দল উভয়ের জন্যই লেভেল প্লেয়িং থাকা জরুরি মনে করেন তাঁরা।
“এ ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশনের দেখা উচিত নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার আগে নির্বাচনী প্রচারণার যে রূপরেখা আছে সেটা লঙ্ঘন হচ্ছে কিনা। সেটা যদি হয়, তাহলে কমিশনকে যথাযথ আইনের প্রয়োগ করতে হবে। তাহলেই সেটা নির্বাচন পূর্ব রাজনীতির জন্য শুভকর হবে,” বেনারকে বলেন ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) এর নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান।
প্রধানমন্ত্রী হিসেবে সফরে গিয়ে শেখ হাসিনার নির্বাচনী প্রচারণা করার সমালোচনা করেছে বিএনপিও।
“সরকারি খরচে এমন নির্বাচনী প্রচারাভিযান নির্বাচন কমিশনকে বন্ধ করতে হবে। অন্যথায় বিএনপিকে জনসভা করার সুযোগ দিতে হবে,” বলেন বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ।
নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন তুলে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড দাবি করেন তিনি।
মঙ্গলবার সন্ধ্যায় রাজধানীর গুলশানে বিএনপির চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক কার্যালয়ে সাংবাদিকদের মওদুদ বলেন, “আজ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে নির্বাচনী প্রচারাভিযানে নেমে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন ডিসেম্বরে নির্বাচন হবে। তাহলে প্রশ্ন নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা আসলে কী? নির্বাচনী প্রচার তো শুরু হয় সাধারণত নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর।”
প্রধানমন্ত্রীর প্রচারাভিযান লেভেল প্লেয়িং ফিল্ডের নমুনা নয় বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
তবে এই রাজনৈতিক পরিস্থিতির জন্য সরকারি দলের স্বেচ্ছাচারিতার পাশাপাশি বিরোধী দলের অদূরদর্শিতাকে দায়ী মনে করছেন বিশ্লেষকেরা।
এ প্রসঙ্গে ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, “এটা আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতি এবং বাস্তবতা যে, সরকারি দল ক্ষমতায় থাকার সুযোগ ব্যবহার করে বিভিন্ন কৌশলে সুবিধা আদায় করে নেয়। একইভাবে বিরোধী দলকেও প্রতিকূলতার মধ্যেই রাজনীতি ও নির্বাচন করতে হয়।”
“তবে ক্ষমতায় এবং ক্ষমতার বাইরে থাকার অভিজ্ঞতার ওপর ভিত্তি করে নির্বাচনমুখী দল হিসেবে বিএনপির যে কৌশলগুলো অবলম্বন করার কথা, সেটা তারা করেছে বলে মনে হয় না। নিজেদের কোণঠাসা অবস্থানকে বিএনপি বোধ হয় উপভোগই করছে। তারা সক্রিয় হতে না পারার দায়টা সহজেই সরকারের ওপর চাপাতে পারছে,” বলেন তিনি।
নৌকায় ভোট চাইলেন প্রধানমন্ত্রী
আগামী সংসদ নির্বাচনের প্রায় বছরখানেক বাকি থাকতেই মঙ্গলবার সিলেট থেকে নির্বাচনী প্রচার শুরু করেছে আওয়ামী লীগ।
“আমাদের নির্বাচনী প্রচার চালানো এখান থেকেই শুরু হলো,” মাজার জিয়ারত শেষে সিলেটের আলিয়া মাদ্রাসা মাঠে জনসভায় বলেন প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা। এ সময় নৌকা প্রতীকে ভোট চান তিনি।
প্রধানমন্ত্রীর কয়েকজন উপদেষ্টা, সরকারের গুরুত্বপূর্ণ কয়েকজন মন্ত্রীসহ আওয়ামী লীগ নেতারা শেখ হাসিনার সফরসঙ্গী ছিলেন।
সমাবেশে শেখ হাসিনা বলেন, “ডিসেম্বরে যে নির্বাচন হবে, সে নির্বাচনেও আপনাদের কাছে নৌকা মার্কায় ভোট চাই।”
আওয়ামী লীগ আয়োজিত এই জনসভা থেকেই শেখ হাসিনা সরকারি ২০টি প্রকল্প উদ্বোধন এবং ১৮টির ভিত্তিফলক উন্মোচন করেন।
