জলবায়ু সম্মেলন: বাংলাদেশের প্রত্যাশা বৈশ্বিক তহবিল গঠন ও কার্বন নিঃসরণ কমানো

জেসমিন পাপড়ি
2021.04.06
ঢাকা
জলবায়ু সম্মেলন: বাংলাদেশের প্রত্যাশা বৈশ্বিক তহবিল গঠন ও কার্বন নিঃসরণ কমানো কক্সবাজারের কুতুবদিয়া দ্বীপে দাঁড়িয়ে আছেন এক নারী। বিশেষজ্ঞদের মতে আগামী পঞ্চাশ বছরের ভেতর ওই দ্বীপটি সম্পূর্ণ সমুদ্রে তলিয়ে যেতে পারে। ২০ নভেম্বর ২০১৫।
[এএফপি]

জলবায়ুজনিত বৈশ্বিক ক্ষতি মোকাবেলায় আসন্ন সম্মেলনে বাংলাদেশকে আমন্ত্রণ জানাতে যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরি শুক্রবার ঢাকা আসছেন বলে বেনারকে জানিয়েছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মোমেন। 

মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের উদ্যোগে আগামী ২২ ও ২৩ এপ্রিল অনুষ্ঠিত হবে লিডার সামিট অন ক্লাইমেট। এতে অংশগ্রহণের জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে আমন্ত্রণ জানানোই মার্কিন প্রেসিডেন্টের জলবায়ু বিষয়ক বিশেষ দূত কেরির ৯ এপ্রিল ঢাকা সফরের মূল উদ্দেশ্য বলে জানান পররাষ্ট্রমন্ত্রী।

করোনাভাইরাস মহামারির কারণে ৪০টি দেশের রাষ্ট্র বা সরকার প্রধানের অংশগ্রহণে এই সম্মেলন হবে ভার্চুয়ালি।

সম্মেলনটি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ উল্লেখ করে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, “বাইডেন প্রশাসন জলবায়ু ইস্যুতে অনেক গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে যাচ্ছে। আমরা এ বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আছি।”

বাংলাদেশ বর্তমানে ক্লাইমেট ভালনারেবল ফোরামের (সিভিএফ) চেয়ারম্যান হিসেবে ৪০টি দেশকে এই ইস্যুতে নেতৃত্ব দিচ্ছে বলে জানান পররাষ্ট্রমন্ত্রী।

২০১৫ সালের প্যারিস চুক্তিতে জলবায়ুজনিত ক্ষতি মোকাবেলায় প্রতিবছর দশ হাজার কোটি (একশ বিলিয়ন) ডলার তহবিল গঠনের কথা থাকলেও বিষয়টি এখনো বাস্তবায়িত হয়নি উল্লেখ করে তিনি বলেন, “আমরা বৈশ্বিক তহবিল গঠনের আহ্বান জানাব।”

“পাশাপাশি প্রতিটি দেশ যেন তাদের প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী কার্বন নিঃসরণ কমিয়ে আনে সে বিষয়টিও তুলে ধরব,” বলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী।

তিনি বলেন, “উন্নত বিশ্বের সম্পদ অপব্যবহারের কারণে বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে, যার ভুক্তভোগী আমরা। এ কারণে সংশ্লিষ্ট দেশগুলোকে এই বোঝার কিছু অংশ বহন করতে হবে।”

জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম জানিয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোমেন বলেন, “আমাদের একমাত্র আবাসস্থল পৃথিবী। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একে আমাদের রক্ষা করতে হবে।” 

বিশ্বব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, বছরে সারা বিশ্বে ঝড়ে যত ক্ষয় ক্ষতি হয় তার পাঁচ ভাগের দুই ভাগই মোকাবেলা করতে হয় গাঙ্গেয় বদ্বীপ বাংলাদেশকে। গত দুই দশকে সাইক্লোনে বৈশ্বিক প্রাণহানির প্রায় ৬০ ভাগই ঘটেছে বাংলাদেশে।

