জলবায়ু পরিবর্তন: চরম ঝুঁকির মুখে বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার লাখ লাখ শিশু
2021.08.20
ঢাকা
বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার আরো তিন দেশের লাখ লাখ শিশু জলবায়ু পরিবর্তনের চরম ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে বলে জানিয়েছে জাতিসংঘ শিশু তহবিল- ইউনিসেফ।
শুক্রবার প্রকাশিত শিশুদের ওপর জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব সম্পর্কিত ‘চিলড্রেনস ক্লাইমেট রিস্ক ইনডেক্স’ এর প্রথম প্রতিবেদনে একথা বলা হয়েছে। দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশ, পাকিস্তান, ভারত ও আফগানিস্তানের লাখ লাখ শিশু সাইক্লোন, দাবদাহসহ জলবায়ু পরিবর্তনের অন্যান্য দুর্যোগের শিকার হয়ে ক্ষুধা ও বাস্তুচ্যুত হবে বলেও এ প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।
ইউনিসেফ বলছে, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে দক্ষিণ এশিয়ায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে পাকিস্তান (বিশ্বের সকল দেশের মধ্যে ১৪তম)। এরপরই অবস্থান আফগানিস্তান ও বাংলাদেশের (১৫তম)। ভারতের অবস্থান ২৬তম। নেপাল, শ্রীলঙ্কা ও ভুটানের অবস্থান যথাক্রমে ৫১তম, ৬১তম এবং ১১১তম।
শুধু ক্ষুধা, বাস্তুচ্যুতি নয় বিশাল সংখ্যক শিশু শিক্ষা থেকেও বঞ্চিত হবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
এই প্রথমবারের মতো দক্ষিণ এশিয়ায় লাখ লাখ শিশুর ওপর জলবায়ু পরিবর্তনের সরাসরি প্রভাব সম্পর্কে জানা গেলো বলে এক বিবৃতিতে বলেছেন ইউনিসেফের দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক পরিচালক জর্জ লারিয়া-আদজেই।
“এই অঞ্চলে খরা, বন্যা, বায়ু দূষণ ও নদী ভাঙনের ফলে লাখ লাখ শিশু ক্ষুধা ও বাস্তুচ্যুতির শিকার হয়েছে যারা পানি ও স্বাস্থ্য সেবা পায়নি,” বলেন তিনি।
পরিচালক জর্জ বলেন, “করোনাভাইরাস মহামারি এবং জলবায়ু পরিবর্তনের যৌথ প্রভাবে দক্ষিণ এশিয়ার শিশুদের জন্য ভয়ানক সংকট সৃষ্টি করেছে। এ ব্যাপারে এখনই ব্যবস্থা নিতে হবে।”
তিনি বলেন, “জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব থেকে এই শিশুদের ভবিষ্যৎ রক্ষা করতে পানি, স্বাস্থ্যসেবা ও শিক্ষায় বিনিয়োগ করতে হবে।”
দক্ষিণ এশিয়ায় জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব বেশি
ইউনিসেফের প্রতিবেদনের সাথে একমত পোষণ করে ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর ক্লাইমেট চেঞ্জের উপপরিচালক মিজান আর. খান শুক্রবার বেনারকে বলেন, “বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ায় জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকর প্রভাব সবচেয়ে বেশি। কারণ, এ অঞ্চলে জনসংখ্যার ঘনত্ব বিশ্বের সবচেয়ে বেশি। এখানে দরিদ্র মানুষের সংখ্যা বিশ্বের মধ্যে সবচেয়ে বেশি।”
তিনি বলেন, “এই অঞ্চলে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে বিনিয়োগ অনেক কম বলে যে কোনো সংকটে শিশুরা সবচেয়ে ঝুঁকিতে থাকে। তাই, তাদের রক্ষার জন্য সরকারসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে স্বাস্থ্য, শিক্ষাসহ অন্যান্য সামাজিক সুরক্ষা খাতে অনেক বিনিয়োগ করতে হবে।”
সম্প্রতি জাতিসংঘের সংস্থা আইপিসিসির ষষ্ঠ প্রতিবেদনে জলবায়ু পরিবর্তনের যে ঝুঁকির কথা বলেছে সেটি মারাত্মক বলে উল্লেখ করেন ড. মিজান।
তিনি বলেন, “জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে দেশের উপকূলীয় অঞ্চলের একটি বিরাট অংশ সাগরে তলিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। এতে লাখ লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত হবে। ফলে ক্ষুধা, বেকারত্ব বাড়বে। এছাড়া শিশুরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এদের বিরাট অংশ শিক্ষার বাইরে রয়ে যাবে।”
