ইউপি নির্বাচনে সহিংসতায় নিহত ৯, আহত সহস্রাধিক
2016.03.22
ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) প্রথম দফার নির্বাচনে গতকাল মঙ্গলবার কমপক্ষে নয়জন নিহত হয়েছেন। ভোটগ্রহণ চলাকালে বিক্ষিপ্ত সংঘর্ষ ও পুলিশের গুলিতে আহতের সংখ্যা সহস্রাধিক। এ ছাড়া আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর শতাধিক সদস্যও আহত হয়েছেন।
এর আগে, ইউপি নির্বাচনের সময়সূচি ঘোষণার পর থেকে গত সোমবার পর্যন্ত মোট ১০ জন নিহত হন। আহত হন দুই সহস্রাধিক।
দিনভর সংঘাত ও সহিংসতা হলেও তিন জেলায় নিহতের সংখ্যা ছিল তিনজন। কিন্তু রাতে ভোট গণনাকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষ ও আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর গুলিতে পিরোজপুরের মঠবাড়িয়া থানার সাপা ডিগ্রি কলেজ কেন্দ্রে ছয়জন নিহত হন। আহতের সংখ্যা অর্ধশতাধিক, যাঁদের মধ্যে কয়েকজনের অবস্থা গুরুতর বলে রাতে এই প্রতিবেদন লেখার সময় পর্যন্ত স্থানীয় একাধিক সাংবাদিক বেনারকে জানিয়েছেন।
গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবর, নির্বাচন কমিশনের তথ্য এবং স্থানীয় সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, গতকালের নির্বাচনে ভোটকেন্দ্র থেকে প্রতিপক্ষের এজেন্টদের বের করে দেওয়া কিংবা ঢুকতে না দেওয়া, ব্যালট পেপার ছিনিয়ে নিয়ে সিল মারা, ব্যালট বাক্স ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা, ভোটকেন্দ্রের বাইরে শক্তি দেখানোসহ অস্বাভাবিক সব ঘটনা ঘটেছে।
গতকালের নির্বাচনে সরকার দলীয় চেয়ারম্যান পদপ্রার্থীদের বেশির ভাগই একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করেন। ফলে অন্য দল ও স্বতন্ত্র মিলে প্রায় অর্ধশত প্রার্থী নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দেন। এদের মধ্যে অধিকাংশই নোয়াখালী, পটুয়াখালী, বরিশাল, ভোলা, বরগুনা ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলায়। বেশ কয়েকজন চেয়ারম্যান প্রার্থী নির্বাচনের মাঠ থেকে ঘোষণা ছাড়াই সরে যেতে বাধ্য হন।
গতকাল ৭১২টি ইউপিতে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। অধিকাংশ এলাকায় সরকার দলীয় প্রার্থী ছাড়া সবাই নির্বাচনে জালভোট, জবরদস্তির অভিযোগ করেছেন। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ঝালকাঠীর রাজাপুর, বরিশালের বাকেরগঞ্জ, ভোলার ইলিশা, পটুয়াখালীর কলাপাড়া ও সাতক্ষীরাসহ কয়েকটি স্থানে পুলিশ গুলি চালায়।আরও কিছু জায়গায় আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করে।
নির্বাচন নিয়ে পরস্পরবিরোধী বক্তব্য
“নির্বাচনে ব্যাপক অনিয়ম হয়েছে সর্বত্র। আর দখল-কারচুপি ও সহিসংতা হয়েছে বেশির ভাগ জায়গায়। এই অবস্থায় অন্তত ৫০টি ইউপির নির্বাচন বাতিল করে নতুন করে নির্বাচন আয়োজনের মাধ্যমে দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে হবে। আগামী কয়েক দফার নির্বাচনের জন্য এই দৃষ্টান্ত ভালো ফল দিতে পারে,” নির্বাচন কমিশনে গিয়ে দলের পক্ষ থেকে এ কথা জানান বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল্লাহ্-আল নোমান।
নির্বাচনে জবরদস্তি, জালভোট, বুথ দখলের অভিযোগ সরকার দলীয় স্থানীয় নেতারা অস্বীকার করেছেন। স্থানীয় প্রশাসন কিছু কিছু বিষয় স্বীকার করে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলেছেন।