বন্যায় ঘরবাড়ি, ফসল ও সম্পদের ক্ষয়ক্ষতি বাংলাদেশে নিয়মিত ঘটনা। এছাড়া নদী ভাঙনে বাংলাদেশে প্রতি বছর এক হাজার হেক্টরের মতো জমি হারিয়ে যায়। 

বাংলাদেশের তিন ভাগের দুই ভাগ এলাকারই উচ্চতা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে পাঁচ মিটারের কম। বৈশ্বিক উষ্ণতার প্রভাবে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়লে ফসলের জমিতে লবণাক্ত পানি ঢুকে ব্যাপক ফসলহানির ঝুঁকিতে রয়েছে বাংলাদেশ।

বিশ্বব্যাংকের হিসাবে জলবায়ুজনিত প্রভাবে ২০০৫ থেকে ২০৫০ সালের মধ্যে প্রতি বছর বাংলাদেশের কৃষি উৎপাদন শতকরা তিনভাগ করে কমার আশঙ্কা রয়েছে। সম্মিলিতিভাবে ৪৫ বছরে যার আর্থিক মূল্য দাঁড়াবে তিন হাজার ৬০০ কোটি মার্কিন ডলারের সমান। 

মারাত্মক ঝুঁকিতে বাংলাদেশ

জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব বাংলাদেশে “খুবই মারাত্মক” বলে মনে করেন বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান।

তিনি বেনারকে বলেন, “যেভাবে আমরা গ্রিন হাউস গ্যাস নির্গমন করছি এবং পৃথিবী উত্তপ্ত হয়ে পড়ছে, এই ধারা অব্যাহত থাকলে ২০৫০-৭৫ সালের মধ্যে বাংলাদেশ তার মোট ভূ-পৃষ্ঠের এক তৃতীয়াংশ সমুদ্রে গর্ভে হারাবে।”

“এতে পৃথিবীর সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ এই দেশে জনসংখ্যার ঘনত্ব আরো বাড়বে, ফসল উৎপাদন মারাত্মকভাবে ব্যাহত হবে, নদীগুলোতে লোনা পানি ঢুকে মিঠাপানির আধার হারাবে। উপকূলীয় এলাকায় দুর্যোগের পৌনঃপুনিকতা বাড়বে,” বলেন রিজওয়ানা হাসান।

এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশে জন কেরির আসন্ন সফর অত্যন্ত ইতিবাচক উল্লেখ করে পরিবেশ ও টেকসই উন্নয়ন বিশেষজ্ঞ কামরুল ইসলাম চৌধুরী বেনারকে বলেন, “হোয়াইট হাউসে যাওয়ার প্রথম দিনেই প্যারিস জলবায়ু চুক্তিতে ফেরার প্রতিশ্রুতি দেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। বিশ্ব ধরিত্রী দিবসকে সামনে রেখে তিনি বিশেষ ভালো কোনো ঘোষণা দিতে পারেন বলে ধারণা করা হচ্ছে।”

তিনি বলেন, “মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যেহেতু বড়ো কার্বন নিঃসরণকারী দেশ। তারা যদি উদ্যোগ নেয় তাহলে তাদের দেশে এটা কমতে পারে, পাশাপাশি অন্যান্য দেশকেও কমানোর জন্য তারা উদ্বুদ্ধ করতে পারে।”

জলবায়ুর পরিবর্তনের কারণে আমাদের জাতীয় আয়ের একটা উল্লেখযোগ্য অংশ ক্ষতি হয় উল্লেখ করে কামরুল ইসলাম বলেন, “জো বাইডেনের জলবায়ু অর্থায়নের নতুন অঙ্গীকারের মাধ্যমে আমরা লাভবান হতে পারি। আবার সারা বিশ্বে কার্বন নিঃসরণ কমলেও আমরা লাভবান হবো এবং জাতীয় ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে পারব।”

“জলবায়ু পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় নতুন এবং অতিরিক্ত অর্থায়ন প্রয়োজন,” জানিয়ে তিনি বলেন, “এ ছাড়া কার্বন নিঃসরণ বন্ধে প্রযুক্তিগত সহায়তা দরকার আমাদের।”