বিএনপির সমালোচনা করে শেখ হাসিনা বলেন, “বিএনপি ধ্বংস করতে জানে, সৃষ্টি করতে জানে না। তারা পাঁচ বছরে হাজার হাজার গাড়ি পুড়িয়েছে। তাদের অগ্নি সন্ত্রাসে তিন হাজার মানুষ পুড়েছে।”
পুলিশের সঙ্গে বিএনপি কর্মীদের সংঘর্ষ
জিয়া ট্রাস্ট দুর্নীতির মামলায় হাজিরা দিতে মঙ্গলবার পুরান ঢাকার বকশিবাজারে ঢাকার জজ আদালতের বিশেষ এজলাসে যান বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া।
তবে এদিন হাজিরাকে কেন্দ্র করে জড়ো হওয়া নেতা কর্মীরা পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। হাইকোর্টের সামনের এলাকায় বিএনপির মিছিল থেকে পুলিশের ওপর হামলা, ভাঙচুর ও প্রিজন ভ্যানের তালা ভেঙে আটক দুই কর্মীকে ছিনিয়ে নেওয়ার অভিযোগ এনেছে পুলিশ।
বকশিবাজারে স্থাপিত বিশেষ আদালতে জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় হাজিরা দিয়ে ফিরছিলেন খালেদা জিয়া। পুলিশের দাবি, মঙ্গলবার বিকেল পৌনে চারটায় বিএনপির নেতা-কর্মীদের মিছিল থেকে পুলিশের দিকে আকস্মিকভাবে ইট পাটকেল ছোড়া হয়। ওই ঘটনায় পুলিশের রমনা বিভাগের অতিরিক্ত উপকমিশনার (এডিসি) আশরাফুল আজিমের হাতের আঙুল ফেটে যায়। আহত হন আরও কয়েকজন পুলিশ সদস্য। এ সময় তাদের হেলমেট ও রাইফেল ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
“বিনা উসকানিতে বিএনপির মিছিল থেকে পুলিশের ওপর হামলা করা হয়। এতে অতিরিক্ত উপকমিশনার (এডিসি) আজিমসহ কয়েকজন পুলিশ আহত হন,” বেনারকে বলেন রমনা বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) মারুফ হোসেন সরদার।
পুলিশ জানায়, হাইকোর্টের সামনে পুলিশের একটি প্রিজন ভ্যান ভাঙচুর করে মিছিলের কর্মীরা এতে আটক থাকা দুই নেতাকে ছিনিয়ে নিয়ে যায়। এই দুজনকে ছিনিয়ে নেওয়ার সময় দুই পুলিশের রাইফেল কেড়ে নিয়ে ভেঙেও ফেলে বিএনপি কর্মীরা। এর কিছুক্ষণ আগে হাই কোর্ট এলাকার জমায়েত থেকে ওই দুজনকে আটক করে পুলিশ।
“খালেদা জিয়া আদালত থেকে ফেরার পথে হাই কোর্টের সামনে তাঁর উপস্থিতিতেই কর্মীরা পুলিশের প্রিজন ভ্যানে হামলা করে দুজন নেতাকে ছিনিয়ে নেয়,” বলেন মারুফ হোসেন।
“পুলিশের ওপর ইট নিক্ষেপ, প্রিজন ভ্যান ভাঙচুর, পুলিশকে হত্যার উদ্দেশ্যে হামলার অভিযোগে হাই কোর্ট এলাকা থেকে অন্তত ৭০ জন বিএনপি নেতা-কর্মীকে আটক করা হয়েছে। পুলিশ বাদী হয়ে তাঁদের বিরুদ্ধে মামলা করবে,” সাংবাদিকদের জানান শাহবাগ থানার পরিদর্শক (তদন্ত) জাফর আলী।
রাতে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায়কে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।
খালেদার সর্বোচ্চ শাস্তি দাবি
খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে জিয়ার অরফানেজ ট্রাস্ট মামলার রায় ঘোষণা হবে ৮ ফেব্রুয়ারি। তাঁর বিরুদ্ধে জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলারও শুনানি চলছে।
এ মামলায় মোট আসামি চারজন। খালেদা জিয়া ছাড়া অন্য আসামিরা হলেন তাঁর সাবেক রাজনৈতিক সচিব হারিছ চৌধুরী, হারিছ চৌধুরীর এপিএস জিয়াউল ইসলাম মুন্না ও ঢাকার সাবেক মেয়র সাদেক হোসন খোকার এপিএস মনিরুল ইসলাম খান।
মঙ্গলবার এই মামলার যুক্তির্ক উপস্থাপনে রাষ্ট্রপক্ষ এই অভিযোগ তুলে ধরে বলেছে, এটা দুদক আইনের ৫(২) ধারায় দণ্ডযোগ্য, যার সর্বোচ্চ শাস্তি সাত বছর কারাদণ্ড। রাষ্ট্রপক্ষ আসামিদের সর্বোচ্চ শাস্তি চেয়েছে।
এই আইনি বিষয় নিয়ে দুই পক্ষই আগামী দিনগুলোতে ব্যাখ্যা, পাল্টা ব্যাখ্যা আদালতে দেবে। বকশিবাজারে স্থাপিত বিশেষ আদালত-৫-এর বিচারক মো. আখতারুজ্জামান এই মামলা শুনছেন। গতকাল রাষ্ট্রপক্ষের যুক্তিতর্ক উপস্থাপনের দিন ধার্য ছিল। খালেদা জিয়ার উপস্থিতিতে শুনানি শুরু হয়।