“অতীতের যেকোনো সময়ের তুলনায় আজকের ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) নির্বাচন ‘বেশ ভালো’, ‘শান্তিপূর্ণ, ‘স্বতঃস্ফূর্ত’ এবং ‘স্বচ্ছ’ হয়েছে,” মন্তব্য করেছেন আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক দীপু মনি। তাঁর দাবি, শতকরা ৯৯ দশমিক ৭২ ভাগ ভোট সুষ্ঠু হয়েছে।
মঙ্গলবার বিকেলে ধানমন্ডিতে আওয়ামী লীগ সভানেত্রীর রাজনৈতিক কার্যালয়ে দলটির পক্ষ থেকে দেওয়া ব্রিফিংয়ে দীপু মনি এসব কথা বলেন। তিনি বলেন, দলীয় ভিত্তিতে স্থানীয় সরকার নির্বাচন হচ্ছে বলেই এ নির্বাচন সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ হয়েছে।
অন্যদিকে নির্বাচন কমিশনও দাবি করেছে, সার্বিক বিবেচনায় নির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছে।
“বিচ্ছিন্নভাবে যে কয়েকটি ঘটনা ঘটেছে সেগুলোর ক্ষেত্রে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। অনিয়ম ও সংঘাত-সংঘর্ষের কারণে মোট ৬৬টি কেন্দ্রে নির্বাচন স্থগিত করা হয়েছে,” নির্বাচন শেষে সাংবাদিকদের জানান ঢাকায় প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী রকিবউদ্দিন আহমদ।
বেসরকারি সংস্থার পর্যবেক্ষণ
বেসরকারি সংস্থা ব্রতীর নির্বাচন পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদনে গতকাল বলা হয়েছে, বেশ কিছু কেন্দ্রে বুথের ভেতর ক্ষমতাসীন দলের মনোনীত প্রার্থীর সমর্থকদের অবস্থান করতে দেখা গেছে। কিছু কেন্দ্রে বল প্রয়োগের মাধ্যমে ব্যালট পেপারে সিল দিতে দেখা গেছে। এ ছাড়া ব্যালট পেপার ছিনিয়ে নেওয়া, জাল ভোট প্রদান, নির্বাচন কর্মকর্তাদের ওপর হামলা ও কেন্দ্র দখলের ঘটনা ঘটেছে।
বেশ কিছু ইউপিতে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের কর্মী-সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষ, হামলা, ধাওয়ার ঘটনা ঘটেছে। এ সব ঘটনায় নির্বাচন কর্মকর্তা, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য, প্রার্থীদের কর্মী-সমর্থক, এমনকি ভোটাররা পর্যন্ত আহত হয়েছেন। অধিকাংশ ক্ষেত্রে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সক্রিয়তায় পরিস্থিতি দ্রুত নিয়ন্ত্রণে এসেছে।
নিহত নয়জন
গতকাল দুপুরে ঝালকাঠি সদর উপজেলার নবগ্রাম ইউপির কালিয়ান্ধার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রের কাছে সদস্য পদপ্রার্থী সজীব হোসেন ও চুন্নু শিকদারের কর্মী-সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষ বাঁধে। এতে চুন্নু শিকদারের ভাই আবুল কাশেম শিকদার (৫৫) নিয়ত হন।
গত সোমবার সকালে বাউফল উপজেলার কালিশুরী ইউপির সিংহেরাকাঠী গ্রামে আওয়ামী লীগের চেয়ারম্যান প্রার্থী মো. নেছারউদ্দিন সিকদার ও আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী চেয়ারম্যান প্রার্থী আবদুর রহমান মিয়ার সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। এ সময় হুমায়ুন মল্লিক (৬০) নামে এক ব্যক্তি আহত হন। ওই দিনই তাঁকে বরিশাল শের-ই বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। চিকিৎসাধীন অবস্থায় মঙ্গলবার দুপুরে তিনি মারা যান।
নেত্রকোনার খালিয়াজুড়িতে নিহত ব্যক্তির নাম গোলাম আবু কাউছার ওরফে কাউছার মিয়া (৩২)। তিনি খালিয়াজুড়ি সদর ইউপির বর্তমান চেয়ারম্যান ও আওয়ামী লীগের চেয়ারম্যান প্রার্থী গোলাম আবু ইছহাকের ছোট ভাই।
গতকাল দিনভর বিক্ষিপ্ত সংঘর্ষে তিনজন মারা যায়। কিন্তু রাতে মঠবাড়িয়ায় একসঙ্গে ছয়জনের মৃত্যু নির্বাচনকে আরও বেশি রক্তাক্ত ও প্রশ্নবিদ্ধ করে।