করোনাভাইরাস মহামারির কারণে জলবায়ু পরিবর্তনসংক্রান্ত সম্মেলনসহ (কপ–২৬) কয়েকটি সম্মেলন গত বছর অনুষ্ঠিত হয়নি বলে জানান এই জলবায়ু বিশেষজ্ঞ।

সৈয়দা রিজওয়ানা হাসানের মতে, জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় যদি অর্থ পাওয়া যায়, তবে “বাংলাদেশের করণীয় হবে দুর্যোগ মোকাবেলায় উপকূলীয় বাগান সৃজন করার মতো প্রাকৃতিক পন্থাগুলো বাড়ানো, দুর্যোগপ্রবণ এলাকায় আশ্রয়কেন্দ্র ও যুতসই প্রযুক্তি দিয়ে বাঁধ মেরামত বা নির্মাণ করা।”

“এছাড়া খাদ্য উৎপাদন অব্যাহত রাখতে, অল্প জমিতে দেশীয় প্রযুক্তি ব্যবহার করে বেশি ফসল ফলন পেতে, মানুষের স্বাস্থ্য সুরক্ষায় করণীয় নির্ধারণে গবেষণার দিকেও বাংলাদেশকে নজর দিতে হবে,” মনে করেন তিনি। 

সর্বোপরি তাঁর মতে, পরিবেশগত সক্ষমতায় ১৮০ টি দেশের মধ্যে ১৮৯ নম্বরে থাকা বাংলাদেশকে এ বিষয়ে সক্ষমতা অর্জন করতে হবে।

‘বাংলাদেশ মুখ্য ভূমিকা পালন করছে’

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা জানান, জন কেরি তাঁর কয়েক ঘণ্টার বাংলাদেশ সফরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. একে আবদুল মোমেনের সাথে সাক্ষাত করবেন। ঢাকা আসার আগে জন কেরি একই বিষয়ে নয়াদিল্লী ও সংযুক্ত আরব আমিরাত সফর করবেন।

“জলবায়ু সংকট মোকাবেলা করতে আমিরাত, ভারত এবং বাংলাদেশের বন্ধুদের সাথে অর্থবহ আলোচনার প্রত্যাশা করছি,” এ সফরের বিষয়ে গত ১ এপ্রিল করা এক টুইটে বলেন জন কেরি।

এদিকে ঢাকায় জন কেরি বাংলাদেশ সরকারের নেতৃবৃন্দ ছাড়াও উন্নয়ন সহযোগী ও আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রতিনিধিদের সাথে মিলিত হবেন বলে এক বিবৃতিতে জানিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের এক মুখপাত্র।

সিভিএফ চেয়ারম্যান হিসেবে “জলবায়ুজনিত পরিবর্তন মোকাবেলায় বাংলাদেশ মুখ্য ভূমিকা পালন করছে,” বলেও বিবৃতিতে উল্লেখ করেন ওই মুখপাত্র।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা বেনারকে বলেন, “আগামী নভেম্বরে স্কটল্যান্ডের গ্লাসগোতে জাতিসংঘ আয়োজিত পরবর্তী জলবায়ু পরিবর্তনসংক্রান্ত সম্মেলন (কপ–২৬) অনুষ্ঠিত হবে। তার আগে দুই সরকার একসাথে কাজ করতে চায়।”

“সারা পৃথিবীতে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার জন্য প্যারিস চুক্তিতে প্রতিবছর একশ বিলিয়ন ডলার ফান্ড গঠনের কথা ছিল। সেটার জন্য জন কেরি খুব কমিটেড,” বলেন তিনি।

“এ ছাড়া জাতীয় ক্ষেত্রে জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ে আমাদের যতগুলো প্রোগ্রাম রয়েছে সেগুলোতে আরো বেশি সহায়তা কামনা করছে বাংলাদেশ। জন কেরির সফরের মধ্য দিয়ে জাতীয় পরিকল্পনায় যুক্তরাষ্ট্রকে আরো বেশি যুক্ত করার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে,” মনে করেন ওই কর্মকর্তা।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।