প্রশ্ন ফাঁস রোধে কোচিং সেন্টার বন্ধ, ফেসবুকও বন্ধ রাখার চিন্তা
2018.01.25
ঢাকা
নানামুখী উদ্যোগ নিয়েও বিভিন্ন পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস ঠেকাতে ব্যর্থ হয়ে সরকার এবার আসন্ন এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁস ঠেকাতে শুক্রবার থেকেই দেশের সব ধরনের কোচিং সেন্টার বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
পাশাপাশি ‘সীমিত সময়ের’ জন্য ফেসবুক বন্ধের পরিকল্পনা এবং পরীক্ষা শুরুর আধা ঘণ্টা আগে পরীক্ষার্থীদের কেন্দ্রে গিয়ে নিজ নিজ আসনে বসা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।
সুষ্ঠুভাবে পরীক্ষা অনুষ্ঠানের লক্ষ্যে বৃহস্পতিবার মন্ত্রণালয়ে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত জাতীয় মনিটরিং কমিটির বৈঠকে সাংবাদিকদের উপস্থিতেতে এসব কথা জানানো হয়।
“কোচিং সেন্টারগুলো প্রশ্ন ফাঁস করার ‘আখড়া’। তারা প্রশ্ন ফাঁস করতে পারলে ছাত্র বেশি যায়। এ কারণেই আমরা শুক্রবার থেকে পরীক্ষা শেষ না হওয়া পর্যন্ত কোচিং সেন্টারগুলো বন্ধ রাখব,” বলেন শিক্ষামন্ত্রী।
এ সিদ্ধান্ত কার্যকর করতে সভায় উপস্থিত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রতিনিধিদের নির্দেশ দেন তিনি।
এদিকে পরীক্ষা চলাকালীন সীমিত সময়ের জন্য ফেসবুকসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম বন্ধ রাখার বিষয়ে সভায় মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সচিব সোহরাব হোসাইন জানান, “সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সঙ্গে এ বিষয়ে আলোচনা চলছে। দু’এক দিনের মধ্যে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত জানানো হবে।”
এসব ব্যবস্থা নেওয়ার পরও কোনো পরীক্ষায় প্রশ্ন ফাঁসের প্রমাণ পাওয়া গেলে সে পরীক্ষা বাতিল করা হবে বলেও ওই বৈঠকে জানানো হয়।
“যদি প্রশ্ন ফাঁসের কোনো ঘটনা ঘটে, যদি পরীক্ষার পরেও তার প্রমাণ পাওয়া যায়, তাহলে সে পরীক্ষা বাতিল হবে,” বলেন সোহরাব হোসাইন।
তবে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রশ্নপত্র ফাঁসের উৎস খুঁজে অপরাধীদের শাস্তির মুখোমুখি না করে কোচিং বা ফেসবুক বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত প্রশ্ন ফাঁস রোধে খুব একটা কাজে দেবে না।
“ফেসবুক বন্ধ হলেই যে প্রশ্ন ফাঁস বন্ধ হয়ে যাবে তা নয়। কারণ, প্রশ্ন ফাঁসের সঙ্গে জড়িতরা এতটাই উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন যে, ফেসবুক বন্ধ থাকলেও প্রশ্ন ফাঁসের কাজ তারা করতে পারে,” বেনারকে বলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম।
এই শিক্ষাবিদ বলেন, “আসল কাজ হচ্ছে কেন ফাঁস হচ্ছে, কারা করছে, কীভাবে করছে সেটা খুঁজে বের করে উপযুক্ত শাস্তি দেওয়া।”
কোচিং বন্ধ রাখার বিষয়টিও হাস্যকর উল্লেখ করে তিনি বলেন, “দেশে এত হাজার হাজার কোচিং সেন্টার সেগুলো বন্ধ রইল কি না সেটা তদারকি কে করবে?”