“সুতরাং সরকারের উচিত হবে উপকূলীয় অঞ্চলে প্রয়োজনীয় অবকাঠামো নির্মাণ করা যাতে কম সংখ্যক মানুষ বন্যা, জলোচ্ছ্বাস, সাগরপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির কারণে বাস্তুচ্যুত হয়। মানুষের ক্ষতি কমানো গেলে শিশুদের রক্ষা করা সহজ হবে,” ড. মিজান বলেন।
বিশ্বে শিল্পোন্নত দেশগুলোর অতিমাত্রায় জীবাশ্ম জ্বালানি যেমন কয়লা, গ্যাস, তেল পোড়ানোর ফলে বিশ্বের তাপমাত্রা ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে অ্যান্টার্কটিকা অঞ্চলে মাত্রাতিরিক্ত বরফ গলছে এবং বরফ গলা পানিতে বিশ্বের বিভিন্ন উপকূলীয় অঞ্চল ডুবে যাবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। এতে বাস্তুচ্যুত হবে লাখ লাখ মানুষ।
এছাড়াও জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে প্রাকৃতিক দুর্যোগ যেমন ঝড়, বন্যা, জলোচ্ছ্বাস বৃদ্ধি পাবে।
বাংলাদেশের মোট ভূখণ্ডের মধ্যে শতকরা ৩২ ভাগ উপকূলীয় অঞ্চলে। এর মধ্যে রয়েছে ১৯ জেলা।
আন্তর্জাতিক বিভিন্ন গবেষণা অনুসারে, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের খুলনা, সাতক্ষীরা, বাগেরহাট, পিরোজপুরসহ দেশের উপকূলীয় অঞ্চলের অনেকাংশ ডুবে যাবে।
ইনভায়রেনমেন্ট জাস্টিস ফাউন্ডেশনের মতে, ২০৫০ সালের মধ্যে বাংলাদেশে প্রতি সাতজন মানুষের মধ্যে একজন জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাস্তুচ্যুত হবে।
উপকূলীয় অঞ্চল ছাড়াও, খরা প্রবণ উত্তর পশ্চিমাঞ্চলে অনাবৃষ্টিসহ বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে অসংখ্য মানুষ শহরাঞ্চলে, মূলত বস্তিতে আশ্রয় নেবে বলে আশঙ্কা রয়েছে।
শহরাঞ্চলে চাপ বৃদ্ধি পাবে
জলবায়ু পরিবর্তনের অন্যতম ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা খুলনা জেলার পাইকগাছা উপজেলার লস্কর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান কে.এম. আরিফুজ্জামান তুহিন বেনারকে বলেন, “আমাদের এখানে উত্তরবেদকাঠি, দক্ষিণবেদকাঠি গতবছর বন্যায় তলিয়ে যায়। সেখানকার মানুষেরা বাঁধে আশ্রয় নেয়। এ বছর পানি নেমে গেছে। তবে আবার ডুবে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।”
তিনি বলেন, “এখানকার অনেক মানুষ কাজের সন্ধানে বিশেষ করে ইটভাটায় কাজ করার জন্য বছরের ছয় মাস বাড়ি ছেড়ে অন্যত্র চলে যায়। বাড়ি থেকে চলে যাওয়ার সময় তাদের স্কুল পড়ুয়া ছেলেমেয়েদের সাথে নিয়ে যায়। ফলে এই সকল ছেলেমেয়েরা স্কুল থেকে ঝরে পড়ে।”
সরকারের পরিবেশ অধিদপ্তরের ক্লাইমেট সেলের পরিচালক মির্জা শওকত আলী শুক্রবার বেনারকে বলেন, “জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকারক প্রভাব থেকে শিশুদের রক্ষা করতে মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয় গ্রিন ফান্ড ব্যবহার করে বিভিন্ন প্রকল্প পরিচালনা করছে। এই প্রকল্প নারীদের জন্য গ্রহণ করা হলেও স্বাভাবিকভাবেই শিশুরা এর আওতায় চলে আসে।”
“জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকর দিক মোকাবেলা করতে আমরা চারটি দিকে বিশেষ জোর দিচ্ছি: কৃষি, পানিসম্পদ, শহরাঞ্চল ব্যবস্থাপনা এবং উপকূলীয় অঞ্চল,” বলেন তিনি।
মির্জা শওকত বলেন, “কৃষি ও পানিসম্পদ সরাসরি খাদ্য নিরাপত্তার সাথে জড়িত; এর মাধ্যমে নারী-শিশুসহ সকলের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব হবে।”
তিনি বলেন, “জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বিশ্বের সকল শহরাঞ্চলে মানুষের চাপ বৃদ্ধি পাবে। তাই, শহরাঞ্চল ব্যবস্থাপনার ওপর আমরা জোর দিচ্ছি। এছাড়া, উপকূলীয় অঞ্চল রক্ষার জন্য আমরা উপকূলীয় ব্যবস্থাপনায় জোর দিচ্ছি।”
মির্জা শওকত বলেন, “জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলা করতে আমরা ন্যাশনাল অ্যাকশন প্ল্যান (ন্যাপ) প্রস্তুত করছি। তবে ইউনিসেফের প্রতিবেদনটি আমাদের ন্যাপ প্রস্তুত করতে সহায়তা করবে।”