প্রশ্নপত্র ফাঁসরোধে নেওয়া বিভিন্ন পদক্ষেপের বিষয়ে শিক্ষামন্ত্রী বলেন, “পরীক্ষা শুরুর আধঘণ্টা আগে প্রশ্নপত্রের প্যাকেট খোলা হবে। এর আগে কেউ প্রশ্নের প্যাকেট খুললে তাৎক্ষণিকভাবে তার বিরুদ্ধে নেওয়া হবে। এ বিষয়টি দেখার জন্য এবার আলাদাভাবে লোক থাকবে।”
এর আগে গত ৪ জানুয়ারি এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে শিক্ষা মন্ত্রণালয় জানায়, এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষা শুরুর আধা ঘণ্টা আগে পরীক্ষার্থীদের অবশ্যই কেন্দ্রে প্রবেশ করতে হবে। অন্যথায় তারা পরীক্ষায় অংশ নিতে পারবে না।
তবে এই সিদ্ধান্তের সমালোচনা করে অধ্যাপক মনজুরুল ইসলাম বলেন, “ঢাকা, চট্টগ্রামের মতো যানজটের শহরে আধা ঘণ্টা আগে ছেলেমেয়েরা পরীক্ষার হলে পৌঁছে যাবে, এ নিশ্চয়তা কে দেবে? তারা আধা ঘণ্টা আগে এলেই প্রশ্ন ফাঁস বন্ধ হয়ে যাবে, এটা ভাবার কোনো কারণ নেই।”
প্রসঙ্গত আগামী ১ ফেব্রুয়ারি শুরু হয়ে ২৪ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত চলবে এসএসসি (মাধ্যমিক স্কুল সার্টিফিকেট) পরীক্ষা। এ বছর এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় অংশ নেবে ১২ লাখের বেশি পরীক্ষার্থী।
প্রশ্ন ফাঁসের ঘটনা
গত কয়েক বছর ধরে বিভিন্ন পাবলিক পরীক্ষা থেকে শুরু করে চাকরিতে নিয়োগের পরীক্ষার প্রশ্নও ফাঁস হচ্ছে। পরীক্ষার আগে ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগের বিভিন্ন মাধ্যমে প্রশ্ন ফাঁসের প্রমাণ মিললেও সেসব পরীক্ষা বাতিল করেনি সরকার।
তবে ট্রেজারি থেকে প্রশ্ন আনার ক্ষেত্রে বড় ধরনের গাফিলতি পাওয়া গেছে বলে সভায় জানান ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের অতিরিক্ত ডিআইজি শেখ নাজমুল আলম।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হিসাব অনুযায়ী, ২০১৭ সালেই প্রশ্নপত্র ফাঁসের বিভিন্ন অভিযোগে অন্তত ৭১ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। এর মধ্যে অন্তত ৩৬ জন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় এবং বাকিরা পাবলিক পরীক্ষা ও বিভিন্ন পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসে জড়িত ছিলেন।
গত সাড়ে আট বছরে বিভিন্ন পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগে কেবল ঢাকাতেই ৯০টি মামলা হয় বলে জানা যায়। এর মধ্যে জেএসসি, এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগে ১২টিসহ গত বছরই ২০টি মামলা করা হয়।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ৯০টি মধ্যে বর্তমানে ৫০টি বিচারাধীন ও ১৯টি তদন্তাধীন রয়েছে। আর সাক্ষীর অভাবে নিষ্পত্তি হওয়া ১২টি মামলার আসামিরা অব্যাহতি পেয়েছেন। প্রাথমিক তদন্তে অভিযোগের সত্যতা না পাওয়ায় অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে সাত মামলার আসামিদের।
“প্রশ্ন ফাঁসের জন্য শাস্তি পেয়েছে এমন কোনো নজির আমাদের নেই। অপরাধীরা যদি শাস্তি না পায় তাহলে অপরাধের মাত্রা তো বাড়বেই,” বলেন সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম।